২০২০: চলে গেলেন যারা

মহামারীর বছরে চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতাঙ্গনে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিত্ব চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2020, 03:08 PM
Updated : 31 Dec 2020, 03:08 PM

আজাদ রহমান

আজাদ রহমানের সুর সাধনা থেমে যায় ১৬ মে; ৭৬ বছর বয়সে। হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী এই সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পীর।

বাংলাদেশে খেয়াল জনপ্রিয় করার পেছনে আজাদ রহমানের অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি বেশ কিছু দিন নজরুল ইনস্টিটিউটেও পড়িয়েছেন।

‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’র মতো কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানে সুরটি আজাদ রহমানই বেঁধেছেন। চলচ্চিত্রে অনেক গানের সুরস্রষ্টা হিসেবে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়ও।

‘ভালোবাসার মূল্য কত’, ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই’, ‘মনেরও রঙে রাঙাব’, ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’সহ অনেক গানে সুর দিয়েছেন তিনি।

আজাদ রহমানের জন্ম ১৯৪৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি কীর্তন, ধ্রুপদী সঙ্গীতের পাশাপাশি খেয়াল, টপ্পার চর্চা করেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন আজাদ রহমান।

১৯৬৩ সালে কলকাতার ‘মিস প্রিয়ংবদা’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে আজাদ রহমানের চলচ্চিত্রে আগমন। সেই চলচ্চিত্রে তার সুরে কণ্ঠ দেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখার্জি ও প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবুল চৌধুরীর ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রের গানে সুর দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে শুরু হয় আজাদ রহমানের পথ চলা।

হাসান ইমাম

নৃত্যশিল্পী, নৃত্যপরিচালক হাসান ইমাম ৬৭ বছর বয়সে ১৬ মে মারা যান। পরিবার জানায়, হৃদরোগে তার মৃত্যু হয়। করোনাভাইরাসে বোনের মৃত্যুর তিন দিন পর তার মৃত্যু ঘটে।

দেশের ‍নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে অগ্রগন্য হাসান ইমাম টেলিভিশন নৃত্যশিল্পী সংস্থার সাবেক সভাপতি; সুরঙ্গমা একাডেমি নামে একটা নাচের স্কুল পরিচালনা করতেন।

বিক্রমপুরে জন্ম নেওয়া হাসান ইমামের শৈশব-কৈশোর কেটেছে মগবাজারে; স্বাধীনতার পরপর বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে নৃত্যের উপর পড়াশোনা সম্পন্ন করে পেশাদার নৃত্যশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়েন। আশি ও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় এ নৃত্যশিল্পী পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ নৃত্য-নাটকে কাজ করে প্রশংসিত হয়েছেন; তার বিপরীতে ছিলেন নৃত্যশিল্পী জিনাত বরকতউল্লাহ।

আরেক নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপার সঙ্গে জুটি বেঁধে বেশকিছু নাটক করেছেন তিনি; পরবর্তীতে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে নিপার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর নাচ থেকে ক্রমান্বয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন হাসান ইমাম।

এন্ড্রু কিশোর

কয়েক দশক ধরে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে গানের জগতে আধিপত্য করে আসা এন্ডু কিশোরের জীবনের গল্প থেকে যায় ৬ জুলাই; ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ৬৪ বছর বয়সেই পৃথিবীকে বিদায় জানাতে হয় তাকে।

জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে, সবাই তো ভালবাসা চায়, ভালবেসে গেলাম শুধু, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে, পড়ে না চোখের পলক- তার এমন অনেক গান এখনও মানুষের মুখে ‍মুখে ফেরে।

এন্ড্রু কিশোরের জন্ম রাজশাহীতে, শৈশব ও কৈশোরও কাটান সেখানে। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিলে দেশে এসে রাজশাহীতেই ছিলেন, সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

এন্ড্রু কিশোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনায় পড়লেও গানই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। গানের নেশায় ছুটে আসেন রাজধানী ঢাকায়। চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালে; মেইল ট্রেন-এ আলম খানের সুরে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৯ সালে প্রতিজ্ঞা চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গান গাওয়ার পর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাকে। গান গেয়ে আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন তিনি।

