জন্মশতবর্ষে ভুলে যাওয়া মোহিনীকে স্মরণ

মোহিনী চৌধুরীর লেখা ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’, ‘শুনি তাকদুম তাকদুম বাজে’ -সহ অনেক গান এখনো মুখে মুখে ফেরে৷ কিন্তু কালজয়ী গীতিকার জন্মশতবর্ষেও অনেকটাই উপেক্ষিত৷

পায়েল সামন্ত, ডয়চে ভেলে বাংলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2020, 05:25 AM
Updated : 20 Sept 2020, 06:24 AM

সংগীতের চর্চায় বরাবরই গীত রচয়িতাদের একটু লঘু চোখে দেখা হয়৷ গান হয়ে যায় কণ্ঠশিল্পীর৷ কখনো-সখনো জনপ্রিয় গানের সুরকার কিছুটা কৃতিত্ব পেলেও আড়ালে থেকে যান গীতিকার৷ এই আড়ালে থাকার বেদনা সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন মোহিনী চৌধুরী৷

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বাংলা আধুনিক গানের জগতে বহু জনপ্রিয় গানের রচয়িতার জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে চলতি বছরে৷

১৯২০ সালে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে জন্ম মোহিনী চৌধুরীর৷ চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে তার গীতিকার জীবনের শুরু৷ এক দশক না ঘুরতেই বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল গীতিকবির লেখা অনেক গান৷

তার লেখা ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছ ‘ আজো বাঙালির শ্রুতির সঙ্গী হয়ে আছে৷ তিনি বেঁচে আছেন ‘দিনদুনিয়ার মালিক’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’-এর মতো কালজয়ী, জনপ্রিয় গানের মধ্যে৷

সিনেমার গানেও তিনি প্রতিভার ছাপ রেখেছেন৷ ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবিতে ‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি’ বা ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হলো’ আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে৷

কিন্তু ক’জন জানেন, এসব গানের গীতিকার কে?

জীবদ্দশায় অনেক উপেক্ষা সহ্য করেছেন মোহিনী চৌধুরী৷ তার লেখা গান ‘প্রচলিত’ তকমা নিয়ে বাজারে চলেছে৷ তিনি যে গান লিখেছেন, তার গীতিকার হিসেবে প্রচারিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, মীরা দেববর্মন বা কখনো প্রিয়ব্রতর নাম৷

এজন্য তার বেদনা কতটা গভীর ছিল, তা দেখেছেন প্রয়াত গীতিকারের ছেলে দিগ্বিজয় চৌধুরী৷ তিনি বলেন, ‘‘বেঁচে থাকতেই তিনি যথেষ্ট উপেক্ষা সহ্য করেছেন৷ ১৯৮৭ সালে বাবার প্রয়াণের আগে অনেকে জানতেন না, তিনি বেঁচে আছেন৷ তিনি অর্থ চাইতেন না, চাইতেন নিজের কাজের স্বীকৃতি৷”

বাবার জন্য বারবার বিভিন্ন জায়গায় দরবার করেও সেই স্বীকৃতি আদায় করতে পারেননি দিগ্বিজয়৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বেহালায় ‘মোহিনীকুঞ্জ’ নামে একটি পার্ক তৈরি হয়েছে৷ হয়েছে বুস্টার পাম্পিং স্টেশন৷

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি সংবাদপত্র মোহিনী চৌধুরীর পংক্তি নিয়ে শিরোনাম করেছিল- ‘মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের তরে নয়৷’

কিন্তু তাতেও কি প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে? সংগীতশিল্পী শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘বাংলা গানকে আমি-তুমির প্রেমগাথা থেকে মোহিনী চৌধুরী দেশভাবনা ও গণচেতনার দিকে এনেছিলেন৷ অন্য মাত্রা যোগ করেছিলেন৷ এ জন্যই তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত৷ কিন্তু আমরা তাকে ভুলে গেছি৷’’

