উত্তমপর্বের উত্তম

উত্তম কুমারকে নিয়ে বোধ করা যায় সহস্র গল্প জমে আছে উপমহাদেশের মাটিতে। বছরে শুধু দুইদিনও যদি তাকে স্মরণ করে গল্প বলা হয় তাহলে লাগবে অন্তত শত বছর।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2020, 06:48 AM
Updated : 3 Sept 2020, 06:48 AM

উত্তম কুমারের জন্মদিন উপলক্ষ্যে এই গল্প জানানোর কাজটি এবার করলেন আরাফাত শান্ত।

উত্তম কুমা্রের 'অমানুষ' ছবির কাজ চলছে, দৃশ্যধারনে তারা লঞ্চে। সুন্দরবনের ওদিকে কাজ চলছে। কাজ করতেই করতেই সন্ধ্যা নেমে গেল। লঞ্চ চালক আবার চিনেনা, পথ হারিয়ে ক্রমশো তারা গহীন বনের দিকে গেল। ওদিকে ইউনিটের এত মানুষ। শর্মিলা ঠাকুর আতংকিত। উৎপল দত্ত মজা নিচ্ছে, আশেপাশে বাঘ ডাকে, ঠাকুরকে বলে, দেখো তোমার স্বামী টাইগার ডাকে। তো এর ভেতরে পরিচালক শক্তি সামন্ত এক জায়গায় আলো দেখে থামালেন। দেখলেন একটা চা এর দোকান। নেমে আলাপ করলেন। সেই লোক দোকানী জীবনের প্রথম উত্তম কুমারকে দেখে কাঁপছে। তো একটু পর সেই লোক এক কেটলী চা আর মুড়ি আনলেন। একটু পর দেখা গেল শত শত হারিকেন, হাজার হাজার লোক, চারিদিকে লোক চিৎকার করছে, গুরু গুরু বলে। উত্তম কুমার ছাঁদে দাড়ালেন, লঞ্চের আলোয় সবাইকে প্রনাম করলেন। সেদিন উৎপল দত্ত বললেন, লঞ্চ পথ হারালো বলেই তো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা পেলাম।

এক পার্টিতে এক নায়ক দু তিন পেগ মদ খেয়েই বাজে বকছেন। তিনি জানাচ্ছেন, উত্তম কুমার একটা নায়ক হলো। ওরকম হ্যাংলা নায়ক দুদিনেই হওয়া যায়, আরো আজেবাজে কথা। সদ্য প্রয়াত অভিনেতা মৃণাল মুখোপাধ্যায়ের ব্যাপারটা ভালো লাগছিল না। উনি বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই নায়ক বাইরে এসেও মাতলামি করছেন। তো মৃণালের সাথে কথা কাটাকাটি হলো। সেই নায়ক মারকুটে স্বভাবের, অযথাই হাতাহাতি শুরু করলেন। মৃণাল বারবার সতর্ক করছেন ভালো হবে না। তো বিরক্তিতে আর্মি মেডিকেল কোর ফেরত মৃণালের দু মিনিটও লাগলো না সেই মাতাল নায়ককে মেরে শুইয়ে দিতে। পরেরদিন উত্তম কুমার মৃণালকে না দিলেন বাহবা, না করলেন ভৎসনা। খালি প্রশ্ন করলেন, 'তুই তো আমাকে ভালোবাসিস বলেই এ কাজটা করলি? তো কাকে বেশি ভালোবাসিস? নায়ক উত্তম কুমারকে নাকি এই আমাকে?' মৃণাল তখন এক জুনিয়র অভিনেতা, এত বড় প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন। উত্তম কুমার নিজেই বললেন, 'সবাই স্টার উত্তম কুমারকে ভালোবাসে কেউ আমাকে ভালোবাসে না।' একটা মানুষ কতটা একাকী হলে এ ধরনের কথা বলতে পারেন!

