বেজোসের ‘পকেটে’ বন্ড, এমজিএম কিনতে অ্যামাজন দিচ্ছে ৮৪৫ কোটি ডলার

ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজন যখন ৮৪৫ কোটি ডলারের চুক্তি করছে আইকনিক চলচ্চিত্র নির্মাতা এমজিএমের সঙ্গে তখন হলিউডের একটি অধ্যায় ঢুকে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়; আর শুরু হচ্ছে নতুন এক যুগের।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2021, 06:56 PM
Updated : 27 May 2021, 03:28 PM

হালের আমলে অনলাইনে ভিডিও স্ট্রিমিং সেবা নেটফ্লিক্স ও ডিজনি প্লাসের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে থাকতেই বেজোস জেমস বন্ডের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এমজিএম কিনতে তার পকেট থেকে এত ব্যাপক অর্থ খরচের পদক্ষেপ নিলেন, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৭১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ।

দেড় দশক আগে ২০০৬ সালে জেফ বেজোস যখন ভিডিও সেবা ‘অ্যামাজন আনবক্স’ শুরু করেন তখনও জেমস বন্ড সিরিজসহ অনেক ‘হিট’মুভির জন্য পরিচিত মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার – এমজিএম এর অবস্থা রমরমাই ছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে সুবিধা করতে না পেরে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় এমজিএম এর মালিক পক্ষ।

করোনাভাইরাস মহামারীতে গত বছর নভেম্বরে জেমস বন্ডের নতুন ছবি ‘নো টাইম টু ডাই’ এর কাজ না এগোনোয় আরও ধাক্কা খায় ৯৭ বছরের চলচ্চিত্র ও টিভি স্টুডিওটি।

এমজিএম এর হতাশাকেই নিজেদের জন্য সুযোগ হিসেবে বেছে নেন জেফ বেজোস। যে কোনো মূল্য ঐতিহাসিক এই স্টুডিওকে নিজেদের করে নিতে চান।

তাই অ্যামাজন অন্য সম্ভাবনাময় ক্রেতার চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি দর হেঁকে এই চুক্তি নিশ্চিত করে বলে বলছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

অ্যামাজন ডটকম বুধবার আলোচিত এই চুক্তির ঘোষণা দেয়।

এটি অ্যামাজনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অধিগ্রহণ। এর আগে ২০১৭ সালে ১৩.৭ বিলিয়ন ডলারে হোল ফুড মার্কেট কিনেছিল বেজোসের প্রতিষ্ঠানটি।

অন্য ক্রেতাদের মধ্যে অ্যাপল ও কমকাস্টের মতো বড় ব্র্যান্ডও ছিল।

প্রতিযোগীর তালিকাটা আরও দীর্ঘ। এইচবিও ম্যাক্স, প্যারামাউন্ট প্লাসের মতো প্রতিষ্ঠানও রয়েছে স্ট্রিমিংয়ের ভার্চুয়াল দুনিয়ায়।

এর আগে ২০১৬ সালে চীনা এক কোম্পানি ৮০০ কোটি ডলারে এমজিএম কিনতে চেয়েছিল। চুক্তি প্রায় হয়েই গিয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব বদলে যায়।

২০১১ সালে নাম বদলে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও এ পরিণত হওয়া বেজোসের প্রতিষ্ঠানটি নতুন চুক্তির ফলে জেমস বন্ডের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এমজিএম এর বিশাল চলচ্চিত্র, টিভি শো এর সংগ্রহশালার মালিক বনে যাবে।

এমজিএম হল একটি আইকনিক মুভি স্টুডিও যা হলিউডের জেমস বন্ড সিরিজটি দিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।

শুধু জনপ্রিয় এই মুভি সিরিজ নয়, ১৯২৪ সালে মার্কাস লো ও লুইস বি মায়ার প্রতিষ্ঠিত পুরনো স্টুডিওটির ঝুলিতে দর্শকপ্রিয় ফারগো, ভাইকিংস ও শার্ক ট্যাংকের মতো টিভি শো রয়েছে। এপিক্স কেবল চ্যানেলেরও মালিক এমজিএম।

প্রায় ১০ দশক ধরে এমজিএম স্টুডিও'র কাছে হলিউডের গোল্ডেন ডে থেকে বর্তমান পর্যন্ত অনেক ব্লকবাস্টার মুভি ও টিভি শো রয়েছে।

বেন-হুর, দ্যা উইজার্ড অব ওজসহ বিখ্যাত অনেক মুভিই বানিয়েছে তারা।

গন উইথ দ্য উইন্ড, থেলমা অ্যান্ড লুইস, হবিট ফ্র্যাঞ্চাইজির মতো বহু জনপ্রিয় মুভির নির্মাতা এমজিএম।

অনেক ক্ল্যাসিক মুভি ও টিভি শোসহ স্টুডিওটির কাছে আছে ৪ হাজার সিনেমা ও ১৭ হাজার ঘণ্টার টিভি অনুষ্ঠান।

এই চুক্তি অ্যামাজনের প্রাইম ভিডিও সেবাকে আরও একধাপ এগিয়ে দেবে।

রয়টার্স লিখেছে, এতে ‘সুপার চার্জ’ হবে বেজোসের প্রতিষ্ঠানটি। পুরনোদের সঙ্গে নতুন দর্শক তাদের স্ট্রিমিং সেবাতেই থাকবে।

এই চুক্তির পেছনের আসল আর্থিক মূল্যকে এমজিএম এর বিশাল ক্যাটালগ, যাকে ‘ট্রেজার ট্রোভ’ (মেধাস্বত্ব) হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রাইম ভিডিও ও অ্যামাজন স্টুডিও এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক হপকিন্স।

