চলচ্চিত্র: লোকসানের বছরে আলোচনায় এফডিসির ‘কলহ’

মহামারীর ফাঁদে ‘এক হাজার কোটি টাকার’ লোকসানের বছরে চলচ্চিত্রকে ছাপিয়ে প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পী সমিতির মতবিরোধের জেরে নির্মাতা-শিল্পীদের বয়কট নিয়ে উত্তপ্ত ছিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2020, 05:44 AM
Updated : 31 Dec 2020, 09:47 AM

সাত মাস সিনেমা হল বন্ধ থাকায় মধ্যে ২০২০ সালে মুক্তি পেয়েছে মাত্র ১৬টি চলচ্চিত্র; যা স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে কম।

বড় আয়োজনের ছবি মুক্তি না পাওয়ায় মহামারীর বছরে ‘এক হাজার কোটি টাকা’ লোকসান হয়েছে বলে দাবি করছেন প্রযোজকরা। মুক্তিপ্রাপ্ত কোনও ছবিই বিনিয়োগের অর্থ তুলতে পারেনি। বেশিরভাগ ছবিই মুক্তি পেয়েছে নামমাত্র হলে; সপ্তাহ পেরোনোর আগেই সেগুলো নামিয়েও ফেলা হয়েছে।

চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে স্মরণকালের মন্দার বছরে ছবি নিয়ে চর্চা কমই হয়েছে; তবে সংগঠনগুলোর মধ্যে দলাদলির চর্চায় বছরজুড়ে শিরোনামে ছিল এফডিসি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে সব সিনেমা হল বন্ধ রেখে এফডিসিতে একের পর এক ‘কলহে’ জড়িয়ে আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি।

খোরশেদ আলম খসরু ও শামসুল আলমের নেতৃত্বাধীন প্রযোজক সমিতির সঙ্গে মিশা সওদাগর ও জায়েদ খানের নেত্বত্বাধীন শিল্পী সমিতির মতবিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে।

শিল্পী সমিতির বার্ষিক বনভোজনে প্রযোজক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলমকে (তিনি শিল্পী সমিতিরও সদস্য) আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি ‘অংশ না নেওয়ায়’ তার শিল্পী সমিতির সদস্যপদ বাতিল করেন মিশা-জায়েদ খানরা।

পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন দাবি করেছিলেন, বনভোজনে চাঁদা হিসেবে ‘একটি গরু না দেওয়ায়’ শামসুলের সদস্যপদ বাতিল করেছে শিল্পী সমিতি।

তবে অভিযোগ উড়িয়ে মিশা সওদাগর বলেছেন, সাংগঠনিক কারণে শিল্পী সমিতি থেকে শামসুল সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সেই ঘটনার জেরে ‍মুখোমুখি অবস্থান নেয় শিল্পী সমিতি ও প্রযোজক সমিতি।

দুই সমিতির বচসার মধ্যেই মার্চে করোনাভাইরাসের হানায় সমিতির কার্যক্রম স্থগিত রেখে ‘ঘরবন্দি’ হয়েছিলেন নেতারা।

চার মাসের ব্যবধানে জুলাইয়ে করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যেই উত্তাপ ছড়িয়েছে প্রযোজক সমিতি ও শিল্পী সমিতি।

এবার ‘সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ তুলে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানকে (তিনি প্রযোজক সমিতির সদস্য) বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি থেকে বহিষ্কার করেন খোরশেদ আলম খসরু ও শামসুল আলমরা।

পরে সংবাদ সম্মেলন ডেকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিসহ চলচ্চিত্রের ১৮ সংগঠন জোট বেঁধে জায়েদ খানের সঙ্গে শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগরকেও বয়কট করা হয়। 

প্রযোজক সমিতির সঙ্গে শিল্পী সমিতির বয়কট, পাল্টা বয়কটের চলচ্চিত্রে মুশফিকুর রহমান গুলজার ও বদিউল আলম খোকনের নেতৃত্বাধীন পরিচালক সমিতির ‘এন্ট্রি’ ঘটে তারও আগে; ২০১৯ সালের অক্টোবরে।

চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যয় কমিয়ে আনতে শিল্পীদের গাড়িচালক, সহকারী, ব্যক্তিগত মেকআপম্যানকে ২ হাজার টাকার ‘কনভেন্স’ দেওয়ার নিয়ম বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল ১৮ সংগঠনের জোট।

নীতিমালা বাকি সংগঠন মেনে নিলেও মিশা সওদাগর ও জায়েদ খান এর বিরোধিতা করে শিল্পীদের ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েছিলেন বলে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ তোলা হয়।