বাংলাদেশে প্লেব্যাকে শীর্ষে থাকা অবস্থায় বলিউডের প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক রাহুল দেব বর্মনের ডাকও পেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর, কিন্তু ভারতে থিতু হতে চাননি তিনি।

আলাউদ্দিন আলী

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

ঢাকাই চলচ্চিত্রের বহু হৃদয়কাড়া গানের গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী সুরের ভুবন ছেড়ে চলে যান ৯ অগাস্ট। ৬৮ বছর বয়সী এই সুরস্রষ্টা ক্যান্সারের পাশাপাশি নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন।

একবার যদি কেউ ভালোবাসতো, যে ছিল দৃষ্টির সীমানায’, প্রথম বাংলাদেশ- আমার শেষ বাংলাদেশ, ভালোবাসা যতো বড়ো জীবন তত বড় নয়, দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়, হয় যদি বদনাম হোক আরো, আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টা’, সুখে থাকো ও আমার নন্দিনীসহ কালজয়ী অসংখ্য গানে পেছনের কারিগর আলাউদ্দিন আলী।

১৯৬৮ সালে বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন তিনি, আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে বেহালাবাদক হিসেবে। সেসব দিনে আনোয়ার পারভেজসহ প্রখ্যাত অনেক সুরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আলাউদ্দিন আলী। চলচ্চিত্রের সংগীতে বেহালা বাজাতে গিয়ে তার সংগীত পরিচালনার আগ্রহ তৈরি হয়।

১৯৭২ সালে দেশাত্মবোধক গান ‘ও আমার বাংলা মা’ গানের মাধ্যমে জীবনে প্রথম সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তার। গোলাপী এখন ট্রেনে চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৭৯ সালে, সুন্দরী সিনেমার জন্য ১৯৮০ সালে এবং কসাই ও যোগাযোগ চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৮৮ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। এছাড়া ১৯৮৫ সালে শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান আলাউদ্দিন আলী। খ্যাতিমান পরিচালক গৌতম ঘোষ পরিচালিত পদ্মা নদীর মাঝি চলচ্চিত্রেও তিনি সংগীত পরিচালনা করেছেন।

কে এস ফিরোজ

অভিনেতা কে এস ফিরোজ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৭৬ বছর বয়সে ৯ সেপ্টেম্বর মারা যান।

ঢাকার লালবাগে জন্ম নেওয়া খন্দকার শাহেদ উদ্দিন ফিরোজ অভিনয় করতে এসে কে এস ফিরোজ নামে পরিচিত হন। অভিনয়ে আসার আগে সেনাবাহিনীতে ছিলেন তিনি।

অভিনয় জীবনের শুরুর দিকে থিয়েটারের ‘কিং লেয়ার’ মঞ্চ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে পরিচিত পান তিনি। ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’, ‘রাক্ষসী’সহ আরও বেশ কয়েকটি মঞ্চ নাটকে দেখা গেছে তাকে।

তিনি মঞ্চ এবং ছোট ও বড় পর্দায় যুগপৎ অভিনয় করেছেন; নাট্যদল থিয়েটারের জ্যেষ্ঠ সদস্য ও সভাপতি ছিলেন। পাশাপাশি টিভি বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছেন তিনি।

সাদেক বাচ্চু

অভিনেতা সাদেক বাচ্চু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৬৬ বছর বয়সে ১৪ সেপ্টেম্বর মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।

ডাকবিভাগের সাবেক কর্মকর্তা সাদেক হোসেন বাচ্চু টেলিভিশনে অভিনয় করে নাম কুড়িয়ে ১৯৮৫ সাল চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। ‘রামের সুমতি’র মাধ্যমে যাত্রা শুরুর পর বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। খল চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে দর্শকদের কাছে পেয়েছেন আলাদা পরিচিতি।

২০১৮ সালে ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য খল চরিত্রে সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সাদেক বাচ্চু।

