রাজশাহী সিটি কলেজে পড়ার সময়ই পূজা-পার্বণে গান গেয়ে পরিচিত পেলেও ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ বেতারের এক আয়োজনে গাইতে ঢাকায় এসে তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায়।
এন্ড্রু কিশোরের গান শুনে বাংলাদেশ বেতারের প্রযোজক দুলাল তাকে সুরকার আলম খানের কাছে নিয়ে যান। আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রের ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের গানে স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় তার।
আলম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “মনে আছে, গানটা তুলতে গিয়ে ও নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তোমাকে দিয়েই গানটা হবে। রেকর্ড হতে প্রায় তিন-চার ঘণ্টার মতো সময় লেগেছিল।”
তবে ছবিটি পরে আর মুক্তি পায়নি। পরে আলম খানের সুরেই ১৯৭৯ সালে এ জে মিন্টু পরিচালিত প্রতিজ্ঞা চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গানটি দিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে পরিচিতি লাভ করেন এন্ড্রু কিশোর।
তখনও তিনি রাজশাহীতে থাকতেন; আলম খান ফোন করলে ঢাকায় এসে ফকিরাপুলে বন্ধুদের মেসে উঠে গানের রেকর্ডিং শেষ করে ফিরে যেতেন।
১৯৮০ সালের বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঈদের সংগীতানুষ্ঠানে সুরকার শেখ সাদী খানের সুরে ‘ও আমার উদাস মন’ শিরোনামে একটি গান গাওয়ার সুযোগ পান এন্ড্রু কিশোর।
শেখ সাদী খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “এন্ড্রু কিশোর তখন বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন না। তখন অডিশন ছাড়া বিটিভিতে গাওয়া যেত না। কিন্তু আমি বিটিভির প্রযোজকদের বলে তাকে সেই অনুষ্ঠানে গানটি করিয়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই দর্শকরা এন্ড্রু কিশোরের চেহারা প্রথম দেখেছিল।”
ততদিনে ‘এক চোর যায় চলে’ গানের জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর আলম খানের আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানের সঙ্গে যুক্ত হন এন্ড্রু কিশোর। ব্যস্ততা বাড়তে থাকায় মাসে তিন-চার বারের মতো রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসতে হত তাকে।
আলম খান বললেন, “৮২ সালের দিকে ও বলল, ‘ভাই, ঢাকায় একেবারে চলে আসব। বললাম, চলে আসো। বললাম, থাকবা কোথায়? বলে, বন্ধুদের মেসে সিট নিয়ে নেব। বললাম, চলে আসো। তুমি তোমার যোগ্যতায় ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নেবে। সেই ভরসায় রাজশাহী ছেড়ে চলে এলো।”
বন্ধুদের সঙ্গে রুম ভাগাভাগি করে থাকতেন তিনি। পাশেই কমলাপুরের জসিম উদ্দীন রোডে থাকতেন আলম খান। তিনি ফোন দিলেই শ্রুতি স্টুডিওতে গান রেকর্ডিংয়ে যেতেন এন্ড্রু কিশোর।
আলম খানের হাত ধরে চলচ্চিত্রের গানে এলেও ধীরে ধীরে এন্ড্রু কিশোরের কাজের পরিধি বাড়তে থাকে।
সত্য সাহা, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দিন আলী, শেখ সাদী খানসহ অন্যান্য সুরকারের সঙ্গেও কাজ করেন তিনি।
শেখ সাদী খানের সুরে ‘আমি চিরকাল প্রেমেরও কাঙাল’, ‘ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও’, ‘দিওয়ানা প্রেম দিওয়ানা’ গান করে চেনা ইমেজ ভেঙে নতুনভাবে শ্রোতাদের সামনে হাজির হন এন্ড্রু কিশোর।
শেখ সাদী খান বললেন, “তাকে মেলোডির দিকে নিয়ে এসেছিলাম। তার ভয়েসটা ভালো ছিল বলেই তাকে দিয়ে মেলোডি গানে রাখার চেষ্টা চেষ্টা করেছিলাম।”
কয়েক বছর আগে ‘একই বৃত্ত’ শিরোনামে একটি চলচ্চিত্রে শেখ সাদী খানের সুরে ‘গনগনে আকাশ, বাতাস ছন্নছাড়া’ শিরোনামে একটি গানে কণ্ঠ দেন এন্ড্রু কিশোর। তারপর আর একসঙ্গে চলচ্চিত্রের গানে দেখা যায়নি তাদের।
আলম খানের সঙ্গেও শেষ গান করেছেন বছর দুয়েক আগে। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা শেষ গান ‘লেখা ফুলের গন্ধের মতো থেকে যাবো তোমার রুমালে’ কণ্ঠ দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর।
দশ মাস আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর নিয়মিতই তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আলম খান ও শেখ সাদী খানের।
আলম খান বললেন, “চারদিন আগে কথা হয়েছিল এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে। বলল, ভালো নাই আমি। দোয়া কইরেন, সুন্দর মতো চলে যেতে পারি। বললাম, কী বলো তুমি! ও বলে, সিঙ্গাপুরের ডাক্তার বলে দিয়েছেন। আমি আর ব্যাক করতে পারব না। সুন্দরভাবে যাতে যেতে পারি।”
দশ মাসের মতো ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে সোমবার হার মানলেন এন্ড্রু কিশোর।