সিনেমায় সত্যজিতের নারীরা

সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে নারীরা শুধু অবলম্বন নয় বরং পুরুষ চরিত্রের সমকক্ষ হয়েই ধরা দিয়েছে।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2021, 04:12 PM
Updated : 2 May 2021, 04:12 PM

২ মে বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাত সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের সম্মাননা খেতাবে ভূষিত এই নির্মাতা বিভিন্ন চলচ্চিত্র দেশি ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে অলঙ্কৃত হয়েছে।

তার চলচ্চিত্রে নারীরা শুধু গল্পের প্রয়োজনেই আসেনি, বরং আলাদা আলাদা চরিত্র নিয়ে ফুটে উঠেছে কখনও আপন মহিমায় কখনও নারী মুক্তির আঁধার হিসেবে।

পরিচালকের জন্মশতবার্ষিকীতে সেসব নারী চরিত্র নিয়ে এই প্রতিবেদন।

পথের পাঁচালীর দুর্গা ও সর্বজয়া

১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া সত্যজিৎ রায়ে প্রথম পরিচালিত ছবি ‘পথের পাঁচালী’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবির দুই প্রধান নারী চরিত্র দুর্গা, যে গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র অপুর বোন। আর সর্বজয়া তাদের মা।

অপু চরিত্র প্রধান হলেও দুর্গা ও সর্বজয়াকে উপন্যাসের মতো চাপিয়ে রাখেননি সত্যজিৎ। আবার কেন্দ্রিয় চরিত্রকে ছাপিয়ে যেতে দেননি।

বোন হিসেবে দুর্গাকে দেখা যায় ভাইয়ের প্রতি স্নেহশীল, মমতাময়ী এবং রক্ষাকারী। যে কিনা ভাইয়ের হাত ধরে বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে সাহায্য করে। মারা যাওয়ার পরেও বোনের অভাববোধের বিষয়গুলো ‘পথের পাঁচালী’র পরের ছবিগুলোতেও ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ।

আবার সর্বজয়াকে সত্যজিৎ এঁকেছেন খুবই সাধারণ ঘরনী তবে শক্তিশালী চরিত্রে। কন্যার ‍মৃত্যু, অর্থ উপার্যনে স্বামীর চলে যাওয়া, ছোট ছেলেকে নিয়ে একা হয়ে যাওয়া সর্বজয়াকে দেখা গেছে সঙ্কল্পবদ্ধ আর সম্মান নিয়ে বাঁচতে। অথচ উপরের শক্ত আবরণের ভেতর সে ভেঙে পড়ছে। তারপরও অপুর স্বপ্ন পূরণে প্রতিজ্ঞ তিনি।

অপুর কাহিনী নিয়ে নির্মিত পরের ছবি অপরাজিত। যেখানে দেখা যায় সর্বজয়ার একাকী মরণ। শহর থেকে দেরি করে আসার জন্য অপুর আর মাকে জীবিত দেখা হয় না। এই শূন্যতার মধ্যেই যেন সর্বজয়া কেন্দ্রিয় চরিত্র অপুর সঙ্গে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটে।

দয়াময়ী  

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘দেবী’ সিনেমার কাহিনী আবর্তিত হয়েছে দয়াময়ীকে ঘিরে।

১৮৬০ সালের পটভূমিকায় সেই সময়ের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্ধবিশ্বাসের বলি হওয়ার উদাহরণ যেন দয়াময়ী। ১৭ বছরের বালিকা বধু; যার স্বামী পড়াশোনার জন্য কলকাতা চলে গেলে শ্বশুর সেবায় ব্রত হয়।

আর সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন শ্বশুর স্বপ্ন দেখে দয়াময়ীকে ‘দেবি মা কালি’ রূপে ভাবতে শুরু করে। এযেন শ্রদ্ধার বিনিময়ে আসা নারীদের ওপর সামাজিক দায় আর নির্যাতন।

সিনেমায় সেই ভাব ফুটিয়ে তুলতেই শেষ দৃশ্যে দেখা যায় মাঠ দিয়ে দয়াময়ী দৌড়াতে দৌড়াতে অদৃশ্য হয়ে যায়।

চারুলতার চারু

১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত ‘চারুলতা’- সত্যজিৎ রায় চিত্রায়নের খাতিরেই গল্পের খানিকটা পরিবর্তন এনেছেন।