তিনি বলেন, “এই অধিগ্রহণের পর এমজিএম এর প্রতিভাবান টিমের সঙ্গে মিলে তারা নতুন করে অনেক কিছুই করতে চান। উচ্চ মানের গল্প বলার জন্য এটি দারুণ এক সুযোগ তৈরি করেছে। এই চুক্তি নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে আছি আমরা।“

রয়টার্স বলছে, স্ট্রিমিং সার্ভিসের সব প্রতিযোগী বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। বাড়তে থাকা আন্তর্জাতিক বাজারেও নজর তাদের।

মহামারীতে সিনেমা হলের বদলে ঘরবন্দি সময়ে অনলাইনের বিনোদনের বড় মাধ্যমে পরিণত হওয়া স্ট্রিমিং সার্ভিস এখন দর্শক চূড়ায় বলে সবাই কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে।

শুধু চলচ্চিত্র নয়, অ্যামাজন সরাসরি খেলা সম্প্রচারেও সাম্প্রতিক সময় বড় ধরনের বাজি ধরছে। এ জন্য মার্কিন ন্যাশনাল ফুটবল লিগ বা এনএফএলের সঙ্গে প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে।

স্ট্রিমিং সার্ভিস শুধু নতুন সিনেমা যুক্ত হচ্ছে তা নয়, ব্র্যান্ডগুলো পুরনো সিনেমা ও টিভি শোর সংগ্রহ বাড়াচ্ছে।

এই ট্রেন্ডের জন্যই গত সপ্তাহে মার্কিন মিডিয়া কোম্পানি এটিঅ্যান্ডটি ৪৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে ওয়ার্নার মিডিয়ার সঙ্গে এবং ডিসকভারির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে।

বিনোদন জগতে অ্যামাজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরিকল্পনা করছে। এজন্য এর চেয়ে ভালো কোনো চুক্তি হতে পারে না, যেটির মাধ্যমে হলিউডের সবচেয়ে আইকনিক মুভি স্টুডিও কেনা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ইনভেস্টিং ডটকমের সিনিয়র এনালিস্ট জেস কোহেন।

ছবি রয়টার্স

এর মাধ্যমে স্ট্রিমিং যুদ্ধ আরও তেতে উঠল বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বেশ কয়েক বছর আগে থেকে বিক্রির আলোচনা থাকলেও ডিসেম্বরে এমজিএম বিক্রির আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন এর মূল্য সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন বা ৫৫০ কোটি ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল।

এমজিএম অধিগ্রহণের মাধ্যমে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই সহযোগীকে পাশে পাওয়ার কারণে অ্যামাজনের স্টিমিং সার্ভিস আরও গতি পাবে।

বিশ্বজুড়ে বক্স অফিস থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার আয় করা জেমস বন্ডের মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্র সিরিজের মালিকানা স্বত্বই এগিয়ে দেবে তাদের।

রকি, মুনস্ট্যাক, দি সাইল্যান্স অব ল্যাম্বসের মত ক্লাসিক মুভি তৈরি করেও নাম কামিয়েছে এমজিএম।

জনপ্রিয় চরিত্রগুলোর খনি বলা চলে এমজিএমকে। এই চুক্তির মাধ্যমে মেধাস্বত্বের অধিকার পাওয়ায় তা কাজে লাগিয়ে এগুলোকে কেন্দ্র করে নতুন শো বা চলচ্চিত্র নিমার্ণ করেও অ্যামাজন প্রাইম দর্শক টানতে পারবে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির দুই সাবেক কর্মকর্তা।

তবে জেমস বন্ডের নতুন চলচ্চিত্র আনার মাধ্যমে দর্শক টানার বিষয়টি কিছুটা জটিল হতে পারে।

রয়টার্স লিখেছে, যে শর্তের আওতায় এমজিএম ফ্রান্চাইজির সঙ্গে যুক্ত তা বন্ড মুভির প্রযোজক ব্রকলি পরিবারের হাতে রয়েছে।

নিই ইয়র্ক টাইমস বলছে, জেমস বন্ডকে ‘পকেটে পোরার’ বিষয়টি অনেকটা প্রতীকি হবে এই চুক্তির ক্ষেত্রে।

কেননা বেজোসের প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সিরিজের ৫০ শতাংশের মালিকানা পাবে। বাকি অংশ থাকবে ব্রকলি পরিবারের দুই ভাইয়রে কাছে।

এমজিএম করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর নতুন কোনো ছবি মুক্তি দিতে পারেনি। এর মধ্যে কয়েকবার পিছিয়ে গেছে জেমস বন্ড সিরিজের ২৫তম ছবি ‘নো টাইম টু ডাই' এর কাজ।

স্টুডিওটি ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আয় করে ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

মহামারীতে চলচ্চিত্র শিল্প বড় ধাক্কা খাওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয় এমজিএমকে।

অনেক দিন থেকেই অবশ্য নামকরা প্রতিষ্ঠানটি একটু একটু করে বিক্রি হচ্ছিল। অ্যামাজনের আগেই তাদের ঝুলিতে হাত পড়েছে অন্যদের।

১৯৮৬ সালের আগের বানানো চলচ্চিত্র ও টিভি শোর বড় অংশ কিনেছে সনি পিকচার ও ওয়ার্নার ব্রাদার্স (যাদের হাতে রয়েছে সিংগিং ইন দ্য রেইন, দ্য উইজার্ড অব ওজ, গান উইথ দ্য উইন্ড এর মতো চলচ্চিত্র)।

তবে এর এমজিএম এর ১৯৬৩ সালে ‘ডা. নো’এর মাধ্যমে শুরু হওয়া জেমস বন্ড সিরিজই স্ট্রিমিং যুদ্ধে অ্যামাজনকে এগিয়ে দেবে বলে মনে করছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।