উত্তম কুমার গোয়েঙ্কা কমার্শিয়াল কলেজ থেকে বি কম পাশ করে পোর্ট কমিশনে ক্লার্কের চাকরি করতেন। সিনেমাতে বিখ্যাত হবার আগে এটাই ছিল তার আয়ের একমাত্র উৎস। অফিসের সবাই তাকে স্নেহ করতো। কাজে না গেলেও বেতন কখনো কাটা হয় নাই। প্রথম দিকে তার ছবি তেমন চলছিল না, অনেকেই বুদ্ধি দিল চাকরীটাই করো, পরে যখন দেখলেন সাফল্য পাওয়া শুরু করেছেন তখন চাকরীটা পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে দিয়েছেন।

যে মেকআপ রুমে উত্তম কুমার তৈরি হতেন সেটা চল্লিশ বছর পরেও এখনো আছে সেভাবেই। প্রতিদিন তা খুলে পরিষ্কার করা হয়। সেভাবেই রাখা হয়েছে। দেখলে মনে হবে উত্তম কুমার মনে হয় আজও আসেন এখানে।

উত্তম কুমার শিল্পী সংঘের জন্য অনেক কিছু করেছেন।  কলকাতার বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে সম্মানী পে্লেই সেই টাকাটা সেই দুস্থ শিল্পীদের ফান্ডে দিয়ে দিতেন। তিনি শিল্পী সংঘের সভাপতিও ছিলেন। ১৯৭৮ সালে কলকাতায় বন্যা হয়। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য চ্যারিটি ম্যাচ আয়োজন হয়। বোম্বে থেকে নামকরা সব হিরোরা এসে সেই আয়োজনে শামিল হোন। শিবাজী গনেশান থেকে অমিতাভ বচ্চন কে ছিল না সেই আয়োজনে।

উত্তম কুমার ছিলেন সত্যিকারের ক্রীড়াবিদ। তিনি তারুণ্যেই সাঁতার ক্লাবে যোগ দিয়েছেন। ফুটবল খেলতেন। মোহনবাগানের ছিলেন একনিষ্ঠ সমর্থক। যে সমস্ত বড় প্লেয়ার অন্য ক্লাবে খেলতেন তাদেরকে ঠাট্টা করে বলতেন, 'তোমরা মোহনবাগানে কেন যে খেলছো না? ওয়েস্ট অফ ট্যালেন্ট'। ভলিবল আর ক্রিকেটেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। যত রাত পর্যন্তই তিনি পার্টি করেন না কেন, সকালে উঠে তিনি দৌড়াতে বের হতেনই। বৈজন্তীমালার সাথে 'ছোটি সি মুলাকাত' করার আগে তিনি ভীষন নার্ভাস ছিলেন। এত বড় ড্যান্স জানা নায়িকার সাথে নাচতে হবে ভেবে তিনি দিনরাত নাচের প্র্যাক্টিস করতেন।

শক্তি সামন্ত পরিচালিত 'আনন্দ আশ্রম' ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল উঁচু ডিবি থেকে উত্তম কুমার নামতে নামতে আসবেন, নায়িকার সাথে সংলাপ বলবেন। তো তখন অলরেডি উত্তম কুমারের দু দুটো হার্ট এট্যাক হয়েছে। উত্তম কুমার অনেক কষ্টে সেই বয়সে উচু জায়গায় উঠলেন। তখন পরিচালক শক্তি সামন্ত ভুল বুঝতে পারলেন, মাফ চাইলেন। বলতেছে সেট চেঞ্জ করতেছি। উত্তম কুমার বললেন ও কিছু না। সেই শরীর নিয়েই তিনি দোতালা সমান ঢিবি থেকে আবার দৌড়ে নেমে এক পাতা সংলাপ এক শটেই ওকে করলেন! 

এই হল উত্তম। তবে কী গল্প শেষ? মোটেই না। বাকী আছে জানার আরও অনেক কিছু!