কর্মপাগল পরিবারের কর্তা ভুপতির স্ত্রী চারু। যেকারণে সদ্য যৌবন প্রাপ্ত বধূ ‍উচ্চবিত্তের সংসারেও থেকেও এককী। তার এই একাকিত্ব যেন বাঙালি সমাজের বহু নারীর প্রতিকৃতি। যে কিনা সামাজিকতা রক্ষায় সুখী থাকার অভিনয় করে। তারপর তার সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত হয় যখন দেবর অমলের আগমন ঘটে। তাদের মধ্যে মিশ্র অনুরাগ মিল অমিলের অসম্ভব বা সম্ভাবতার চাইতেও ১৮৭৯ সালের প্রেক্ষাপটে নারীর ভালোবাসার বিভিন্ন রূপের আঁধার যেন চারুলতার চারু।

‘মহানগর’য়ের আরতি 

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোট গল্প অবলম্বনে নির্মিত সত্যজিতের ‘মহানগর’ সিনেমা ‍মুক্তি পায় ১৯৬৩ সালে। ছবিটি যেন নারীর ক্ষমতায়নের চিত্রায়ন। সেই সময়ে গল্পের আরতি যেন নারী মুক্তির পটচিত্র।

স্বামীর চাকরি হারানোর পর মধ্যবিত্ত পরিবারের হাল ধরতে স্ত্রী হিসেবে আরতি বিক্রয়-প্রতিনিধির কাজ শুরু করেন। ১৯৫০ সালের পটভূমিতে রক্ষণশীল পরিবারে এ যেন বাঁধ ভাঙার মতোই কঠিন। তারপরও আরতির মাঝে থাকা প্রবল স্রোত সেই সেই বাঁধ ভেঙে উপভোগ করে স্বাধীনতার প্রথম ধারণা। শহুরে জীবনে নিজের অভ্যন্তরে থাকা চরিত্র পরিবর্তণ না করেই মুখোমুখি হয় বাস্তবতায়। স্বামী-স্ত্রীর পাশাপাশি পথ চলার এই গল্পের এই চিত্রায়ন খুব কম ছবিতেই সূক্ষ্মভাবে ফুটে উঠতে দেখা গেছে।

অরণ্যের দিনরাত্রি’র অপর্ণা

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একই নামের চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে।

গল্পের নায়িকা অপর্ণা। যেখানে কেন্দ্রিয় চরিত্রে রয়েছে চার পুরুষ, তারা বন্ধু। শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে তারা প্রকৃতির স্বাদ নিতে চলে যায় বনে। সেখানে বাঙলোতে থাকা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে মাতাল হওয়ার মাঝেও অপর্ণা চরিত্রটি বারবার ফিরে আসে যেন তাদের সমকক্ষ হয়ে। যে নারীর মাঝে ফুটে ওঠে একদিকে বাঙালি নারীসুলভ আচরণ, অন্যদিকে আবেদনের নীরিক্ষা চালাতেও যিনি স্বাচ্ছন্দময়ী।

ঘরে বাইরে’র বিমলা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবল্মবনে সত্যজিতের ‘ঘরে বাইরে’ মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। ছবির বিষয়বস্তু নারীমুক্তি যা তার বিভিন্ন ছবিতেই উঠে আসে।

উপন্যাসে জাতি, জাতীয়তা, স্বাধিনীতার সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতাগুলো বাহিত হয়েছে। তবে একই স্রোতধারায় মিশে পরিচালক সিনেমায় ফুটিয়ে তুলেছেন অশিক্ষীত গৃহবধূর বিমলার প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা।

বিমলা ধনী জমিদারের স্ত্রী, যাকে সেখানো হয়েছে স্বামী মানেই উপাসনার যোগ্য। তবে যখন ‘বাইরে’ যাওয়া সুযোগ হল তখন তার মোহ কাটলো। আর তা প্রকাশ পেল স্বদেশি আন্দোলনের নেতা সন্দীপের সঙ্গে পরিচয়ে ভালোলাগায়।

এই সিনেমার মাধ্যমে সত্যজিৎ দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এক আবদ্ধ নারীর চরিত্রকে, যে কিনা মুক্তির স্বাদ পেলে তার আপন মহিমায় মেলে ধরতে পারে।

·        টাইমস অফ ইন্ডিয়া অবলম্বনে