চলে গেলেন একজন ‘সুরমা ভোপালী’

নীরবে যাবার পথে আরেকজন পথিক হলেন, বলিউডের সুরমা ভোপালী’ জগদীপ। ‘শোলে’ সিনেমায় ‘জয়’ বা ‘বীরু’ যেমন দর্শকের মনে স্থান করে আছে- তেমনই সুরমা ভোপালী। জগদীপের এই চলে যাওয়া নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ মাহমুদ জামান শান্ত ।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2020, 08:36 AM
Updated : 11 July 2020, 06:33 AM

অন্য আর দশজনের মত মতো তিনিও চেয়েছিলেন বলিউডের ‘হিরো’ হতে। হয়েওছিলেন। ৫০ দশকের শেষভাগে নায়ক হিসেবে মুক্তি পায় বেশ কয়েকটি সিনেমা, এর মধ্যে ‘বারখা’ তে পুরোদস্তুর একক নায়ক। কিন্তু ভাগ্যবিধাতা তার কপালে লিখে রেখেছিলেন ভিন্ন কিছু। তাইতো জগদ্বীপকে নায়ক নয় ‘কমেডিয়ান’ হিসেবে চেনে সবাই।

বয়স ৮০ পার করেছেন গত বছর আর বলিউডে অভিনয় করছেন প্রায় সাত দশক! অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, তার শুরুটা শিশুশিল্পী হিসেবে। অবশ্য শিশুশিল্পী বললেও কিছুটা ভুল হয়, তিনি ছিলেন ‘এক্সট্রা’ শিশুশিল্পী। শুরু সেই ১৯৫১ সালে, দুই বছর ছোট খাট বেশ কয়েকটি চরিত্রের পর ১৯৫৩ সালে ‘লাইলি মজনু’ সিনেমায় প্রথম চোখে পড়ার মত চরিত্রে, ছোট বেলার কায়েস। সেটাও অবশ্য মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যই। এপর বেশ কয়েকটি ছোট চরিত্রের পর ভাগ্যে জুটলো ‘হাম পাঞ্ছি এক ডাল কে’। যাকে বলে এক সিনেমায় ভাগ্য বদলে গেল জগদ্বীপের। একের পর এক প্রশংসা আসতে থাকলো চারদিক থেকে। একদিন সকালে কাঁদা আর ভাঙা রাস্তা পাড় হয়ে একটি অ্যাম্বাসেডর গাড়ি এসে থামলো তাদের ছোট বাড়ির সামনে। দরজায় কড়া নাড়া হলো, খুলতেই অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন উচ্চ পদস্থ এক সরকারি কর্মকর্তা। জানালেন দুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সিনেমাটি দেখেছেন, এবং তিনি ছোট সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ জাফরি... মানে জগদ্বীপের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। ব্যস্ততার জন্য আসতে না পারলেও ছোট কিছু উপহার পাঠিয়েছেন। কিনে নয়, নিজের ব্যবহার করা কলমটি পাঠিয়েছিলেন নেহরু। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো সেই কলম কখনোই ব্যবহার করেনি জগদ্বীপ, আজীবন শোকেসে সাজিয়ে রেখেছেন জীবনের প্রথম পুরস্কারটি।

নায়ক চরিত্রে অভিনয় করতে থাকলেও জগদ্বীপ ঠিক তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না যেন। ৬০ দশকের পর তাই বদলে যেতে থাকে তার অভিনয়ের ধারা। পার্শ্ব চরিত্রে ঝুকে পরেন। তবে চরিত্রগুলোতে টুকটাক কমেডির ছোঁয়া লাগাতে লাগলেন নিজ উদ্যোগে। ভাগ্য ভাল পরিচালকদের সেটা ভালও লেগেগেলে। এরপর থেকেপরিচালকইরা বলতেন, এই তোমার চরিত্র, এই হলো সংলাপ, তবে তুমি তোমার মত করে বলে যাও। ব্যাস নিজেই নিজেকে তৈরি করতে লাগলেন। পুরোপুরি কমেডিয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান ১৯৬৮ সালের ‘ব্রহ্মচারি’ সিনেমা থেকে। ব্যাস হয়ে গেলেন পুরোদন্তুর কমেডিয়ান। এরপর আর সিরিয়াস চরিত্রে খ্বু একটা দেখা যায়নি জগদ্বীপকে। চরিত্র সিরিয়াস হলেও তার সংলাপ দিয়েই সেই চরিত্রের মধ্য দিয়েও দর্শকের মুখে হাসির ছোঁয়া দিতে পেরেছেন।

প্রায় সাত দশকের ক্যারিয়ারে (সর্বশেষ অভিনয় ২০১২ তে) অভিনয় করেছেন চার শতাধিক সিনেমায়। অভিনয় করেছেন অসংখ্য স্মরনীয় চরিত্রে। ‘সুরমা ভোপালী’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনাও করেন। যার নাম ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করেছন। জগদ্বীপের কোনো সিনেমার নাম বলুন, প্রশ্ন করলে হয়তো অনেকই সিনেমার নাম মনে করতে পারবেন না। কিন্তু সিনেমা মনে না থাকলেও তার চরিত্রের নাম মানুষের মনে গেঁথে আছে। অথচ আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কখনো কোনো চরিত্রের জন্য পুরস্কার তার ভাগ্যে জোটেনি। ২০০৪ সালে আইফা অ্যাওয়ার্ড তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। অবশ্য পুরস্কার না পেলেও তা নিয়ে দুঃখবোধ নেই জগদ্বীপের। বলেছেন, ‘দর্শকের হাসিমুখের চাইতে বড় পুরস্কার আর কী-ই বা হতে পারে’।   

আসলেই তো, তিনি যা উপহার দিয়েছেন তা কখনেই ভুলে যাওয়ার নয়। প্রায় ১৯০ মিনিটের ‘শোলে’ সিনেমায় জগদ্বীপের উপস্থিতি মাত্র দুবার তাও আড়াই মিনিট আর দুই মিনিট করে সর্ব সাকুল্যে মাত্র সাড়ে চার মিনিট! মুক্তি ৪৫ বছর পরও সিনেমার ‘জয়’, ‘ভিরু’ আর ‘গব্বর সিং’ এর পাশাপাশি মুদ্ধ দর্শক ‘সুরমা ভোপালী’র নাম ঠিকই মনে করে। এখানেই জগদ্বীপের সাফল্য।

অসুস্থ্য ছিলেন বেশ কয়েকবছর ধরেই। ভাল-খারাপ মিলিয়েই চলছিল শরীর। তবে অপেক্ষায় ছিলেন বড় ছেলের ঘরে নাতি মিজান জাফরির প্রথম সিনেমা দেখার। এখানেও ভাগ্যবিধাতার লেখা খণ্ডাতে পারলেন না। ৮ জুলাই রাত সাড়ে আটটায় নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। রওনা হলেন আরেক লম্বা সফরে।