শন কনেরি: এক নক্ষত্রের জ্বলে ওঠার গল্প

অনেকের কাছেই শন কনেরি মানে, ‘জেমস বন্ড’ যার রয়েছে ‘লাইসেন্স টু কিল’।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2020, 07:03 PM
Updated : 1 Nov 2020, 09:45 AM

অথচ এই ‘জেমস বন্ড’ এর জন্য কখনও কোনো অস্কার জয় করেননি কনেরি।

ইংরেজি ছবি মানেই যেন হলিউড। তবে শন কনেরিকে সেই ধারায় ফেললে হবে একদমই ভুল। স্কটিশ অভিনেতা স্যার শন কনেরি ঘুমের মধ্যে নিভৃতে চলে গেলেও তার জীবন ছিল যথেষ্ট সরব আড়ম্বরপূর্ণ।

রূপালি পর্দায় ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের জেমস বন্ড চরিত্রের প্রথম রূপকার শন কনেরি মানেই যেন- চিতার মতো তীব্র গতি, শত্রু মোকাবেলায় ওস্তাদ, দ্রুত গতির আধুনিক প্রযুক্তির গাড়ি, ওয়ালথার পিপিকে পিস্তল, ঘিরে থাকা সুন্দরী রমণী আর সুরার পাত্রে ভদকা মার্টিনি।

তবে রুপালি পর্দা আর বাস্তব জীবন তো এক নয়। কনেরির জীবনও সেই সূত্রে গাঁথা।

‘মর্যাদাহীন’ অতীত

১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শন কনেরির পূর্বপুরুষরা আয়ারল্যান্ড থেকে এসে স্কটল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন।

স্কটল্যান্ড, এডিনবরা ফাউন্টেইন ব্রিজ এলাকায় ১৯৩০ সালের ২৫ অগাস্ট জন্ম নেওয়া টমাস শন কনেরির নাম রাখা হয় দাদার নামানুসারে। তার মা ইফেমিয়া ম্যাকবেইন ম্যাকলেইন সাফসুতরোর কাজ করতেন আর বাবা জোসেফ কনেরি ছিলেন কারখানার শ্রমিক ও ট্রাক ড্রাইভার।

ছোটবেলায় শন কনেরির নাম ছিল টমি কনেরি। বলতে গেলে ঘিঞ্জি পরিবেশে একটা মাত্র ঘরের বাড়িতে বড় হয়েছেন তিনি। শীত প্রধান দেশ হলেও ছিল না গরম পানির কোনো ব্যবস্থা। আর ছিল একটা মাত্র শৌচাগার, যা সেই এলাকার মানুষ জনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হত।

১৩ বছর বয়সেই স্কুলে ইস্তফা দিয়ে কাজে নেমে পড়েন কনেরি । বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি, কফিন পালিশ, ইটের কারখানায় কাজ করেছেন। তারপর যোগ দেন ‘রয়াল নেভি’তে। তবে সেখানেও তার ভাগ্য খারাপ। পাকস্থলীর আলসার ধরা পড়ায় বাদ পড়েন বাহিনী থেকে।

এডিনবরায় কনেরি ‘শক্ত মানুষ’ হিসেবে পরিচিত। কারণ জেমস বন্ডের মতোই তরুণ বয়সে বাস্তবেও তিনি খারাপ মানুষদের সঙ্গে লড়েছেন। বিনা কারণে নয়, ছয় গ্যাং মেম্বার তার পরনের কোট খুলে নিতে চাইলে তিনি বাধা দেন। পরে তাকে অনুসরণ করতে থাকলে তিনি একজনকে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন আর এভাবেই হয়ত ভবিষ্যতের জেমস বন্ডের গোড়াপত্তনটা তার মধ্যে হয়েছিল।

ট্রাক চালানো, লাইফগার্ডের চাকরি ছাড়াও এডিনবরা কলেজ অফ আর্টে মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। বাকি সময়টা কাটাতেন শরীর গঠন করে।

সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না

কোনো নারীর ক্ষেত্রে এই বাক্য ব্যবহার করা যেতেই পারে। তবে শন কনেরির ক্ষেত্রে এরকম ভাবেই ভাব প্রকাশ করেন এডিনবরা কলেজ অফ আর্টের শিল্পী রিচার্ড ডেমার্কো, যিনি প্রায়ই কনেরিকে মডেল করে ছবি আঁকতেন।

তার ভাষায়, “ভাষায় প্রকাশের চাইতেও সুন্দর, একজন অপার্থিব সুন্দর যুবক।”

কনেরি ফুটবলেও দক্ষ ছিলেন। স্কটিশ ফুটবল খেলোয়াড় এবং সেই সময়ের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর ব্যবস্থাপক ম্যাট বাসবাই তার খেলা দেখে ২৫ পাউন্ডের বিনিময়ে দলে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় মঞ্চনাটকের দলে টুকটাক ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে ততদিনে অভিনয়ে পোকা তার মাথায় কিলবিল করতে শুরু করেছে।

তাই তো ফুটবলে নয় নিজের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য তিনি বেছে নিলেন অভিনয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “সেটা ছিল আমার জীবনের চৌকশ পদক্ষেপ।”

১৯৫৩ সালে তিনি ‘মি. ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে লন্ডনে আসেন। প্রতিযোগীদের একজনের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন এই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে ‘সাউথ প্যাসিফি’ গীতিনাটকের জন্য নেওয়া হবে।

যোগ্যতার গুণেই কনেরি এই প্রোডাকশনের একজন দলীয় শিল্পী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। পরের বছর এই প্রোডাকশনেই তিনি লেফটেন্যান্ট বাজ অ্যাডামস চরিত্রে অভিনয় করেন। যে চরিত্রটিতে মঞ্চনাটকে সাড়া ফেলেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা ল্যারি হ্যাগম্যান।

সেই বছরেই দলের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আরেক বিখ্যাত অভিনেতা স্যার মাইকেল কেইনের সঙ্গে পরিচিত হন। পরে তারা দারুণ বন্ধু হয়ে যান। এছাড়া মার্কিন অভিনেতা রবার্ট হেন্ডারসনের সঙ্গেও তার দারুণ সখ্যতা গড়ে ওঠে। যিনি কনেরিকে নানাভাবে উৎসাহ দিতেন অভিনয়ের ব্যাপারে। বার্নাড শ, শেক্সপিয়ারের মতো লেখকদের বই পড়তে দিতেন। এভাবেই বন্ধু ও সতীর্থদের হাত ধরে নিজেই শিক্ষিত হতে থাকেন কনেরি।

১৯৫৪ সালে কনেরি ‘লাইল্যাক্স ইন দ্য স্প্রিং’ ছবিতে ‘এক্সট্রা’ হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া টেলিভিশনে কিছু ছোটখাট অভিনয়ও করেন, যেগুলোর মধ্যে পরিচিত বিবিসির পুলিশ-ভিত্তিক নাটক ‘ডিক্সন অফ ডক গ্রিন’।

‘নারীরা তাকে পছন্দ করবে’

এক নারী যদি কোনো পুরুষকে নিয়ে এমন মন্তব্য করেন, তাহলে সেটা ফেলে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না, আর সেটাই করেছিলেন ‘ব্লাড মানি’ টিভি মুভির পরিচালক রাল্ফ নেলসন।

মার্কিন অভিনেতা জ্যাক পালান্স প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর নেলসনের স্ত্রী বুদ্ধি দিল, “কনেরিকে নাও। ওকে মেয়েরা পছন্দ করবে।”

আর এভাবেই ১৯৫৭ সালে প্রথম প্রধান চরিত্রে পদার্পন করলেন শন কনেরি।

এক বছর পর ‘অ্যানাদার টাইম, অ্যানাদার প্লেস’ ছবিতে লানা টার্নারের সঙ্গে অভিনয় করেন তিনি। তবে টার্নারের প্রেমিক স্টম্পানাটো ধারণা করেন কনেরির সঙ্গে টার্নারের প্রেম চলছে। তাই ওই ছবির শুটিংয়ের সময় একদিন স্টম্পানাটো সেটে ঢুকে আগ্নেয়াস্ত্র বাগিয়ে ধরলে কনেরি পর্দার নায়ক থেকে বাস্তবের নায়ক হিসেবেও আর্বিভূত হন ।

