চলচ্চিত্র অভিনেতার পাশাপাশি তিনি একজন প্রযোজক ও পরিচালক।
তার কাজের নানান সময়ের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি মেলে ধরেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’য়ের পাঠকদের কাছে। সেসব স্মৃতি গ্লিটজের জন্য তুলে ধরেছেন মো. কামরুজ্জামান মিলু।
১৯৭২ সালের ২৪ জুন ‘আমার জন্মভূমি’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন তিনি। শুটিং করতে করতে একটা সময় এফডিসির ফ্লোরগুলো হয়ে ওঠে তাঁর ভীষণ প্রিয়।
এক, দুই, তিন ও চার নম্বর শুটিং ফ্লোরে ধীরে ধীরে ব্যস্ততা শুরু হয় তার।
শাবানা, ববিতা, কবরী, রোজিনাসহ জনপ্রিয় সব তারকাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন দশবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
আর এসব সিনেমার বেশিরভাগই শুটিং হয়েছে এফডিসির চেনা ফ্লোরগুলোতে। তিন ও চার নম্বর ফ্লোরেও তাঁর স্মৃতির শেষ নেই। তবে সেই ফ্লোর তো আর থাকছে না।
চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি)’র আয় বাড়ানো এবং আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে ভেঙে ফেলা হচ্ছে তিন ও চার নম্বর শুটিং ফ্লোর। সেখানে তৈরি হবে ১৫ তলা বিএফডিসি কমপ্লেক্স।
স্মৃতির পাতা হাতড়ে আলমগীর বলেন, “চার নম্বর ফ্লোরের মেইকাপ-রুমটি ব্যবহার করি আমার অভিনীত প্রথম সিনেমার সময়। ছবির নাম ছিল ‘আমার জন্মভুমি’। এ ছবির শুটিং সেট পড়েছিল এফডিসিতে।”
“ছবিটি ছিল শাবানার সঙ্গে আমার জীবনের প্রথম শুটিং। সাড়ে তিন নম্বর নামের এই ফ্লোরে স্টোরের মতো ছিল যেটা সেট হিসেবে ‘দস্যুরানী’ ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের কথা এটি।”
“এ সিনেমার বাসর রাতের একটি দৃশ্যের শুটিং এখানে করা হয়েছিল। সেদিনই ছিল শাবানার সঙ্গে আমার প্রথম শুটিং।”
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, “সেদিন বেশ নার্ভাস ছিলাম আমি। তবে পরে শাবানার সহযোগিতায় সেই নার্ভাসনেসটা কেটে যায়। এই স্মৃতিটুকু এখনও মনে আছে আমার।”
এদিকে ১৫-২০ দিন ধরে আগের সময় টানা এফডিসির ভেতর বিভিন্ন লোকেশনে শুটিং হত বলেও জানান তিনি। বড় বড় সেটে কাজ হত। নায়ক হিসেবে দীর্ঘ সময় কাজ করার কারণে এই এফডিসির তিন ও চার নম্বর ফ্লোরে অনেক স্মৃতি জমা রয়েছে তার।
“অনেককে আমরা এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছি। তখন এফডিসিতে সাত ও আট নম্বর শুটিং ফ্লোর ছিল না। এক, দুই, তিন ও চার নম্বর ফ্লোরগুলোতে কাজ হত সেসময়। সবার স্মৃতিতে এসব ফ্লোরে জড়িত। সুখে ও দুঃখে এখানেই তো আমাদের দিন কাটতো।”
নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল নায়ক আলমগীরের।
সেই স্মৃতির কথা জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, “চার নম্বর ফ্লোরের করিডরে রাজ্জাক ভাইয়ের একটা নিজস্ব রুম ছিল। কারণ তিনি তখন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই বলতে গেলে শুটিং করতেন। এফডিসিতে টানা শুটিংয়ের কারণে দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়ই থাকতে হত তাঁকে।”
“তখন আমাদের হাতে দুতিনটার মতো সিনেমা থাকত। তাই আড্ডা মারতে যেতাম ওনার ওখানে। একা যেতাম না। আমার সঙ্গে প্রয়াত গুণী ক্যামেরম্যান মাহফুজসহ যেতাম। কারণ মাহফুজ আমার ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। মাহফুজকেও রাজ্জাক ভাই খুব স্নেহ করতেন।”
