কাল্পনিক চরিত্রে জমেছিল ‘কফি হাউসের সেই আড্ডা’

নিখিলেশ যেমন প্যারিসে থাকেন না, কাগজের রিপোর্টার মঈদুলের সঙ্গেও বাস্তবের কারও মিল নেই। নাটকের রমা রায়, গিটারিস্ট ডি সুজা কিংবা কবি কবি চেহারার অমল- সব চরিত্রই আসলে কাল্পনিক।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2020, 04:00 AM
Updated : 2 August 2020, 01:09 PM

বাঙালি শ্রোতার মনে যুগ যুগ ধরে যে গানের কথা আর সুরে মিশে এই সব চরিত্রেরা প্রাণবান হয়ে আছে, বাস্তবে তাদের কারোরই দেখা মিলবে না বলে জানালেন এ গানের সুরস্রষ্টা সুপর্ণকান্তি ঘোষ।

গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি মান্না দে কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে। প্রায় চার দশক পেরিয়ে এসেও সে গান আজও অমলিন।

দুই বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরা এ গানের চরিত্র মঈদুল, সুজাতা, নিখিলেশ, ডি সুজা, রমা রায়, অমলকে যুগ যুগ ধরে বাস্তবে খুঁজে এসেছেন শ্রোতারা।

বাংলাদেশের শ্রোতাদের কাছে কাগজের রিপোর্টার মঈদুল হিসেবে প্রয়াত ক্রীড়ালেখক ও সাংবাদিক নূর আহমেদ মঈদুলকে গণমাধ্যমে তুলে আনা হয়েছে। তবে গানটির অন্যতম স্রষ্টা সুপর্ণকান্তি ঘোষ বলছেন, শুধু মঈদুল নয়, গানের কোনও চরিত্রের সঙ্গেই বাস্তবের কারও মিল নেই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “কেউ যদি বলে, সে ডনাল্ড ট্রাম্প কিংবা সুনীল গাভাস্কার, তাহলে আমি কী করব? আমার কিছুই বলার নেই। এগুলো সব মিথ্যা কথা। গানের সব চরিত্রই কাল্পনিক।”

মান্না দে’র সঙ্গে সুপর্ণকান্তি ঘোষ। ছবি: সুপর্ণকান্তি ঘোষের অ্যালবাম থেকে নেওয়া

১৯৩৬ সালের ১৩ জানুয়ারি কলকাতার উত্তর চব্বিশ পরগনায় জন্ম নেওয়া নূর আহমেদ মঈদুল ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময় পরিবারের সঙ্গে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। কলকাতার ক্রীড়াঙ্গনের সরব খেলোয়াড় মঈদুল ঢাকায় আসার পর কয়েকটি ক্লাবের হয়েও ব্যাডমিন্টন ও ফুটবল খেলেছেন।

খেলাধুলা নিয়ে পত্রিকায় লেখা শুরু করেন ১৯৬৬ সাল থেকে; নিয়মিত লিখতেন দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, ইনকিলাব, সংবাদ, বাংলার বাণী ও দৈনিক পূর্বদেশে।

২০১৪ সালে ৭৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তখন অনেক পত্রিকার খবরে তাকে কফি হাউসের সেই মঈদুল বলেই লেখা হয়েছিল। 

বেঁচে থাকতে বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নূর আহমেদ মঈদুলও নিজেকে ওই গানের চরিত্র বলে দাবি করেছিলেন। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে কফি হাউসে বসে রমা রায় ও সুজাতাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার কথা, কিশোর বয়সে পরিচয় হওয়া কণ্ঠশিল্পী মান্না দের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথাও তিনি বলেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে।

এই নূর আহমদ মঈদুল কি তবে কফি হাউসে আড্ডা পেটানো সেই সাত জনের একজন কাগজের রিপোর্টার মঈদুল?

সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে সুপর্ণকান্তি ঘোষ বললেন, “মঈদুল নামে কলকাতা শহরেই কতগুলো লোক আছে, তারা যদি বলে, তারা এই গানের চরিত্র-তাহলে আর কী বলব!”

 

শুধু কাগজের রিপোর্টার মঈদুল নয়, কলকাতাতেও অনেকে এ গানের কোনো চরিত্র বলে দাবি করেছেন নিজেকে, যা নিয়ে ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বলে জানালেন সুরকার সুপর্ণকান্তি।

“চল্লিশ বছর বাদেও গানটা এমন জনপ্রিয় যে, এভরি ডে প্যারোডি হচ্ছে। কেউ বলছে, আমি সুজাতা, কেউ বলছে, আমি কফি হাউসের বেয়ারা! এই সমস্ত বলে বেড়াচ্ছে, আমি কী করব!”

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এই গানে ছয়টি চরিত্রের দেখা মেলে; সাত নম্বর চরিত্রটির নাম জানা যায় না সেখানে, তবে পুরনো বন্ধুদের কথা মনে করে সেই চরিত্রের স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠা নিয়েই এ গান।

মান্না দের গাওয়া ‘সে আমার ছোট বোন’ গানটিতেও সুর করেছিলেন সুপর্ণকান্তি ঘোষ

গানের এসব চরিত্রের সঙ্গে কেউ নিজের নামের মিল পেলেই কফি হাউসের আড্ডার বন্ধুদের একজন হতে চান জানিয়ে সুপর্ণকান্তি বলছেন, “সুজাতা চ্যাটার্জি নামে আমার এক বন্ধু আছে; হাওড়ায় শিক্ষকতা করেন। তাই বলে কি গানটি তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে?