আলী যাকের

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

ক্যান্সারের সঙ্গে চার বছরেরও বেশি সময় লড়াই করে ২৭ নভেম্বর চির বিদায় নেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক আলী যাকের।

১৯৭২ সালের আরণ্যক নাট্যদলের ‘কবর’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু করেন এই নাট্যব্যক্তিত্ব। মঞ্চে নূরলদীন, গ্যালিলিও ও দেওয়ান গাজীর চরিত্রে আলী যাকেরের অভিনয় এখনও দর্শক মনে রেখেছে।

‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি পাথর’, ‘আজ রবিবার’এর টিভি নাটকে অভিনয় করেও তিনি জনপ্রিয়তা পান।

অভিনয়, নির্দেশনার বাইরে তিনি ছিলেন একজন নাট্যসংগঠক; পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন লেখালেখির সঙ্গে। নাটকে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি এশিয়াটিকের দায়িত্ব নেন, মৃত্যুর সময় তিনি কোম্পানির গ্রুপ চেয়ারম্যান ছিলেন।

মান্নান হীরা

নাট্যকার, নির্দেশক, চলচ্চিত্র নির্মাতা মান্নান হীরা ৫৫ বছর বয়সে ২৩ ডিসেম্বর মারা যান। তিনি হৃদরোগে ভুগছিলেন।

মান্নান হীরা বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি নাটকের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি আরণ্যক নাট্যদলের অধিকর্তা ছিলেন। মঞ্চ ও টিভির জন্য অসংখ্য নাটক লিখেছেন তিনি।

মান্নান হীরার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আছে ‘লাল জমিন’, ‘ভাগের মানুষ’, ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘সাদা-কালো’। ‘মূর্খ লোকের মূর্খ কথা’ মান্নান হীরা রচিত ও নির্দেশিত পথনাটক। ২০১৪ সালে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ নির্মাণ করেন তিনি, সেটাই তার প্রথম চলচ্চিত্র। ‘গরম ভাতের গল্প’ ও ‘৭১-এর রঙপেন্সিল’ নামে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মিত হয় মান্নান হীরার হাতে।

আবদুল কাদের

ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছিলেন, তার মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৬ ডিসেম্বর চিরবিদায় নেন অভিনেতা আবদুল কাদের। তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে সমান সক্রিয় আবদুল কাদেরকে বিপুল জনপ্রিয়তা দিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের টিভি সিরিজ ‘কোথাও কেউ নেই‘র বদি চরিত্রটি।

ডিসেম্বরের শুরুতে শারীরিক নানা জটিলতা দেখা দিলে কাদের ভারতে যান চিকিৎসার জন্য। সেখানে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। আর তা এখন নিরাময়ের বাইরে বলে জানিয়ে দেন চিকিৎসকরা। দেশে ফিরে আসার পর হাসপাতালে ভর্তি হলে ধরা পড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ।

কাদের অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে শুরুতে অধ্যাপনায় যোগ দলেও পরে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করার পাশাপাশি নাটক নিয়েই মেতে ছিলেন। তার অভিনীত মঞ্চনাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই, স্পর্ধা’, ‘দুই বোন’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’। তিন হাজারের মতো টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। ২০০৪ সালে তিনি ‘রং নাম্বার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের কাজও করেছেন তিনি।

এছাড়াও ২০২০ সালে মারা গেছেন বিটিভির সাবেক প্রযোজক দুই প্রযোজক মোস্তফা কামাল সৈয়দ, মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ, অডিও প্রযোজক সেলিম খান, নির্দেশক-অভিনয়শিল্পী ইশরাত নিশাত, চলচ্চিত্র প্রযোজক মতিউর রহমান পানু, শিল্প নির্দেশক ও পরিচালক মহীউদ্দিন ফারুক,  চলচ্চিত্র অভিনেতা রানা হামিদ, ফ্যাশন মডেল লরেন মেন্ডেস, অভিনেতা মহিউদ্দিন বাহার, প্রযোজক নাসির উদ্দিন দিলু।