কনেরি জোর করে স্টম্পানাটোর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে এক ঘুষিতে ধরাশায়ী করেন, পরে তাকে সেট থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্টম্পানাটো ছিলেন আমেরিকান গ্যাংস্টার মিকি কোহেনের দেহরক্ষী। ফলে তিনি কনেরিকে খুন করার হুমকি দিতে থাকেন। তখনন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদের পরামর্শে কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দেন কনেরি।

... তারপর বন্ড

আর এখানেও নারীর হাত....।

ইয়ান ফ্লেমিংয়ের উপন্যাসের স্বত্ব পাওয়ার পর প্রযোজক কুবে ব্রকলি ও হ্যারি সল্টজমান হন্যে হয়ে ‘জিরো জিরো সেভেন’ চরিত্রের জন্য অভিনেতা খোঁজা শুরু করলেন। তখন ব্রকলির স্ত্রী ডানা, স্বামীকে একরকম জোর করেই শন কনেরিকে নিতে বলেন।

তিনি বলেছিলেন, “তার মধ্যে যে চুম্বকার্ষণ আছে সেটা দারুণ যাবে চরিত্রের সঙ্গে।”

কিন্তু ফ্লেমিং মোটেই রাজি নন। তার কথায়, “আমি কমান্ডার বন্ডকে খুঁজছি, কোনো মাত্রা ছাড়ানো স্টান্টম্যানকে না।”

কিন্তু ডানা ব্রকলি ছিলেন ঠিক, ফ্লেমিং ছিলেন ভুল। সারা বিশ্বের দর্শক শন কনেরিকে এক বাক্যে ব্রিটিশ সিক্রেট এজেন্ট জেমস বন্ড হিসেবে মেনে নিল।

তবে ব্রিটিশ গুপ্তচরকে কেতাদূরস্ত বানানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন পরিচালকের বন্ধু টেরেন্স ইয়ং। তিনি কনেরিকে নিয়ে দামি রেস্তোরাঁ, হোটেল ও ক্যাসিনোতে ঘুরতেন। আর কোথায় কোনভাবে ভদ্রতা দেখাতে হবে তা দেখিয়ে দিতেন।

জেমস বন্ড চরিত্রটির নিজস্বতা তৈরির ব্যাপারে কনেরির হাতই বেশি। তিনি একই সঙ্গে আকর্ষণীয়, নির্দয়, কৌতুক ও দয়ার অদ্ভুত এক মিশেল ঘটিয়েছেন জেমস বন্ডের মধ্যে।

আর এই ফমুর্লার কারণেই হয়ত ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়া জেমস বন্ডয়ের প্রথম ছবি ‘ড. নো’ ছিল দারুণ ব্যবসা সফল। এরপর ১৯৬৩ সালে ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’, ১৯৬৪ সালে ‘গোল্ডফিংগার’, ১৯৬৫ সালে ‘থান্ডারবল’ এবং ১৯৬৭ সালের ‘ইউ অনলি লিভ টোয়াইস’, ১৯৭১ সালে ‘ডায়মন্ডস আর ফরএভার’, ১৯৮৩ সালে ‘নেভার সে নেভার এগেইন’ বন্ড সিরিজের ছবিগুলোতে ‘জিরো জিরো সেভেনের ভূমিকায় পর্দা কাঁপান।

তবে ‘ইউ অনলি লিভ টোয়াইস’ ছবিটি করার পর কনেরি একঘেয়েমিতে পড়ে যান। তাই তখন জেমস বন্ডে অভিনয় করার দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা জর্জ লেজেনবাইকে, কিন্তু দর্শকদের মধ্যে তা তেমন আগ্রহ জাগায়নি।

