‘রাত নির্ঘুম’- হাবীবের সেই রোমান্টিক গানের গীতিকবি নিজ বয়ানে জানালেন এবি’র প্রতি ভালোবাসার কথা। শুধুমাত্র গ্লিটজের পাঠকদের জন্য।
বাচ্চু ভাইয়ের নামের আগে আমার প্রয়াত লিখতে দ্বিধা হয়। এইতো একটু আগেও মনের ভিতর গুনগুনিয়ে উঠলো দুটা লাইন… বহুদূর যেতে হবে!! গতকালকে সন্ধ্যায়ও শুনেছি ‘তারা ভরা রাতে’ অ্যালবাম পুরোটা!! নাই কোথায়? আছেন তো উনি!! সময়ের প্রতিটা পরতে পরতে মিশে আছেন তিনি।
আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো সখ্যতা ছিলোনা। সুযোগ হয়নি বললে মিথ্যা বলা হবে। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগানোর যোগ্যতা আমার ছিল না।
বাচ্চু ভাইয়ের ছায়াসঙ্গী হয়ে যখন সর্বশ্রদ্ধেয় শিবলী ভাই, অংশু ভাইয়া, বাপ্পী ভাই, এঞ্জেল শফিক, যায়েদ আমিন- ঘর আলো করে রেখেছেন… গীতিকবি হিসেবে তো বহুদূরের অলীক কল্পনা… শ্রোতা হিসেবেও আমার মন-মানসিকতা ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মাত্র!!
আর পরবর্তী সময়ে যখন সংবাদমাধ্যমে অল্প একটু জড়িয়েছি তখন তো দেশের খ্যাতিমান গণমাধ্যমকর্মীরা তাকে জড়িয়ে রেখেছেন মমতায়। ওমর ভাই, স্বরূপ ভাই-এর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপই নাই! গল্প শুনেছি শুধু সুমন ভাইয়া কিংবা তানভীর ভাইয়ার কাছ থেকে। মনজু ভাইয়ের কথা আলাদা করে নাই বলি!! বাচ্চু ভাইকে ছাপিয়ে উনারাই তখন আমার কাছে তারকা। উনাদের সঙ্গে দেখা হলে, কথা হলে নোটবুকে লিখে রাখি। যে কয়বার আইয়ুব বাচ্চুর সান্নিধ্যে আসবার সুযোগ হয়েছে… সেগুলোই আমার এখনের সুখস্মৃতি। তবুতো উনার সঙ্গে এক টেবিলে বসে চা খেয়েছি। এই সৌভাগ্যওতো সবার হয় না! তাইনা?
গীতিকার হিসেবে আমার ছোটমোট ক্যারিয়ারটা অপূর্ণ রয়ে গেছে। এই খামতিটা পূরণ করার সম্ভাবনাও নাই আর। এইটা ভেবে আমার খুব কষ্ট লাগে। তবে সুযোগ হয়েছিলো। আমার কোনো লেখা সুরারোপিত হয়েছে… সেই গানটা আমি জানতাম বাচ্চু ভাই গাইবেন। জুয়েল-বাবুর সুরে।
জুয়েল ভাই ডেমোটা শুনিয়ে বলেছিলেন, “বাচ্চু ভাই আর হাসান ভাইকে নিয়ে ঈদে অ্যালবাম আসছে। ওই অ্যালবামে থাকবে গানটা।”
অ্যালবাম বের হল। নাম ‘আষাঢ়ে শ্রাবণ’। গানটা আর আসলো না। রিলিজ হল নকশীকাঁথা অ্যালাবামে। খালিদ ভাই গাইলেন ‘মেঘলা ভালোবাসা’।
বাচ্চু ভাইকে বললাম একদিন এই ঘটনা। উনি খুব হাসলেন। মোটামুটি ঘর ফাটিয়ে হাসা যাকে বলে।
“জুয়েল তোমাদেরকে ভুল ইনফরমেশান দিয়েছে। দেখোতো কেমন একটা ভুল বোঝাবুঝি হলো তোমাদের সঙ্গে!!”
আমি আর মামুন গিয়েছিলাম। আমি তখন গান লিখতাম মামুন-সাকী নামে।
বাচ্চু ভাইকে বলেছিলাম… “বস আপনার কাছে আমার দাবী থাকলো। একটা হইলেও গান আপনার সুরে থাকতে হবে। বাচ্চাদের যেমন করে ভুলিয়ে রাখা হয়… বাচ্চু ভাইও তেমন করে বুঝিয়েছিলেন… আরে!! চা খাও! ওগুলা পরে দেখা যাবে… আমি মিটআপ করে দিবো!!”
উনি আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন অ্যালবামটা এজি থেকে ফ্রি টু ডাউনলোড ক্যাটাগরিতে ডিজিটাল রিলিজ দেওয়ার।
আমার মতো একটা খুচরা মানুষের ফোনে তার নাম্বার সেইভ করা। সেই নাম্বারে তার কল ভেসে ওঠে। আমার মতো একটা খুচরা মানুষের জীবন এটাও কি কম অর্জন?
