কাদের যে মঞ্চ নাটকের দলে অভিনয় করতেন, সেই ‘থিয়েটার’-এর সভাপতি ফেরদৌসী মজুমদারের মতে, এ রকম গুণী অভিনেতা হয়ত আর আসবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ার সময় থেকেই নাট্যচর্চায় যুক্ত ছিলেন আবদুল কাদের। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার সাথে একসঙ্গে কাজ করেছেন ঢাকা থিয়েটারের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।
তার মতে, আবদুল কাদেরের মতো সুশৃঙ্খল অভিনেতা ‘মঞ্চে বিরল’।
মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে সমান সক্রিয় আবদুল কাদেরকে বিপুল জনপ্রিয়তা দিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের টিভি সিরিজ ‘কোথাও কেউ নেই’র বদি চরিত্র।
ক্যান্সারের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।
হাসপাতাল থেকে আবদুল কাদেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর ডিওএইচএসের বাসায়। মিরপুর ডিওএইচএস জামে মসজিদে জানাজা শেষে বিকাল ৩টার দিকে মরদেহ আনা হয় শিল্পকলা একাডেমিতে।
শ্রদ্ধা নিবেদন শুরুর আগে অভিনেতা আবদুল কাদেরের স্ত্রী খাইরুন্নেছা কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছেলে-মেয়ের প্রতি ভীষণ অন্তঃপ্রাণ ছিলেন তিনি। শেষ কথায় তিনি বলেছিলেন, আমি তো আমার পরিবারের প্রতি শেষ দায়িত্বটুকু পালন করে যেতে পারলাম না। আমার কত কাজ বাকি থেকে গেল!
“অভিনয় জীবন, চাকরি জীবনের বাইরে তিনি তার পরিবারকে কতটা গুরুত্ব দিতেন, সে তো আমি জানি। সবাই দোয়া করবেন তার জন্য।”
ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা আবদুল কাদের। তার হাত ধরেই অভিনয়ে এসেছে নাতনি সিমরিন লুবাবা।
১৯৫১ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ী থানার সোনারং গ্রামে জন্ম নেওয়া কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর সিঙ্গাইর কলেজ ও লৌহজং কলেজে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। পরে বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন। বিটপী ছেড়ে পরে তিনি বাটায় যোগ দেন ১৯৭৯ সালে; সেখানে ছিলেন ৩৫ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে নাট্যচর্চায় জড়িয়ে পড়া আবদুল কাদের শুরুতে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা থিয়েটারে, এর প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ জানান, আশির দশকে যখন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠিত হয়নি, তখন বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনেও অগ্রণী এক সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন আবদুল কাদের।
বাটার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা হিসেবে কাদের মঞ্চনাটকের দলগুলোর বিজ্ঞাপনও কীভাবে এনে দিতেন, সেই কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, “অভিনেতা হিসেবে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন আবদুল কাদের। বহুমাত্রিক এ অভিনেতা ছিলেন দারুণ এক নাট্য সংগঠক।”
১৯৭৩ সাল থেকে থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য এবং চার বছর যুগ্ম-সম্পাদকের ও ছয় বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আবদুল কাদের। পরে তিনি থিয়েটারের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তার অভিনীত মঞ্চনাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই, স্পর্ধা’, ‘দুই বোন’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’।
এছাড়া দেশের বাইরে জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা, দিল্লি, দুবাইয়ের মঞ্চেও তিনি বাংলা নাটকে অভিনয় করেছেন আবদুল কাদের।
আবদুল কাদের বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাট্যশিল্পী ও নাট্যকারদের একমাত্র সংগঠন টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদের (টেনাশিনাস) সহ-সভাপতি ছিলেন।
আবদুল কাদের অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘মাটির কোলে’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘শীর্ষবিন্দু’, ‘সবুজ সাথী’, ‘তিন টেক্কা’, ‘যুবরাজ’, ‘আগুন লাগা সন্ধ্যা’, ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’, ‘আমার দেশের লাগি’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘দীঘল গায়ের কন্যা’, ‘ভালমন্দ মানুষেরা’, ‘দূরের আকাশ’, ‘ফুটানী বাবুরা’, ‘এক জনমে’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘ফাঁপড়’, ‘চারবিবি’, ‘সুন্দরপুর কতদূর’, ‘ভালোবাসার ডাক্তার’, ‘চোরাগলি’, ‘বয়রা পরিবার’ ইত্যাদি।
দীর্ঘ অভিনয় জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে টেনাশিনাস পদক, মহানগরী সাংস্কৃতিক ফোরাম পদক, অগ্রগামী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পদক, যাদুকর পি.সি. সরকার পদক, টেলিভিশন দর্শক ফোরাম অ্যাওয়ার্ড, মহানগরী অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু পদকও পেয়েছেন আবদুল কাদের।
তাকে নিয়ে থিয়েটার-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, “থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেছে কাদের। তার মতো ধীমান অভিনেতা বাংলা নাটকে খুব কম।
“কাদের যখন চেন্নাই হাসপাতালে, তখন সে ভিডিওকলে আমাকে বলত, সে কখন দেশে ফিরবে। সে চেয়েছিল দেশের মাটিতেই তার মৃত্যু হোক। সবার সঙ্গে কথা বলে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। বাঁচার আকুতি ছিল তীব্র।”
বিকালে বনানী কবরস্থানে আবদুল কাদেরকে তার মায়ের কবরে সমাহিত করা হয়েছে বলে স্ত্রী জানিয়েছেন।