মোহিনী চৌধুরী পরিচালিত একটি চলচ্চিত্রের পোস্টার

শুভেন্দু মাইতি বলেন, কণ্ঠশিল্পীরা গানের আসরে গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর গান গাওয়ার সময় তার নাম বলতেন না৷ এ কারণে অনেক বিভ্রান্তি দেখা দিতো৷ তবে ব্যতিক্রম ছিলেন সবিতাব্রত দত্ত৷ তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় মোহিনী চৌধুরীর নাম উল্লেখ করতেন৷

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একবার কলকাতার ব্রিগেড ময়দানের সভায় গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ সেখানে শিল্পী সবিতাব্রত গীতিকারের নাম বলে গেয়েছিলেন ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ ৷ প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন আবেগরুদ্ধ মোহিনী৷

শুধু মঞ্চে নাম উল্লেখ নয়, সবিতাব্রতই ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় গীতিকার মোহিনী চৌধুরীকে নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছিলেন৷

মোহিনী চৌধুরীর জীবন ছিল বর্ণময়৷ সংগীত রচনা থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনার জগতে এসে সাফল্য পাননি৷ তারপর সৃষ্টিশীলতার দুনিয়া ছেড়ে দেন৷ বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহার সংসদীয় সচিবের দায়িত্ব নেন৷ তারপর এক বাঙালি শিল্পপতির সহকারীর চাকরিও করেছেন৷

দীর্ঘ বিরতির পর গানের জগতে ফিরে আসেন মোহিনী৷ এইচএমভির প্রাক্তন কর্তা ও হিন্দুস্তান রেকর্ডসের উপদেষ্টা অমল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গীতিকার হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল৷ তিনি অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ার অনেক বছর পর যখন ফিরে আসেন, তখন অন্য গীতিকাররা সেই স্থান দখল করে নিয়েছেন৷”

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, শচীন দেববর্মন, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কমল দাশগুপ্তের মত সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন মোহিনী৷ তাহলে এই বিস্মৃতি কি স্বাভাবিক?

দিগ্বিজয় চৌধুরী মনে করেন, ১৯৬১সালে আকাশবাণীর সঙ্গে রেকর্ড কোম্পানির সংঘাতেরও শিকার হতে হয়েছিল তার বাবাকে৷ গীতিকার হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান কখনোই পাননি, পাননি রয়্যালটি৷ গানপ্রতি মাত্র ৬ টাকা সম্মানী পেয়েছেন৷

১৯৮৭ সালের ২১ মে রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে ফেরার পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মোহিনী চৌধুরীর মৃত্যু হয়। এ বছর তার স্মরণে কলকাতায় কিছু আয়োজন হয়েছে বটে৷ বেহালা শরৎ সদনে দুদিনের অনুষ্ঠান হয়েছে কানায় কানায় ভরা প্রেক্ষাগৃহে৷ গেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের নামী শিল্পীরা৷

করোনাভাইরাসের বাধায় বাকি অনুষ্ঠানের আয়োজন থমকে গেলেও এখনো বাতিল হয়নি৷ বাংলাদেশের শিল্পীদের উদ্যোগে হয়েছে মোহিনী স্মরণ৷ গত ৫ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের একটি সংস্থার উদ্যোগে ফেইসবুকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা লাইভ সংগীতানুষ্ঠান হয়েছে৷

দিগ্বিজয় জানান, জন্মশতবর্ষের আগে থেকেই বাংলাদেশ স্মরণ করেছে তার বাবাকে৷ বিটিভিতে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান হয়েছে জন্ম মাসে৷ তবে পশ্চিমবঙ্গের টিভি চ্যানেলগুলো মোহিনী চৌধুরীকে বলতে গেলে স্মরণই করেনি৷

জন্মশতবর্ষের আয়োজনে খেদ সামান্য মিটেছে গীতিকারের পরিবারের৷ দিগ্বিজয় চৌধুরী বলেন, ‘‘জন্মশতবর্ষে এসে উপেক্ষা কিছুটা দূর হয়েছে৷ তাকে ঘিরে অনুষ্ঠান হয়েছে, আলোচনা চলছে৷ কিন্তু যে যন্ত্রণা নিয়ে তিনি চলে গিয়েছেন, সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার সুযোগ আর নেই৷”