অনুদানের চলচ্চিত্র নির্মাণে গড়িমসি

অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নয় মাসের মধ্যে নির্মাণের নিয়ম থাকলেও নির্ধারিত সময়ে বেশিরভাগ নির্মাতাই চলচ্চিত্র জমা দিতে পারেন না। কোনও ছবি মুক্তি দিতে ২০ বছর কেটে যায়; কোনটি আবার আলোর মুখই দেখে না।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2020, 05:56 AM
Updated : 27 Oct 2020, 06:32 AM

নির্মাণে দীর্ঘসূত্রিতা ঠেকাতে আগের তুলনায় আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়; নির্ধারিত সময় শেষে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠিয়ে সদুত্তর না পেয়ে ২০১৬ সালে পাঁচ নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল মন্ত্রণালয়।

অনুদান পাওয়ার আট বছরেও ছবির কাজ শেষ করতে না পারায় কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক টোকন ঠাকুরকে গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে অনুদানপ্রথা চালুর পর দেড় শতাধিক চলচ্চিত্রের মধ্যে বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মুক্তি দিতে পারেননি নির্মাতারা; এর মধ্যে ২০টির মতো চলচ্চিত্র এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

সরকারের নির্ধারিত সময়ে ছবি নির্মাণ সম্পন্ন করতে না পারার কারণ হিসেবে সময় স্বল্পতা ও অনুদানের অর্থকে ‘অপর্যাপ্ত’ বলে অভিযোগ করছেন অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতারা।

অন্যদিকে চলচ্চিত্র অনুদান কমিটির একজন সদস্য বলছেন, একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য নয় মাস সময় যথেষ্ট। তবে বিশেষ প্রয়োজনে সময় বাড়ানোর নিয়ম থাকলেও সেটা অনেক সময় দশ বছরে গিয়ে ঠেকে।

বরাদ্দের অর্থের বিষয়ে তিনি বলছেন, কোনও ভালো গল্পের চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বাজেটের একটা অংশ দেয় সরকার। পুরো অর্থ সরকার কখনোই দেয় না; বাকিটা প্রযোজক খুঁজে নির্মাতাকে ব্যবস্থা করতে হবে।

১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া অভিনেতা মাসুম আজিজ পরিচালিত ‘সনাতনী গল্প’ মুক্তি পেয়েছিল ২০ বছর পর। ২০১৮ সালের অক্টোবরে পাবনার একটি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মুক্তি পেলেও ঢাকায় কোনও হলে তা মুক্তি পায়নি।

১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের নির্মাতা মনিরুজ্জামান মনিরের চলচ্চিত্র ‘পদ্মা আমার জীবন’ চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল এক যুগ পর ২০০৮ সালে।এছাড়াও ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত বেবি ইসলামের ‘মেহের জান’সহ পরবর্তীতে বিভিন্ন বছরে অনুদান পাওয়ায় এনামুল করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’, চিত্রনায়ক উজ্জলের ‘উদয় তারা’, আখতারুজ্জামানের ‘সূচনা রেখার দিকে’, মারুফ হাসান আরমানের ‘নেকড়ে অরণ্য’সহ ২০টির মতো চলচ্চিত্র এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

চলতি দশকের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্রের কাজ নির্মাতার মৃত্যুর পর থেকেই আটকে আছে।

২০১১-১২ সালে অনুদান পাওয়া ‘একা একা’ চলচ্চিত্রের পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী অসুস্থতার কারণে ছবিটি নির্মাণ করতে পারেননি। ছবি হবে কিনা তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’র নির্মাণ পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। ছবিটির শুটিং এখনও চলছে। শিগগিরই দৃশ্যধারণ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন তিনি।

এতে সহপ্রযোজক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন মাতিয়া বানু শুকু। অর্থ সঙ্কটে ছবির কাজ এতদিন ধরে আটকে ছিল বলে জানান তিনি।

একই অর্থবছরে অনুদান পাওয়া মাহমুদ দিদারের আরেক চলচ্চিত্র ‘বিউটি সার্কাস’ এখনও মুক্তি পায়নি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেও ছবির দৃশ্যধারণ করেছেন নির্মাতা। মুক্তির বিষয়ে এখনও নির্দিষ্ট কোনও তথ্য মেলেনি।

