চিরসবুজ দেব আনন্দ

দেব আনন্দ বা দেবানন্দ- যেভাবেই বলা হোক। তার অভিনয় অমর হয়ে থাকবে।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2020, 03:25 PM
Updated : 4 Dec 2020, 03:25 PM

দেব আনন্দ বা দেবানন্দ- যেভাবেই বলা হোক। তার অভিনয় অমর হয়ে থাকবে।

৩ ডিসেম্বর ছিল তার পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার দিন। তাকে নিয়ে বিশেষ এই প্রতিবেদন লিখেছেন আরাফাত শান্ত।

সব সময় পরিপাটি থাকা একজন অভিনেতা হিসেবে দারুণ সুনাম রয়েছে দেব আনন্দের। তাকে বলা হয়ে থাকে ‘চিরসবুজ এক রোমান্টিক তারকা’।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি তিনি। পেয়েছেন ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব। এছাড়াও তাকে ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার দেওয়া হয়।

এসবের পাশাপাশি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, আইফাসহ ভারতের বড় বড় সম্মাননা তার ঘরের শেলফে থরে থরে সাজানো।

২০১১ সালের ৩রা ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নেন তিনি।

কিংবদন্তি এ অভিনেতা ‘হাম এক হ্যায়’ ছবির মাধ্যমে ১৯৪৬ সালে তার অভিনয় জীবন শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ‘জিদ্দি’ ছবি মুক্তি লাভের পর তিনি সুপারস্টার খ্যাতি অর্জন করেন।

এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ৬৫ বছরের অভিনয় জীবনে তার প্রাপ্তি ছিল অনেক।

একাধারে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ অভিনেতা, সফল পরিচালক ও দক্ষ প্রযোজক। অভিনেতা হিসেবে তার ঝুলিতে জমা রয়েছে শতাধিক ছবি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বার্ধক্য তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

দেব আনন্দ তার ‘গাইড’, ‘হাম দোনো’, ‘তেরে ঘার কে সামনে’, ‘গ্যাম্বলার’ এবং ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ ছবি দিয়ে অসংখ্য পুরস্কারসহ কোটি কোটি ভক্তের হৃদয় জিতে নেন।

তাকে সর্বশেষ রুপালি পর্দায় দেখা যায় ২০১১ সালের অক্টোবরে মুক্তি পাওয়া তার পরিচালিত ও প্রযোজিত শেষ ছবি ‘চার্জশিট’য়ে।

১৯২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন গুরুদাসপুরে (বর্তমান পাকিস্তানের নারোওয়াল জেলায়) জন্মগ্রহণ করেন দেব আনন্দ। তার বাবা পিশোরি লাল আনন্দ অবিভক্ত ভারতের এক স্বনামধন্য আইনজীবী ছিলেন।

দেব আনন্দ ছিলেন পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। তারা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোন। দেবের বড় ভাই চেতন আনন্দ এবং ছোট ভাই বিজয় আনন্দও হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের চেনামুখ ছিলেন।

তাদের বোন শীলা কান্তা কাপুরেরও বিয়ে হয় একটি চলচ্চিত্রপ্রেমী পরিবারে।

দেব আনন্দের বোনের ছেলে অর্থাৎ তার ভাগ্নে শেখর কাপুরও ভারতের চলচ্চিত্র জগতের পরিচিত বড় নাম। তবে এ পরিবারের সবচেয়ে সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেব আনন্দই এগিয়ে।

শুধু পরিবারেই নয় বলিউড ইতিহাসেও তিনি চিরভাস্বর এবং আধুনিক চলচ্চিত্রের অগ্রদূত বলে বিবেচিত।

দেব আনন্দ অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু ছবির মধ্যে রয়েছে- জিদ্দি, গাইড, হাম দোনো, তেরে ঘর কি সামনে, গ্যাম্বলার, বোম্বাইকা বাবু, কালা বাজার, প্রেম পূজারি, তিন দেবী, জনি মেরা নাম, জুয়েল থিফ, হরে রাম হরে কৃষ্ণ ও সোলবা সাল।

দেব আনন্দ আর শচীন কর্তার জুটি প্রথম থেকেই সুপারহিট|

দেব আনন্দ পরিচালনায় আসার পর 'হরে রাম হরে কৃষ্ণ' বানাবেন বলে ঠিক করলেন| সুর দেওয়ার জন্য ডাক পড়ল শচীন কর্তা আর পঞ্চমের। চিত্রনাট্য শোনার পর দু'জনে দু'জনের মতো করে সুর শোনালেন। পঞ্চমের গান বেশি পছন্দ হল দেবের।

তিনি শচীন কর্তাকে খুব নরম গলায় বললেন, “এই ছবিতে পঞ্চমের সুর বেশি ভালো মানাবে। তাহলে পঞ্চম সুর দিক।”

হাসিমুখে সম্মতি দিলেন শচীন কর্তা। ছেলের উন্নতি দেখলে কোন বাবা না খুশি হয়?

আগ্রহ নিয়ে একদিন রেকর্ডিং রুমে ছেলের সুর-ও শুনতে এলেন। পঞ্চম সেদিন ‘দম মারো দম’ গান তোলাচ্ছিলেন আশা ভোশলেকে। দু লাইন শোনার পরেই রাগে মুখ লাল এস.ডি বর্মনের।

চেঁচিয়ে উঠে পঞ্চমকে বললেন, “আমি এই গান তরে শিখাইছি? মাঠের গান ভুলে, বাংলার গান ভুলে, তুই ইংরিজি গানের নকল কইরা সুর করস! আমার সব শিক্ষা বৃথা গেল। তুই আমার কুলাঙ্গার ছেলে।”

আমার ছোট ভাই বোনরা প্রশ্ন রাখে, আপনি রেট্রো বলিউডের প্রেমে পড়লেন কেন?

উত্তর জানানো হয় না। উত্তর মে বি- দেব আনন্দ। দেব আনন্দ না থাকলে পুরানো দিনের সিনেমা ভালো লাগার কিছু সীমিত হয়ে যায়। দেব আনন্দ আসলে কে?

দেব আনন্দ হল একজন আন্ডারডগের মহীরুহ হওয়ার গল্প। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, পড়াশোনা করেছেন সাধারণ বিএ পাশ, চাকরি করেছেন ৮৫ টাকা বেতনের ক্লার্কের।

কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন অভিনয় করবেন, অনেক চেষ্টায় পেয়ে যান কাজ। তারপর তিনি জীবন পার করেছেন তার ইচ্ছামাফিক।

প্রথম সিনেমার টাকাতেই কিনেছেন গাড়ি। স্বপ্ন দেখতেন, অনেক কিছুই পূরণ হয়নি।

যেমন চেয়েছিলেন নায়িকা সুরাইয়াকে বিয়ে করতে। ৩ হাজার টাকার ডায়মন্ডের রিং দিয়ে প্রপোজ করেছিলেন, সিনেমার সেটে জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন, কিন্তু পারিবারিক চাপে সুরাইয়ার আর বিয়ে করা হয়নি দেব আনন্দকে। অবিবাহিত ছিলেন সারাজীবন।

কল্পনা কার্তিককে নিয়ে দেব আনন্দের ছিল সুখের দাম্পত্য জীবন। সিনেমা করেছেন শ’ খানেকের ওপর। তার লিপে গান মানেই হিট।

মিথ আছে কালো স্যুট গায়ে চাপিয়ে বের হতেন না, কারণ কালো স্যুটে বের হলেই ফ্যানরা সব পাগল হয়ে যেত, রাস্তায় হবে অজস্র ‘সিনক্রিয়েট’।

অসংখ্য লোককে তিনি সিনেমায় চান্স দিয়েছেন। তার প্রোডাকশন হাউজ থেকে বের হয়েছে ৩৫টি সিনেমা। ইয়াশ জোহরের মতো লোকেরা কাজ করতো তার সঙ্গে।

আমার গুরু দত্ত-দেব আনন্দ কম্বিনেশন খুব ভালো লাগে। অসময়ে সুইসাইড না করলে আরও ভালো কিছু হতে পারতো এই জুটির।

আমার প্রিয় সিনেমা দেব আনন্দের অবশ্যই – ‘গাইড’, ‘বাজী’, ‘তেরে মেরে স্বপ্নে’, ‘তিন দেবিয়া’।

সব সিনেমা দেখা হয় না। তবে তার প্রিন্টেড হ্যাট কিংবা মাঙ্কি টুপি পরিহিত গান কোথাও দেখলেই থামি কিছুক্ষণ। দেব আনন্দকে নিয়ে মিমিক্রি হয় প্রচুর, মরে গিয়েও তিনি কিছু কমেডিয়ানের করে কেটে খাওয়ার ব্যবস্থা করে গেছেন।

প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা।