‘রঙ্গিলা’ সিনেমার ২৫ বছর

সময়ের আগে আসা এক ছবি যেখানে আকর্ষণ আবেদনে ছিল না অশ্লীলতা।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2020, 03:00 PM
Updated : 28 Sept 2020, 08:45 AM

বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে ‘ঘাগরা’ পরে নায়িকাদের নৃত্য দৃশ্য স্বাভাবিক লাগলেও ‘রঙ্গিলা’ ছবিতে উর্মিলা মাতন্ডকারের শুধু মাত্র একটা ‘স্লিভলেস টপস’ পরে সমুদ্রে সৈকতে দৌড়ানোর দৃশ্য নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়।

‘অশ্লীলতা’ আর ‘যৌনতা’র সীমারেখা যেখানে পাতলা এক রেখায় আলাদা করা সেখানে ‘কাল্ট ক্লাসিক’ হিসেবে আখ্যা পাওয়া ১৯৯৫ সালের এই ছবি নিয়ে এখনও অনেকেই দ্বন্দ্বে ভোগেন।

আর এসব নিয়েই বিস্তারিত লিখেছেন আরাফাত শান্ত।

সেদিন বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জানালেন,  ‘রঙ্গিলা’ সিনেমায় উর্মিলা মাতন্ডকারের অভিনয় সফটপর্ণ টাইপের।’

কথাটা শুনে আশ্চর্য হলাম। সম্মান রেখেই বলছি কঙ্গনার মতো ভালো শিল্পীও এই সিনেমাটা দেখার দরকারে দেখেছে, বুঝে নাই কিছুই।

এই সিনেমা বুঝতে হলে আপনাকে ছবিটি দেখতে হবে। আর পরিচালক রাম গোপাল ভার্মার সিনেমা, জীবনযাপন ও চিন্তা ভাবনা সম্বন্ধে ধারণা রাখতে হবে।

এসব না ভাবলেও সিনেমাটা দেখতে পারেন, তাতে একটা রোমান্টিক কমেডি মিউজিক্যাল দেখারই মজা পাবেন। এরকম সিনেমা রাম গোপাল ভার্মা আগে পরে আর কখনই তৈরি করেননি।

এই সিনেমার মূল প্লট রামগোপাল ভার্মার এক বন্ধুর জীবন থেকে কিছুটা নেওয়া।

রমেশ নামের সেই ছেলে এক মেয়েকে পছন্দ করতো। চেষ্টা করতো প্রেমে সফল হওয়ার। তবে মন থেকে আবার চাইতো অন্য কোনো আরও যোগ্য ছেলে তার প্রেমিকাকে যেন পায়।

এই যে প্রেমের দোলাচল এটাই ছিল সিনেমার মূল বিষয়। সেটার ওপর নিরাজ ভোরা আর রামগোপাল ভার্মা মিলে স্ক্রিপ্ট প্রস্তুত করেন।

পরিচালক রাম গোপাল মূলত বানাতে চেয়েছিলেন একটা মিউজিক্যাল, যেখানে প্রেম থাকবে আর থাকবে না কোনো ‘নেগেটিভিটি’।

তিনি প্রথমে মাধুরীকে অভিনয় করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাধুরীর তখন সময় ছিল না।

উর্মিলা তখন নতুন অভিনেত্রী কিন্তু সে রাম গোপালকে বলেছিল, “আমি পারবো। আপনি আমাকে নিয়ে ট্রাই করতে পারেন।”

মূলত উর্মিলার শারীরিক সৌন্দর্য ও বোম্বের সে সময়ের সিনেমার হালচাল ফোকাস করাই ছিল পরিচালকের লক্ষ্য।

আমির খান প্রথমে রাজী হননি। কারণ তিনি গল্পের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাও তিনি করলেন কাজ। কাজ করতে করতে পরে গিয়ে মনে হল এমন গল্প হতেই পারে।

আমির খানকে ‘মেইনস্ট্রিম’ সিনেমার বড় তারকা বানিয়েছে এই সিনেমা। তার স্থানীয় গুন্ডা’র যে অভিনয় সেটা অনেকদিন ছিল অনেক ভারতীয় সিনেমার জন্য ‘রেফারেন্স পয়েন্ট’।

সিনেমাটা অনেকের জন্যই ছিল নতুন ভাবে কাজের শুরুর মাধ্যম। যারা পরে নিজ নিজ ভূবনে সুপারস্টার হয়েছেন।

