কাগজে নয়, হৃদয়েই লেখা আছে মান্না দে’র নাম

কফি হাউজের আড্ডা থাকুক বা না থাকুক- মান্না দে বেঁচে থাকবেন শ্রোতা হৃদয়ে।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2020, 09:27 AM
Updated : 25 Oct 2020, 09:27 AM

হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটিসহ প্রায় ২৪টি ভাষায় ষাট বছরেরও বেশি সময় সংগীত-চর্চা করেছেন মান্না দে।

২৪ অক্টোবর ছিল এই মহান শিল্পীর মৃত্যুদিবস। তাকে স্মরণ করে গ্লিটজের পাঠকদের জন্য লিখলেন আরাফাত শান্ত।

মান্না দে তার জীবনে সবচেয়ে বড় ধন্যবাদটা দিতে পারেন ভগবানকে। যদিও তিনি ভাগ্যকে বেশি বিশ্বাস করতেন ভগবানের চেয়ে। কেন বললাম এ কথা?

কারণ কিশোর বয়সে মান্নাদের ছোট কাকা যদি অন্ধ না হতেন, যদি নিরুপায় হয়ে শুধু গানই না শিখতেন বিভিন্ন দিকপাল ওস্তাদের কাছে, তবে কোনোদিন মান্না দে এত বড় শিল্পী হতেন না।

ছোটবেলা থেকেই মান্না দে দেখেছেন তার কাকার গান, রাগ, স্বর সাধনার প্রতি নিবেদন। বড় বড় সংগীত প্রতিভাদের দেখেছেন অন্তরঙ্গ ভাবে শিখছেন গান তার কাকার কাছে। এমনকি শচীন কর্তা পর্যন্ত শিখতেন গান উনার কাছে।

তার কাকার শিক্ষণ পদ্ধতিও ছিল অসাধারণ। তিনি দেখতেন শেখার কতটা আগ্রহ, তারপর শেখাতেন।

মান্না দে কে একদিন বললেন, “মানা তানপুরাটা একটু ধর।”

মান্না দে কখনও বাজায়নি। আর তার কাকার মতো বড় সাধকের পাশে তো কখনই না। তিনি ভয়ে ভয়ে ধরলেন, কাকার মান তো রাখতে হবে। হয়ে গেল। এরপর দেখা গেল উনি শুধু বাজান। এরকম হারমোনিয়ামও। শিখেন নি। কিন্ত হয়ে গেল। তার কাকা তাকে নিয়ে রেয়াজ করতেন কিন্তু আনুষ্ঠানিক ভাবে শিখিয়েছেন অনেক পরে। তাও ইন্টার-কলেজ প্রতিযোগিতায় গাইতে হবে। তার কাকা গাইতে দেবে না। কিন্তু স্কটিশ চার্চের প্রিন্সিপালের অনুরোধ।

মান্না দে দু একটা বিভাগ ছাড়া সব কিছুতে প্রথম হয়েছিলেন। তিন বছর টানা প্রথম হয়ে তিনি পেয়েছিলেন, রুপার তানপুরা। যা এখনও কলেজের গর্ব।

মান্না দে তার আরেক কাকা বলেছিলেন, আইনজীবী হতে। ওই কাকার কথাই তাদের ঠাকুরমা ভিত্তিক পরিবারের আইন। মান্না দে কোনোভাবেই রাজি হন নি। তিনি এসে পড়েছিলেন তার কাকার সঙ্গে মুম্বাই।

ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তখন কেবল মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তিনি শচীন কর্তা থেকে শুরু করে আরও নাম করা অনেকের সহকারী ছিলেন। টাকাও কামাতেন বেশ। কিন্তু উনার গানের ক্ষুধা। গাইতে পারছেন না, কাউকে বলেনও না। এত ভালো শাস্ত্রীয় সংগীতে দখল, গলার এত ভালো কোয়ালিটি, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সবার সঙ্গে ওঠা বসা। নোটেশন, অ্যারেঞ্জমেন্ট, স্টুডিও সুপারভিশন নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।

তাও তিনি সুযোগ পান শচীন কর্তার কাছে, 'মশাল' ছবির গানে। তখন তো মুকেশ রফি কিশোরের ফর্মুলাতেই সবাই আস্থা রাখে, তিনি চেষ্টা করতেন নিজের স্বকীয়তা দিয়ে ঢুকে পড়তে, অপেক্ষার অবসান হল।

বিখ্যাত সব পরিচালকদের সঙ্গে গান গাওয়া শুরু করলেন। সলীল চৌধুরী কিংবা নওশাদ অথবা শংকর জয় কিষাণ সবার সঙ্গেই তিনি সাবলীল। তখন একটা কথা ছিল, মান্নাকে বুঝিয়ে দাও গান, সে এমন ভাবে গাইবে কল্পনাই করতে পারবে না।

রাজ কাপুরের মতো নায়ক দিনের পর দিন মান্না দের সঙ্গে বসে থাকতেন, কীভাবে গান তৈরি, কি ‘থট প্রসেস’।

চিত্রায়নের সময় নিয়ে যেতেন, জিজ্ঞেস করতেন, “এইভাবেই তো- নাকি বদলাবো?”