নীতিমালা নিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে এফডিসিতে মিশা সওদাগরের সঙ্গে নীতিমালা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব ও পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকনের বিতণ্ডার ঘটনায় শিল্পী সমিতির সঙ্গে পরিচালক সমিতির মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসে।

সেই দিনের ঘটনার বর্ণনায় মিশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “খোকনের সঙ্গে সেদিন আমার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমরা দুইজন ভালো বন্ধু। এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। বিষয়টি বেশ আগেই সমাধান হয়ে গেছে।”

কিন্তু এটিকে ‘ব্যক্তিগত ব্যাপার’ বলতে নারাজ ছিলেন পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার।

তিনি বলেছিলেন, “নীতিমালা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে খোকন কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে মিশাকে বিষয়টি বুঝাতে গিয়েছিলেন কিন্তু মিশা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। এটা ব্যক্তিগত বিষয় না।”

ঘটনার পরপরই ১৮ সংগঠনের তরফ থেকে মিশাকে কারণ দর্শানো নোটিস পাঠানো হয়; মিশা সেটিকে ‘অতি উৎসাহী’ কাজ বলে অভিহিত করেছিলেন।

নোটিস পাওয়ার কথা স্বীকার করে মিশা বলেছিলেন, শুটিংয়ে কাজে বাইরে ছিলেন। চিঠিটি খুলে দেখতে পারেনি; ফলে উত্তর দেওয়া হয়নি।

বিষয়টির নিষ্পত্তির আগে সেই ঘটনার জেরে পরিচালক খোকনকেই শিল্পী সমিতি থেকে বয়কটের ঘোষণা দেন মিশা-জায়েদ খানরা।

শিল্পী সমিতি থেকে জানানো হয়, খোকনের চলচ্চিত্রে সমিতির কোনো সদস্য কাজ করবেন না। কয়েক মাসের মাথায় খোকনের উপর থেকেই সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও দুই সমিতির মধ্যে দূরত্ব আর ঘোচেনি।

অন্যদিকে, শিল্পী সমিতির সঙ্গে প্রযোজক সমিতির ‘ইঁদুর-বিড়াল’ খেলা এখনও চলছে; ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ঘটনা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

প্রযোজক সমিতির নেতৃত্বে ১৮ সংগঠন যখন বলছিল, তারা জায়েদ খানের সঙ্গে কোনও চলচ্চিত্রে কাজ করবেন না; এবার জায়েদ খান প্রযোজক সমিতির বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে অভিযোগ ঠুকে এলেন।

জায়েদের অভিযোগ আমলে নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তে খসরু-শামসুলের নেতৃত্বাধীন প্রযোজক সমিতির নির্বাচনে অনিয়মের প্রমাণ মেলায় প্রযোজক সমিতির ২০১৯-২০২১ মেয়াদের কার্যনির্বাহী কমিটি বাতিল করে।

একজন উপসচিবকে প্রযোজক সমিতির প্রশাসককের দায়িত্বে বসায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে জায়েদ খানের সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্ত বাতিল করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন খোরশেদ আলম খসরু।

৭ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের এক আদেশে প্রযোজক সমিতির কমিটি বাতিল ঘোষণা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তটি ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ বিষয়ে রুল জারি করা হয়েছে।

২০২০ সালের ‘কলহের’ ধারাবাহিকতা ২০২১ সালের জারি রাখতে বছরের শুরুতেই পরিচালক অনন্য মামুনকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন জানান, ২ জানুয়ারি পরিচালক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে পরিচালক মামুনকে বহিষ্কারের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়েছে।

কারও হাতে কাজ নাই, তাই কলহ করে: মতিন রহমান

এফডিসিতে যখন কাজ ছিল তখন এমন কলহ হয়নি জানিয়ে চলচ্চিত্র গবেষক ও পরিচালক মতিন রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এখন ইন্ডাস্ট্রির কারও হাতে কোনও কাজ বলে তাই তারা কলহ করছেন।

“কাজ থাকলে কলহ হয় না। যখন কাজ থাকে না তখন কলহ শুরু হয়। এই ইন্ডাস্ট্রি তো আজকের না; চল্লিশ বছরের ইন্ডাস্ট্রিতে এতো কথা কখনোই আমরা শুনিনি। এখন কারও হাতেই কাজ নাই, কাজ নাই তো কলহ করো।

“যারা এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করেছে বা তৈরি করে রেখেছে তারা কখনোই প্রশংসার যোগ্য কাজ করেনি। এগুলো চলচ্চিত্রের গতিপথকে রুদ্ধ করে দেয়।”