যেমন- কোরিওগ্রাফার সরোজ খান আসতে একদিন দেরি করছিলেন, তার ছেলে আহমেদ খানকে দিয়ে রাম গোপাল কাজ শুরু করে দেন।

মনীশ মালহোত্রার মতো ফ্যাশন ডিজাইনারের ছবিতে কাজ শুরু এই সিনেমা দিয়ে। এ.আর রেহমানের মতো ‘লিজেন্ড’ হিন্দি ছবিতে বিখ্যাত হয়েছেন এই সিনেমায় গান কম্পোজ করে।

‘রঙ্গিলা’ ছবির গানগুলো নিয়েই আলাদা একটা নিবন্ধ লেখা যায়। এই ছবির গান বলিউডের সেসময়ের অন্য ছবির গানগুলোর চেয়ে আলাদা। কর্নাটক ক্লাসিক্যাল আর পপ মিউজিক সব মিলে একাকার।

এ.আর রেহমান তখন খুব চুপচাপ ধরনের মানুষ ছিলেন। তিনি কখনও পরিচালককে মুগ্ধ করার চেষ্টা করতেন না। সুর বানিয়ে শোনাতেন আর জিজ্ঞেস করতেন চলবে কিনা?

রাম গোপাল ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কারণ আনু মালিক তখন সবার চাইতে বেশি জনপ্রিয়। তিনি নিশ্চয়তার পথে হাঁটেন নাই। এ.আর রেহমানের জাদুকরী সুরে আর আশা ভোঁসলের কন্ঠে এ ছবির সব গান এখনও শুনলে মুগ্ধ হতে হয়।

ছবিটা মুক্তির পর উর্মিলা মাতন্ডকার ভারতের সব চেয়ে সুদর্শনা নায়িকার খেতাব পান। তার নাম ছিল সবার মুখে মুখে। যৌনতাকে কীভাবে অশ্লীলতা থেকে মুক্ত রেখে আবেদনময় ভাবে দেখানো যায় তাই ছিল আসল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে রাম গোপাল ভার্মা পরে অনেক ছবিতে ব্যর্থ হলেও এই ছবিতে খুবই সফল।

বিখ্যাত পরিচালক শেখর কাপুর এই ছবিকে বলেছেন, “সেই যুগের সব চাইতে স্মার্ট ভিজ্যুয়াল ও মিউজিক্যাল মুভি।”

শেখর কাপুর আর বিধু বিনোদ চোপড়াকে মাথায় রেখেই এই ছবির এক চরিত্র আছে নাম, স্টিভেন কাপুর। গুলশান গ্রোভারের যে কমেডিক অভিনয় স্টিভেন কাপুর চরিত্রে- তা অনেকদিন মনে রাখার মতো।

অত্যন্ত ব্যবসা সফল ‘রঙ্গিলা’, ১৯৯৫ সালের সব চাইতে বড় প্রশংসিত হিট সিনেমা। সাত সাতটা ফিল্মফেয়ার পেয়েছিল সে বছরে।

বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপমা চোপড়া বলেছিলেন, “আমি প্রথম যেদিন এই ছবিটা হলে দেখি, মনে হয়েছিল বলিউডে এরকম কিছু আগে কখনও দেখিনি। সামথিং ওয়ান্ডারফুল।”

তখন এই ছবি অনেক কিছুই বদলের ঘোষণা দেয়, সময়টাও তখন টালমাটাল। সেই সময়ের ভেতরেও একটা অন্য আঙ্গিকের ছবি ‘রঙ্গিলা’।

এরপর কত কত সিনেমা এর মতো বানানোর চেষ্টা হয়েছে কিন্তু সেই ‘ম্যাজিক’ আর নেই।

হলিউডেও এই ছবির রিমেক হয়েছে ২০০৪ সালে। কেইট বসওর্থ, টপার গ্রেস এবং জোশ ডুহামেল অভিনীত ছবির নাম, ‘উইন এ ডেইট উইথ টেড হ্যামিল্টন’।

পরিচালক রাম গোপাল জানতেন ছবিটা তেমন লজিক্যাল না, তাও তিনি বলেছিলেন, “সিনেমার ড্রামা বাস্তবের চাইতেও বেশি যুক্তিগ্রাহ্য।”

এটাই তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন।

অনুরাগ ক্যাশপের মতো বড় পরিচালক পর্যন্ত মেনে নেন নব্বই দশকের রাম গোপাল ভার্মার কৃতিত্ব।

এই সিনেমার পর ‘সত্য’ গোপাল ভার্মাকে সে সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ও আলোচিত চলচ্চিত্র পরিচালকে পরিণত করেছিল।