সাত বছরেও ‘যৌবতী কন্যার মন’ চলচ্চিত্র মুক্তি দিতে পারেননি নির্মাতা নারগিস আকতার; ২০১৬ সালে পরিচালকের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে মামলা করেছিল তথ্য মন্ত্রণালয়।২০১৫-১৬ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া কামার আহমেদ সাইমনের ‘শিকলবাহা’ এখনও মুক্তি পায়নি; ছবিটির নির্মাণ শেষ হয়েছে বলে জানান নির্মাতা।

নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ চলচ্চিত্রটি অনুদান পাওয়ার তিন বছরেও মুক্তি পায়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া ছবিটির দৃশ্যধারণ শেষ হয়েছে বলে জানান তিনি।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের হাবিবুর রহমানের পরিচালনায় ‘অলাতচক্র’ মুক্তি পায়নি। তবে ছবির দৃশ্যধারণ শেষ হয়েছে বলে দাবি করেছেন পরিচালক।

করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে সব ধরনের শুটিং বন্ধ থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলোর জন্য নির্ধারিত সময় শিথিল করা হবে বলে জানিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়।

এর আগের ছবিগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারলে তথ্যমন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে নির্মাতাদের কাছে নিয়মিত ব্যাখ্যা চাওয়া হচ্ছে বলে জানান উপসচিব (চলচ্চিত্র) সাইফুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্মাতাদের কাছ থেকে নিয়মিত ব্যাখ্যা চাওয়ায় তাদের কাজের গতি আগের তুলনায় বেড়েছে। অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। ডিসেম্বেরের মধ্যেই ছবিগুলো জমা দেওয়ার কথা বলেছেন। আশা করছি, আগামীতে সব ছবিই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা পড়বে।”

নির্মাতাদের অভিযোগ, অনুদান কমিটির জবাব

সরকারের বেঁধে দেওয়া সময় নয় মাসের মধ্যে অনেক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভবপর হয়ে উঠে না বলে বরাবরই বলে এসেছেন অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতারা।

এ বিষয়ে চলচ্চিত্র অনুদান কমিটির সদস্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চলচ্চিত্রকে উৎপাদন হিসেবে ধরলে তাতে সময় বেঁধে দেওয়া থাকবেই। কোনও প্রযোজকই অনির্দিষ্টকালের জন্য কোথাও বিনিয়োগ করে অর্থ ফেলে রাখেন না।

“পপুলার ধারার প্রডিউসাররাও ঈদ কিংবা পূজায় মুক্তির দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করেন, পরিচালকরা কিন্তু সেভাবেই চলচ্চিত্রের গল্প ও পরিবেশ নির্বাচন করেন।”

প্রতিবছরই অনুদান দেওয়ার ফলে বছরে হিসাব বছরেই শেষ করতে না পারলে জটিলতা তৈরি হয় বলে মনে করেন চলচ্চিত্রের এ শিক্ষক।

“নয় মাসে না হলে নিজের অর্থে আপনি ৬ বছরে ইডিপাস কিংবা ১০ বছরে মেঘনাদবধ কাব্য নিয়ে গবেষণা করে সিনেমা বানান। আর সরকারি অর্থ নেওয়ার আগে ভাবতে হবে, নয় মাসের মধ্যে ছবিটি বানাতে পারবেন কি না।

“যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে সময় বাড়ানোর আবেদন করলে তা বাড়ানো হয়। কিন্তু সেটা অনেক সময় দশ বছরে গিয়ে ঠেকে!”

অনুদানের ছবির জন্য বরাদ্দকে ‘অপর্যাপ্ত’ বলেও দীর্ঘদিনের অভিযোগ আছে নির্মাতাদের।

মতিন রহমান বলছেন, অনুদান কখনোই পূর্ণ অর্থ দেয় না। অনু শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র। আপনার ছবি করতে লাগবে ১০ কোটি টাকা সেখানে উৎসাহের জন্য সরকার ৫০ লাখ টাকা দিচ্ছে। বাকিটা আপনাকে ব্যবস্থা করতে হবে।

“আর পর্যাপ্ত বাজেট না পেলে স্বল্প বাজেটে গল্প নির্বাচন করতে হবে। বাংলাদেশের বাজারে ১০ কোটি টাকা খরচ করে সিনেমা করতে গেলে তো টাকা তুলতে পারবেন না।”