স্মৃতির পাতা থেকে আলমগীর আরও বলেন, “শুরু থেকেই রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। বয়সে বড় হলেও বন্ধুর মতো মেশার সুযোগ করে দিয়েছিলেন আমাকে। যদিও আমার ও রাজ্জাক ভাইয়ের বন্ধুত্বটাকে আমি ‘ফ্রেন্ড’ হিসেবে নিতাম না। আমি এটাকে ধরতাম ‘ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড।”
“রাজ্জাক ভাইয়ের একটা গাড়ি ছিল, যার নাম্বার প্লেট ছিল-৫৫৫১। ওই গাড়ি দেখলে বুঝতাম রাজ্জাক ভাই এফডিসিতে আছেন।”
সবশেষ নায়ক আলমগীর তার অভিনীত, প্রযোজিত ও পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবির কাজ চার নম্বর ফ্লোরে করেছেন। যেথায় অভিনয় করেছেন কলকাতার অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা। নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন আরিফিন শুভ।
এ ছবির স্মৃতি নিয়ে নায়ক আলমগীর বলেন, “মধুর স্মৃতিগুলো খুব একটা ধরে রাখতে পারিনি তখন। কারণ আমি এ সিনেমার পরিচালক, প্রযোজক ও অভিনেতা হওয়ার কারণে বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। তবে একটা স্মৃতি রয়েছে যা আমাদের ‘ইয়াং জেনারেশন’য়ের জন্য উদাহরণ হতে পারে।”
“একজন অভিনয় শিল্পী একটি ভালো কাজ দর্শকদের উপহার দেওয়ার জন্য কতটা ডেডিকেশনের সঙ্গে কাজ করতে পারেন তা দেখেছি। বলছি ওপারের জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী ঋতুপর্ণার কথা।”
“একটি সিনেমার গল্প’ ছবিতে শেষ দৃশ্যে ঋতুপর্ণা মারা যায়। এ দৃশ্যটা করার সময় চার নম্বর ফ্লোরে মেইকাপ নিয়ে সকাল ১১টায় শুটিং শুরু করি। আর দৃশ্যটা শেষ করি রাত সাড়ে ১০টায়। এই সময়ে টানা কাজ হয়েছে। মাঝে দুপুরের খাবারের বিরতি থাকলেও ‘সিকোয়েন্স’ শেষ না করে ওই জায়গা থেকে (যে বিছানায় দৃশ্যটা ছিল) একবারও ওঠেননি ঋতুপর্ণা। শুধু দুপুরে কিছু ফল খেয়েছিলেন। সেটাও বিছানায় খেয়েছেন। কিন্তু এক মিনিটের জন্যও উঠে বসেননি, শুয়ে ছিলেন।”
“একটি ক্যারেক্টারে ঢুকতে হলে কতটুকু মনোযোগী হতে হয় সেদিন আমি ঋতুপর্ণার শট নেওয়ার সময় দেখেছি।”
“জায়গাটার নাম তো চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য কী হবে আমরা সত্যি জানি না। কারণ আমাদের এফডিসি এসব বিষয়ে জানায়নি। আর এটা যদি তাদের অফিসার বা কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য হয় তাহলে সেটা দুঃখজনক। ফ্লোর দুটি না ভেঙেও করা যেত বলে মনে হয় আমার।”
“নতুন এই কমপ্লেক্সে শপিং মল বা দোকান চলবে কি-না সেটা নিয়ে উপযুক্ত স্টাডি, মানে ‘মার্কেট ফিজিব্যালিটি স্টাডি’ ঠিক মতো হয়েছে কি-না সেটাও দেখার বিষয়। নতুন কমপ্লেক্স করার আগে আর্টিস্টদের সঙ্গে বসে মতামত নেওয়ারও দরকার ছিল বলে মনে করি।”
তিনি আরও বলেন, “ঢাকার অদূরে কবিরপুর ফিল্ম সিটিতে যদি বোম্বের মতো থ্রিস্টার/ ফোরস্টার মানের হোটেলের সুবিধা শিল্পীদের জন্য দেওয়া হয় তাহলে সেখানে টানা থেকে একটা সিনেমার কাজ শেষ করা যাবে। না হলে আসা-যাওয়া করে কোনো শিল্পী ওই স্পটে গিয়ে কাজ করতে চাইবেন না। সেই সঙ্গে তো প্রযোজকদের সিনেমার বাজেটও বেড়ে যাবে।”
তাই সবদিক বিবেচনা করে এফডিসি সিনেমার শুটিংয়ের জন্য এখনও উপযুক্ত জায়গা বলে মনে করেন তিনি। সেই সঙ্গে পুরানো ফ্লোরগুলোর ভাঙার খবরে মর্মাহত হন এই নায়ক।
কারণ এই ফ্লোরগুলোতে জড়িয়ে আছে এই তারকার অতীতের অনেক স্মৃতি।