কত ভাষায় গান গেয়েছেন মান্না দে। মালায়লাম ভাষার গানে তো তিনি ঈশ্বরতুল্য। তার স্ত্রী ছিল মালায়ালী, কিন্তু বোম্বেতেই বড় হওয়া। খুব ভালো ছিলেন ছাত্রী, তত ভালো মানুষ। মান্না দে অসংখ্যবার তার স্ত্রীর গুণগান গেয়েছেন। এমনকি সুলোচনা কুমারণ এত ভালো সেলাই আর উলের কাজ করতেন যে বোম্বের এক ‘অ্যারিস্টোক্রেট ড্রেস মেইকার’ বলেছিলেন, “আপনার স্ত্রীর মতো সম্ভব না। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করি।”

তবুও মান্না দে আমাদের দূরেই থাকতেন যদি না তিনি বাংলা গান গাইতেন। তখন উত্তম কুমারের যুগ, হেমন্ত উত্তমকুমার ফিট। তারপরেও সুধীন দাশগুপ্ত উত্তমকে রাজী করান, 'শঙ্খবেলা' ছবিতে গান গাওয়ানোর জন্য।

মুম্বাইতে তখন স্টুডিও পাওয়া যায় না, নওশাদকে রাজী করান সকাল এগারোটায় ছেড়ে দেবেন। লতাকে বাংলা শিখিয়ে ভালো মতো গানটা রেকর্ড করেন। তখনকার লতা মুঙ্গেশকারও ছিলেন অদ্ভুত, বাংলা সব ক্লাসিক বই তিনি হিন্দি অনুবাদ পড়ে শেষ করেছেন। 'এন্টনি ফিরিঙ্গি'তেও তার গাইবার কথা ছিল না, প্রযোজক জানান, মান্না দে ছাড়া হবে না। উত্তম কুমারও রাজী হয়। তারপর তো ইতিহাস।

মুম্বাইতে একদিন দেখেন জগিং করতে উত্তম কুমারকে। উত্তম কুমারের ওয়াকম্যানে শুধু মান্না দের গান।

উত্তম কুমার বললেন, “মশাই আপনাকে আমার তো শুনে শুনে বুঝতে হবে, নয়তো সামনে লিপ করবো কীভাবে?”

যা হোক যা বলছিলাম সুধীন দাশগুপ্ত মূলত মান্না দে অমর করে দিয়েছেন। ভেবে দেখুন তো, 'হয়তো তোমারই জন্য' ছাড়া আপনি বাংলা গান ভাবতে পারেন কিনা? মান্না দে অসংখ্য গান গেয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হয় পুলক বন্ধ্যোপাধ্যায় আর মান্না দে জুটি সব থেকে দারুণ।

একদিন পুলক বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখবো। একজন হাসিখুশী অভূতপূর্ব সাকসেস পাওয়া মানুষ কেন লঞ্চ থেকে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করবেন তা আমি আজও ভেবে পাই না। মান্না দে অনেকদিন ধরেই একটু একটু নিঃশেষ হয়েছেন।

রফি কিশোর হেমন্তর মতো লিজেন্ডের চলে যাওয়া, গৌরীপ্রসন্ন, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশ গুপ্তের চলে যাওয়া তাঁকে একাকী করেছে।

মায়ের মৃত্যু, ছুরিকাঘাতে আহত হওয়া এরকম অনেক কিছুই তাকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিয়েছে। তাও তিনি গান গাওয়া থামান নি, দেশে বিদেশে গেয়েই গেছেন।

শেষ বয়সে গলা শেষ হলেও তিনি শেষ হন নাই। বিরহের গান, সুখের গান, দুঃখের গান, প্রেমের গান, অসংখ্য গান তিনি শুধু গেয়েই গেছেন। মানুষের মুখে মুখে সেসব গান।

আমাদের শৈশব কিশোরে মান্না দে শুনতেই হতো, বুঝতাম না মর্ম। যেমন আমার এক আন্টি শুনতো, 'ললিতা গো ওকে আজ চলে যেতে বল না'। পাশের বাসার আংকেল গুনগুন করে গাইতো, 'তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছো'।

তখন আমাদের সময় ছিল যুথবদ্ধতার। একে অন্যেকে জানতাম, কে কি গায়, কে কি পড়ে, কে কি বলে সব জানা হয়ে যেত।

অসাধারণ মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার আর সম্মাননা তার জীবনে কম আসেনি। ভারতের রাষ্ট্রীয় বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ পেয়েছেন। ১৯৬৮ সালে সেরা পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ‘মেরে হুজুর’ ছবিতে গান গেয়ে। ১৯৭১ সালে বাংলা ছবি ‘নিশি পদ্ম’তে গাওয়ার জন্য আবার সেরা গায়কের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। সে বছরই ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিটিও তাকে একই পুরস্কার এনে দেয় হিন্দি ভাষা বিভাগে। একই ছবির জন্য ১৯৭২ সালে পেয়েছেন সেরা গায়ক হিসেবে ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার। ২০০৭ সালে ভারত সরকার দাদা সাহেব ফালকে সম্মাননা এবং ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাকে ‘বঙ্গ বিভূষণ’-এ ভূষিত করে।

গরম আর শীত নিয়ে ভাবছিলাম। গরম নিয়েও মান্না দের গান আছে। প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন। কি সুন্দর। আমার ভীষন প্রিয়। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম দেখি তারও প্রিয়, আমার চেয়েও নাকি বেশি।

আমি অবাক হলাম। এইভাবেই আসলে মান্না দে বেঁচে থাকবেন। কারণ আমাদের প্রিয় গানের লিস্টে তার অনেকগুলো গান। মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রণাম।

অনেক কাল আগে আজিজে আমরা সিডি কিনতাম রেগুলার। তখন এক নামকরা মহিলা শিল্পী মান্না দের গান গাওয়া এক অ্যালবাম বের করলেন। এক ভদ্রমহিলা আসলেন, তার কথাটা আমার এখনও কানে বাজে।

তিনি বলেছিলেন, “এদের কানের চিকিৎসা করা উচিত, এইভাবে মান্না দের গান গায়, ভালো মতো শোনেনি বলেই এত জঘন্য গেয়ে সিডিও বের করে।”

মান্না দের গান সব সময় চিরকালীন।