‘ডায়মন্ডস আর ফরএভার’ ছবিতে ফিরে আসার পর এত পরিমাণ ব্যবসা সফল হল ছবিটা যে, কনেরি যে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তা দিয়ে ‘স্কটিশ ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন ট্রাস্ট’ গঠন করেন।

‘নেভার সে নেভার এগেইন’

এই ছবিটা করার পেছনেও রয়েছে মজার ইতিহাস। ‘স্প্যানিশ ল্যান্ড’ চুক্তি করে প্রচুর অর্থ হারান এই অভিনেতা। অর্থ কষ্ট মেটাতে তিনি আবারও জেমস বন্ড ছবিতে কাজ করতে রাজি হলেন। এর আগে বলেছিলেন তিনি আর কখনও ‘জিরো জিরো সেভেন’ হবেন না।

তাই কনেরির স্ত্রী মিশেলিন কনেরি বলেছিলেন, ছবির এই নাম রাখতে; যাতে ‘না’ শব্দটা আর না বলেন।

তবে এই ছবির পর আর কোনো বন্ড ছবিতে অভিনয় করননি কনেরি। কিন্তু অন্যান্য ছবিতে যে স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন তাও ভুলবার নয়।

উমবের্তো একোর ‘দি রোজ’ ছবিতে বাস্কারভিলের উইলিয়ামের চরিত্রে অভিনয় করে ১৯৮৮ সালে জয় করেন ‘বাফটা’ অ্যাওয়ার্ড।

‘দি আনটাচেবলস’ ছবিতে অভিনয় করে জয় করেন অস্কার। এছাড়া ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ এ হ্যারিসন ফোর্ডের বাবার চরিত্রে কিংবা ‘দ্য রক’ ছবিতে নিকোলাস কেইজের সঙ্গে অভিনয় আজও দর্শক হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়।

‘দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর’ ছিল তার অভিনীত অন্যতম ব্যবসা সফল ছবি। তবে অনেকেই হয়ত তার ‘দি লিগ অফ এক্সট্রা অর্ডিনারি লেজেন্ডারি জেন্টেলমেন’ এর ছবিটির কথা জানেন না। ব্যবসা সফল না হলেও ছবিটি বেশ উপভোগ্য। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক জুল ভার্নের গল্পের বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ছবিটি।

২০০৬ সালে ‘দ্য লর্ড অফ দি রিংস’ ছবির ‘গ্যানডাল্ফ’ চরিত্রে কাজ করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন অভিনয় করে করে তিনি ক্লান্ত।

আর বলেছিলেন, “ইডিয়টরা এখন হলিউডে ছবি বানাচ্ছে। যে কারণে অসুস্থ বোধ করছি।”

.... অবশেষে

হলিউডের লাইফস্টাইল মোটেই পছন্দ করতেন না শন কনেরি। সেকারণেই হয়ত স্পেনের নিজের বসতবাড়িতে থাকতেন আর গল্ফ খেলে সময় কাটাতেন। পর্তুগাল ও ক্যারিবীয় অঞ্চলেও রয়েছে তার নিবাস, যেখানে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী চিত্রশিল্পী মিশেলিন রোকিউবার্নকে নিয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়েছেন।

প্রথম স্ত্রী ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী ডাইয়েনি সিলেন্ত্রো। সেই ঘরে এক সন্তান জেসন কনেরি এখন অভিনেতা।

কাঙ্ক্ষিত নাইটহুড খেতাব ২০০০ সালে ভূষিত হওয়ার পরও তিনি সবসময় সার্বোভৌম স্কটল্যান্ডের জয়গান গেয়েছেন। তার হাতের ট্যটুও আছে ‘স্কটল্যান্ড ফরএভার’।

স্যার শন কনেরি, যেভাবে জীবন পার করেছেন তা বহু অভিনেতার জন্যই স্বপ্নের। এখন তার অভিনীত ‘জেমস বন্ড’ ছবিগুলো হয়ত সংরিক্ষত হবে জাদুঘরে। তবে কনেরির জাদুর খেল আর দেখতে না পাওয়ার অতৃপ্ততা থেকে যাবে সব সময়।