ইজাজ খান স্বপন আমার আর মামুনকে নিয়ে একটা মিউজিক বেইজড ম্যাগাজিন করার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরে যুক্ত হয়েছিলেন শহীদুল ইসলাম মিন্টু।
ওই সময়টাকে তার সঙ্গে যোগাযোগটা ছিলো সবচেয়ে বেশি। প্রায় সময়েই ডাকতেন, ফোন করতেন খবর নিতেন। নতুন নতুন আইডিয়া দিতেন। এটা করো ওটা করো… আহারে কি সুখের সেইসব ফোন কল!!
এবি কিচেনের সভাগুলোতে আমি নিয়মিত সভ্য ছিলাম না কখনও। আমার সেই যোগ্যতাই ছিল না আসলে। তবে তার স্নেহ যতখানি পেয়েছি…. তার ওপর ভরসা করে একবার একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছিলাম।
আজকের কাগজে কাজ করি তখন। ঈদ সংখ্যায় আমার দায়িত্ব ছিল এলআরবি, নগর বাউল, ফিডব্যাক ও রেনেসাঁ… এই চার ব্যান্ডের সদস্যদের ঈদ পরিকল্পনা নিয়ে ফিচার করতে।
তারকা কাগজের বিভাগীয় সম্পাদক তখন কবীর হুমায়ুন ভাই। সাপ্তাহিক মিটিংয়ে বড় মুখ করে বলে ফেলেছি… এলআরবি’র বিষয়টা। জেমস ভাইরে পাওয়া মুশকিল!!! এখন পড়লাম বিপদে বাচ্চু ভাই ফোনতো আর ধরেন না।
কবীর ভাইয়ের সহযোগী রিমন ভাই নিয়মিত তাড়া দেন… ম্যাটার কই!!! আমিতো মনে মনে ঢোক গিলি শুধু। ম্যাটার জমা দেওয়ার শেষ দিন।
মোটামুটি জান হাতে নিয়ে লিখে ফেললাম বানায়া বানায়। বাচ্চু এই বলেছেন… অই বলেছেন… সব নিষ্পাপ কথা বার্তা… ঈদের দিন নামাজ পড়বো… পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবো… বিকাল বেলা গিটার বাজাবো…. সন্ধ্যায় টিভি দেখবো…. সব মনের মাধুরি মিশায়ে লিখে ফেললাম!! ছাপাও হইলো।
কবীর ভাই খুশি, পাঠক খুশি আমিও খুশি। ভেজালটা লাগলো বাচ্চু ভাইকে যখন জানাইলাম। বস রাগ করে ফোন রেখে দিলেন!! আমারতো জানে পানি নাই।
বাচ্চু ভাই কলব্যাক করলেন…. আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো!! বস ভুল হয়ে গেসে… আমার চাকরী চলে যাইতো (এইটা আরেকটা মিথ্যা কথা! প্রদায়কদের চাকরিইতো থাকেনা… যাবে কি!!)
বস হাসতে হাসতে বললেন… “অ্যাই!! থামো থামো… রাগ করি নাই। লাইন ড্রপ করসিলো।”
আমার মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। তবে বাচ্চু ভাই খুব বুঝাইসিলেন… এমন যেন না করি আর। অভ্যাস হয়ে যাবে পড়ে। আমি এই উপদেশটা সারাজীবন মনে রাখার চেষ্টা করেছি।
বাচ্চু ভাইয়ের বিষয়ে আমার আর যা স্মৃতি সেগুলা নিত্যান্তই চলতি পথে দেখা হওয়া কিংবা স্টুডিওতে চুপ করে বসে তার বাজানো দেখা। (বাচ্চু ভাইয়ের প্যাকেট থেকে আমি সিগারেট নিয়ে খাইসি একদিন!! এই ঘটনাটা খুব কম মানুষের জীবনে ঘটসে বলে আমি জানি। তানভীর ভাইয়া এইটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করসিলেন একদিন!!)
১৮ তারিখ আমার জীবনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। এই দিনটা দুবছর আগ পর্যন্তও আমার জীবনে ভীষণ আনন্দ উৎসারণ নিয়ে আসতো। এই দিনে আমি এসেছিলাম আম্মার কোলে!
কিন্তু হঠাৎ করে কেমন জানি বদলে গেল সব। ১৮ তারিখ আসলে আমার খুব মন খারাপ লাগে। বাচ্চু ভাই বেছে বেছে এই দিনটাতেই চলে গেলেন!! তার রুপালি গানগুলো শুধু রয়ে গেলো। সারাটাজীবন যিনি তার পুরোটা দিয়ে গেলেন সঙ্গীত আর সঙ্গীতানুরাগীদের… চলে গিয়েও তিনি অমর হয়ে রইলেন…. তাঁর সৃষ্টকর্মগুণে!
“বস! আমি কিন্তু দাবী ছাড়ি নাই এখনও। আমার একটা গান হলেও আপনার সুরে থাকতেই হবে। এই দুনিয়ায় হয় নাই… দুঃখ নাই। অন্য দুনিয়ায় আপনাকে জ্বালাবো আবার। ভালো থাকবেন বস!!”
আপনার চলে যাওয়া মানে আপনার প্রস্থান নয়। আপনাকে আপনার সৃষ্টকর্ম বাঁচিয়ে রাখবে… এই পৃথিবী যতদিন আছে।