আমাদের কিশোরদা:  ‘তুমি যে তোমারই তুলনা’

বাংলাদেশের সিনেমার গানে যার কণ্ঠ মিশে আছে শব্দে শব্দে, ছন্দে বা তালে- সেই কালজয়ী শিল্পী এন্ড্রু কিশোর চলে গেলেন অবশেষে। তাকে নিয়ে লেখার, গল্পের বা গানের শেষ নেই। আরাফাত শান্ত জানালেন তার জীবনের আরও কিছু গল্প - যা কখনোই হবার নয় অল্প!

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2020, 07:39 AM
Updated : 7 July 2020, 07:39 AM

এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুটা খুব বেশী আশ্চর্যের ছিল না। কারন গত দশ মাস ধরেই তিনি অসুস্থ। কর্কট বাসা বেঁধেছিল তার শরীরে। দুই দফায় চিকিৎসা করে সুস্থতার পথেই ছিলেন। কিন্তু ফিরে আসে আবার সেই রোগ। তাই তিনিও দেরী না করে জলদি ফিরে এলেন। কারন শেষবার নিজের মাতৃভূমিকে দেখতে হবে তো। এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। দেশমাতৃকা ছাড়া আসলে কোথাও এন্ড্রু কিশোর নিজের আপন ভাবেন নাই। নিজের শেষ দিকে গান ভাবনা বলতে দেশাত্মবোধক গানই গাইতে চাইতেন। আর কোনো নতুন গান তাকে টানতো না। সেই কবেই তো বোম্বের বিখ্যাত সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মন বলেছিলেন, থেকে যা, এখানেই বিখ্যাত হবি। তিনি অন্য ভূমে বিখ্যাত হতে চান নাই।

প্রশ্ন আসবে এন্ড্রু কিশোর কে? এক কথায় এর উত্তর, তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কালজয়ী প্লেব্যাক শিল্পী। এই উপমহাদেশে খ্যাতনামা  প্লেব্যাক শিল্পীরা যেমন হয় তিনি তেমনই একজন। বলা যায় তিনি সেই বিরল ধরনের শিল্পী যারা দশকের পর শুধু চলচ্চিত্রের গান গাইতো। চলচ্চিত্রকেই তারা ভাবতো জনসংযোগ ও বিনোদনের একমাত্র হাতিয়ার। এন্ড্রু কিশোর তাঁর কন্ঠ উজার করে চলচ্চিত্রকে দিয়েই গেছেন। চার দশক ধরে গেয়েছেন হাজার হাজার গান, বিরামহীন ভাবে। যে ছবিতে এন্ড্রু কিশোরের গান নাই, ভাবতে হবে সেই ছবি বয়কটের শামিলই। ১৯৫৫ সালে ৪ নভেম্বরের জন্ম তার।  মায়ের প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের জন্য নাম রাখা হলো কিশোর। সেই লিজেন্ড কিশোর কুমারের মতোই তিনি হলেন আমাদের এন্ড্রু কিশোর।

ওস্তাদ আবদুল আজিজ সাহেব গান শেখাতেন তার বড় বোনকে। কোনো কারনে বড় বোনের আর শেখা হলো না। ওস্তাদ খুবই কষ্ট পেলেন।

তখন মা বললো, কিশোরকে শেখান । ওস্তাদ মন প্রাণ ঢেলে শেখাতো ক্লাসিকাল , ফলাফল এল হাতে নাতে। বেতারের শিশু শিল্পী হলেন।

প্রচুর গাইতেন, সবধরনের গান। মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে ভারতে যান। সেখানে সারাদিন সিনেমা দেখা ও গান বাজনা শোনা, উনার মতে তার জীবনের অন্যতম সেরা সময়। দেশে ফিরে পড়াশোনায় মন দিলেন, বেতার থেকেও চিঠি আসলো, তালিকাভুক্ত শিল্পীর। রাজশাহীতে গান গাইছেন, কলেজে পড়ছেন, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ফাঁকে গান গাচ্ছেন। হাবলু ভাই নামে একজন কাছের লোক ছিল তাঁর। তিনি তাঁকে বলা শুরু করলেন, তোমার গলাটা সিনেমার গানের সাথেই যায়। হাবলু ভাই চেষ্টা করতেন কিশোরকে একটা চান্স দিতে। তখন বেতার থেকেও একটা উদ্যোগ নেয়া হয় নামকরা সংগীত পরিচালকদের সাথে তরুণ উদীয়মান শিল্পীরা কাজ করবে। ঢাকায় এসে তিনি দেবু ভট্টাচার্যের মত খ্যাতনামা লোকের সাথে কাজ করেন। তাঁর সাথেই আরেজন কাজ করছিলো প্রয়াত শিল্পী সুবীর নন্দী। তখন কেউ কেউ সুবীর নন্দীকে চিনে, রিকশায় ডাক দিচ্ছে। এটা দেখে কিশোরদার খুব ভালো লাগলো, এরকম বিখ্যাত হলেও তো মন্দ হয় না। সেই হাবলু ভাই আলম খানের সাথে যোগাযোগ করে দিলেন। আলম খানের সাথেই তাঁর চলচ্চিত্রে গান শুরু।

১৯৭৯ সালে প্রতিজ্ঞা চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গান গাওয়ার পর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাকে। তার গাওয়া ভালবেসে গেলাম শুধু, সবাই তো ভালবাসা চায়, আমার বুকের মধ্যে খানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, আমি চিরকাল প্রেমেরও কাঙাল, বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে- এমন অনেক গান এখনও মানুষের মুখে ফেরে। গান গেয়ে আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন তিনি। ৯০ এর দশকের শেষ দিক পর্যন্ত চলচ্চিত্রের গানে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তার। ওই সময়েও তার গাওয়া ‘পড়ে না চোখের পলক’ গানটি ছিল তুমুল জনপ্রিয়।

এন্ড্রু কিশোর বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পী যিনি তীব্র দর্শক চাহিদা থাকলেও টেলিভিশনে গান গাইতে আসেননি। মুখ দেখানোর যে কালচার তা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তার একমাত্র আরাধনা সংগীত নিয়েই। নিয়মিত সাধনা করতেন, মনে করতেন আজকেই তার শেষ দিন। এমনিতে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী ও শান্ত স্বভাবের। যখন বাংলাদেশের অডিও বাজার রমরমা। তখনও তিনি চলচ্চিত্র আর স্টেজ শোর বাইরে কোথাও গাইতেন না। বন্ধু হানিফ সংকেতের অনুরোধে টিভিতে গান গাওয়া শুরু করেন। তারপর অডিও অ্যালবামও বের করে দেখেন জনপ্রিয়তার মুখ। তিনি খুব কমই টিভিতে সাক্ষাৎকার দিতেন। বাংলাদেশ আইডল ছাড়া আর কিছুতেই নিয়মিত দেখা যায় নাই তাঁকে। সব সময় চাইতেন গানই হবে পরিচয়। বাংলার মানুষ যে প্রাণ ভরে গান শুনে সেটাই ছিল উনার প্রশান্তির। দেশে বিদেশে যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন তা অতুলনীয়।

নিশ্চিত ভাবেই এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে লেখা বন্ধ হলো গানের এমন এক অধ্যায়ের লেখা- যে গল্পটি কখনই অল্প না।