“নামের মিল থাকলেই নিজেকে চরিত্র হিসেবে মেলানো যাবে না। আর মেলাবেই কেন? গানের চরিত্রগুলোই তো কাল্পনিক।”

তবে গানের চরিত্রের সঙ্গে অনেকের জীবনের গল্প মিলে যায় বলেই শ্রোতারা বাস্তব জীবনে গানের চরিত্রগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করেন বলে সুপর্ণকান্তির ধারণা।

উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোপাশের কফি হাউসটি কলকাতার বুদ্ধিজীবী আর তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মীদের আড্ডাস্থল হিসেবে পরিচিত বহু আগে থেকেই।

তবে ১৯৮৩ সালে গানটি লেখার আগে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বা সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষের কেউ কফি হাউসে যাননি। শিল্পী মান্না দেও তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন, তিনিও গান প্রকাশের আগে কফি হাউসে কখনও আড্ডা দেননি।

সুপর্ণকান্তি ঘোষ বলেন, “কফি হাউসে সরাসরি আড্ডা থেকে নয়, কল্পনা থেকে আমাদের বাসায় বসে গানের প্রথম স্তবক লিখেছিলেন গৌরী কাকা, গানের আইডিয়াটা ছিল আমার।”

তবে গান প্রকাশের পর কফি হাউসে গিয়েছিলেন সুপর্ণকান্তি; কিছুদিন আগেও সেখানে একটি অনুষ্ঠান করে এসেছেন।

যেভাবে জমে উঠেছিল কফি হাউসের সেই আড্ডা

সুরকার নচিকেতা ঘোষের ছেলে সুপর্ণকান্তি ঘোষ তখন ‍সুরকার হিসেবে সবে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। ১৯৭৮ সালে তার সুরে প্রথম গান ‘সে আমার ছোট বোন’- এ কণ্ঠ দেন মান্না দে। গানটি প্রকাশেরই পরপরই শ্রোতামহলে পরিচিতি পান সুপর্ণকান্তি।  

কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের সেই কফি হাউস

গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তখন তাদের নিউ আলিপুরের বাসায় তার বোনকে পড়াতে যেতেন। গৌরীপ্রসন্নকে কাকা ডাকতেন তিনি।

একদিন হাঁক দিয়ে গৌরীপ্রসন্ন বললেন: “কী করছিস? বিড়ি টানছিস না কি আড্ডা দিচ্ছিস?“

সুপর্ণকান্তির জবাবে: “বিড়িও খাচ্ছি না, আড্ডাও দিচ্ছি না।”

এই আলাপের ফাঁকে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে সেদিন সুপর্ণকান্তি বলেন: “আড্ডার কথা বলছ? আড্ডা নিয়ে একটি গান লেখো না...।”

পাল্টায় গৌরীপ্রসন্ন বলেন: “আড্ডা নিয়ে বাংলায় গান হয় নাকি?”

নাছোড়বান্দার মত সুপর্ণকান্তিও বলেন: “তুমি তো পারো না, সবাই পারে। কফি হাউসে কত লোক আড্ডা মারে।”

এরপর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখে ফেললেন গানের প্রথম স্তবক ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’।

ওটুকু শুনেই সুর করে ফেললেন সুপর্ণকান্তি। সেই রাতে লেখা হল গানের বেশিরভাগ অংশ। তবে শেষ করতে সময় লেগেছিল প্রায় দেড় মাস।

গোল বেঁধেছিল শেষ স্তবকটি নিয়ে। তবে সুপর্ণকান্তির চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত তিনি লেখেন দুর্দান্ত সেই লাইন- ‘সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে, সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই…’।

“গৌরী কাকাকে গানের শেষ স্তবকটা যুক্ত করতে আমি বাধ্য করেছি। চিকিৎসা করাতে চেন্নাই যাওয়ার পথে ওই স্তবকটা তার মাথায় এসেছিল; হাওড়া স্টেশনে সিগারেটের প্যাকেটের নিচে সেটা লিখে একজনের মাধ্যমে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তখন তো আর মোবাইল ছিল না।”

পুরো গান লেখা আর সুর দেওয়া শেষ হলে মান্না দে গানটি রেকর্ড করেন। প্রায় সাড়ে ছয় মিনিট দৈর্ঘ্যের গানটি প্রকাশের তিন বছর পর ১৯৮৬ সালে মারা যান গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তার গানের চরিত্র অমলের মত তিনিও ক্যান্সারে ভুগছিলেন।

সুপর্ণকান্তি জানান, গানটি লেখার সময় গৌরীপ্রসন্নর মুখে একটা ঘা ছিল, তবে সেটা ক্যান্সার হিসেবে শনাক্ত হয় আরও পরে। 

আর উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে ফুসফুসের জটিলতায় ভুগে ২০১৩ সালে ৯৪ বছর বয়সে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।

কফি হাউসের সেই অমর গানের যখন জন্ম, সুপর্ণকান্তি তখন ২৫ বছরের তরুণ। এখন তার ৬২ চলছে, এখনও তিনি সুর দিয়ে যাচ্ছেন গানে।

সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্পান আর করোনাভাইরাস নিয়ে লেখা দুটো গানে সুর দিয়েছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন তিনি।