বাংলাদেশের ব্যান্ডের ইতিহাসে নিলয় দাসকে উপেক্ষা করার অবকাশ যেমন নেই- তেমনই নেই তার অবদান অস্বীকার করার।
কিংবদন্তী এই গিটার-জাদুকরকে নিয়ে লিখেছেন গীতিকবি শেখ রানা তার ‘টুকরো নাগরিক জার্নাল’য়ের অংশ হিসেবে।
দিন তারিখ মনে রাখতে পারি না।
পারলে নিলয়দা'র সঙ্গে দেখা হওয়ার তারিখটা স্মৃতির জার্নালে টুকে রাখতাম। সেই তারিখ ফিরে ফিরে এলে ‘আকাশ কত বিশাল যদি দেখতে’ অথবা ‘কত যে খুঁজেছি তোমায়’-এই প্রিয় দুই গান গাইতাম। অবশ্যই রাসেলকে খুঁজে বের করে।
নিলয়’দাকে চাইলেও আর খুঁজে বের করা যাবে না। নিখোঁজ সংবাদের বিজ্ঞাপন দিলেও না।
নিলয়দা’র সঙ্গে আমার পরিচয় রাসেলের সূত্রে, ২০০১-০২ এর দিকে। তবে এই নাম আর গানের সঙ্গে পরিচয় তো সেই নব্বই দশকে। এক জন্মদিনে ছোট আপা আমাকে অনেকগুলো ক্যাসেট গিফট করেছিল, তার একটা ছিল ‘বিবাগী রাত’।
পরিচয় পর্ব পরেই নিলয়’দার সঙ্গে আমার সখ্য হয়েছিল। মুগ্ধতার রেশ ছাপিয়ে আমরা দল বেঁধে চা খেতে গিয়েছিলাম মিরপুর-২ নাম্বারে। সনি সিনেমা হলের পেছনের গলিতে। সেদিনও নিলয়’দার কাঁধে গিটার ছিল। সম্ভবত বার ছিল বৃহস্পতি। গুলশানের নিলফাস হোটেলে ওই একদিন গান গাইতো দাদা।
আমি তখন 'নিদারুণ' দিন কাটাচ্ছি। বছর দুয়েক। গান লিখে জীবনযাপনের এক অসম্ভব ঘোরের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছি। সেই সময়ে নিলয়’দার সঙ্গে গানে গানে আড্ডা শুরু। দাদারও খুব অনুকূল সময় ছিল না তখন। কিন্তু মানুষটাকে জোয়ার-ভাটা নিয়ে কখনই চিন্তিত দেখিনি। দেখা হলেই মুখ ভর্তি হাসি। তারপর বেরিয়ে পড়া।
বছর দুয়েক পর আমি সিঙ্গাপুর চলে যাই। বোহেমিয়ান জীবনে একটা নতুন বাঁক। সেই বাঁক ধরে ছুটিতে ফিরে আসি ঢাকায়। নিলয়’দা, আমি, রিকো মিলে রাজশাহী ঘুরতে যাই। রাসেল কী এক কারণে মিস করে যায় সেই আনন্দ সফর। রাজশাহী উপ-শহরে রিকোর বাসায় উঠে সারা রাত আড্ডা। আমি আর নিলয়’দা। আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ গিটার হাতে নিলয়’দার টুংটাং।
এমন না যে সামনা-সামনি নিলয়’দার গিটার বাজানো দেখিনি। কিন্তু রাজশাহীর সেই আড্ডা রাতে নিলয়’দার গিটার প্লেইং শুনে আমার অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল সারা ঘর জুড়ে একাধিক গিটার বাজছে। সত্যি সত্যি এ রকম মনে হয়েছিল!
এ রকম অন্যকিছু ঘটেছিল বলেই সেই ধুনের ওপর গান লিখতে বলার কথাও মনে আছে বিলক্ষণ। আজ এত বছর পরেও সেই গিটার প্রগ্রেশনটা মাথায় ঘোরে। কিন্তু আর লেখা হয়নি। এই আক্ষেপটা মাঝে মাঝে আমাকে বিমর্ষ করে।
সিঙ্গাপুরে ফিরে কিছুদিন পরেই রাসেলের ফোন পেয়ে জানতে পারি নিলয়’দা নিখোঁজ হয়ে গেছেন। ঢাকায় ফিরলে আর নিলয়’দাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। না গিটারে, না হাসিতে, না মিরপুরের সেই চায়ের দোকানের আড্ডায়। কি তীব্র হাহাকার! কি সরল সত্য!
অনেক পরে ‘এই গানটা’ নামে একটা লিরিকে দাদাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম-
“চায়ের কাপে পুড়ছে যে ছাই
আঁধারের রঙে সুরগুলো চাই
গিটারের তারে আঙ্গুলের ছোঁয়ায়
তুমুল বিষাদ উঠতো
এই গানটা বিরহের গান হতে পারত
গিটারের তারে অলক্ষ্যে যদি
নিলয় দাস থাকতো...''
নিলয়’দা, আপনাকে মিস করি অনেক।
মনে পড়ে গেলে, এগারো জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি।