তার মতো শিল্পীর মৃত্যু হয় না: ববিতা

পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে পরম শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করেছেন তার সহশিল্পী বাংলাদেশের অভিনেত্রী ফরিদা আক্তার ববিতা; বলছেন, তার মতো শিল্পীর মৃত্যু হয় না; দর্শকদের হৃদয়ে তিনি চিরকাল ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Nov 2020, 09:15 AM
Updated : 15 Nov 2020, 02:33 PM

১৯৭৩ সালে কিংবদন্তি নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অনঙ্গ বউ’ চরিত্রে অভিনয় করে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পরিচিতি লাভ করেন সেই সময়ের ষোড়শী নায়িকা ববিতা।

১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত বৃহত্তর বাংলার চিত্র তুলে ধরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে গঙ্গাচরণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র।

রোববার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে স্মৃতিচারণে ‘অশনি সংকেত’র সেই শুটিংয়ের দিনে ফিরে গেলেন ববিতা।

“ছবির প্রথম শট সৌমিত্র দা’র সঙ্গে ছিল। গোল ফ্রেমের চশমা, ধুতি পরে গঙ্গাচরণের গেটআপে তাকে অপূর্ব লাগছিল। আমি খুব ভয়ে ছিলাম, একে তো বিদেশ তার উপর তার মতো জাঁদরেল শিল্পীর সঙ্গে কাজ করছি। পারব কি পারব না সেটা নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছিলাম।”

‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় ববিতার বয়স ছিল ১৬ বছর। তার আগে ১৯৬৮ সালে নির্মাতা জহির রায়হানের ‘সংসার’ চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে ববিতার। জহির রায়হানের ‘জ্বলতে সুরুজ কি নিচে’ ও ‘শেষ পর্যন্ত’ চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করলেও ‘অশনি সংকেত’ মুক্তির পর তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায়।

১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’ দিয়ে উপমহাদেশে খ্যাতি পাওয়া অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ততদিনে ‘তারকা’ হয়ে উঠেছেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগেই তাকে নিয়ে পড়াশোনার চেষ্টা করেছেন ববিতা। ‘অপুর সংসার’ ছবিটি দেখে তার মতো শিল্পীর সঙ্গে কাজ নিয়ে ভয় ও চাপ আরও বেড়ে গিয়েছিল তার।

তবে শুটিং শুরুর পর ভয় কেটে সৌমিত্রর সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক তৈরির ঘটনা তুলে আনলেন ববিতা, “কাজ শুরুর পর বুঝেছি, সৌমিত্র দা কী যে ভালো মানুষ! অল্প সময়েই খুব আপন করে নিয়েছিলেন আমাকে। নবীন অভিনেত্রী হিসেবে সেটে তার কাছ থেকে পরামর্শ পেয়েছি। বন্ধুর মতো মিশেছেন আমার সঙ্গে।

শুটিংয়ের অবসরে কাগজে নানা ধরনের গেম খেলতাম আমরা। অবসরে দারুণ আবৃত্তিও করতেন তিনি।”

১৯৭৩ সালে ছবিটি জার্মানীর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কার পাওয়ার পর দেশের গণ্ডি পরিয়ে বিদেশেও আলোচনায় আসে ছবিটি। নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সৌমিত্র ও ববিতাও যোগ দিয়েছিলেন উৎসবে।

ছবিটি সাফল্য পাওয়ার পর ঢাকায় ফিরে একের পর এক চলচ্চিত্রে ডাক পেতে থাকেন ববিতা; সত্তরের দশকেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ নায়িকা হয়ে উঠেন তিনি।

আলাদা ইন্ডাস্ট্রিতে দু’জনের ব্যস্ততার মধ্যে একসঙ্গে আর কাজ করা না হলেও ‘অশনি সংকেত’র মধ্য দিয়ে যে মেলবন্ধন তৈরি হয়েছিল তা অটুট ছিল।

“যখনই কলকাতায় গিয়েছি তখনই তাকে ফোনে ধরেছি, দাদা কেমন আছেন? দেখা করেছি। দেখা হলেই উনি বলতেন, ‘তুমি নাকি অনেক বিখ্যাত হয়ে গেছে বাংলাদেশে। অনেক ছবি করছ। পুরস্কার পাচ্ছো। ‘অশনি সংকেত’র সময় বুঝতে পেরেছি। তুমি অনেক বড় শিল্পী হবে’। এই কথাগুলো ওনার মুখে শুনে আমার কী যে ভালো লাগত।”

ঢাকায়ও দেখা মিলেছে গঙ্গাচরণ-অনঙ্গ বউয়ের; কয়েক বছর আগে তাদের দুজনের গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকার এক অনুষ্ঠানে।

“অনুষ্ঠানের দরজা দিয়ে ঢুকে সৌমিত্র দা’কে বাচ্চা মেয়ের মতো জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘দাদা, আপনি কেমন আছেন, কতদিন দেখি না আপনাকে।’ তার সঙ্গে দেখা হোক না না হোক,  তিনি আমার হৃদয়ে ছিলেন, আছেন ও সবসময়ই থাকবেন। বিষয়টি সেইদিন অনুভব করেছিলাম।”

ফেলুদা ও অপু চরিত্রে সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন সৌমিত্র চট্টেপাধ্যায়। সত্যজিতের ৩৪টি সিনেমার ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন সৌমিত্র।

সত্যজিতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেশ শক্ত হলেও মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেনদের চলচ্চিতেও সৌমিত্র নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন অভিনয়গুণে।

সাত পাকে বাঁধা, চারুলতা, বাক্স বদল, আকাশ কুসুম, মণিহার, কাঁচ কাটা হীরে, ঝিন্দের বন্ধী, অরণ্যের দিনরাত্রি, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, আবার অরণ্যের মত সিনেমার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন দর্শকের হৃদয়ে।

ববিতা বললেন, “সৌমিত্র দা বাংলা ছবির অভিভাবক, বিরাট বটবৃক্ষ। যার তলায় বর্তমান বাংলা ছবির জগৎ বিরাজ করছিল।“

কলকাতার বেল ভিউ ক্লিনিকে ৪০ দিন ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি; রোববার দুপুরে মৃত্যু হয়েছে তার।

তার মৃত্যুর খবরে শোকাতুর ববিতা বললেন, “গত একটি মাস ধরে আমি এতো উদ্বিগ্ন, চিন্তিত ছিলাম। এই বুঝি সৌমিত্র দা’ ভালো হয়ে যাবেন। কিন্তু শেষমেষ সেটা আর হলো না।

“তার মতো শিল্পীর মৃত্যু হয় না। তার জন্য শান্তি কামনা করছি। তিনি চিরকাল আমাদের হৃদয়ে ছিলেন, আছেন ও থাকবেন।”