‘সৌদামিনী’ সরোজের চলে যাওয়া

নাচের মঞ্চে নাচতেন হয়তো শ্রীদেবী বা মাধুরী, কিন্তু বিজলীর চমক নিয়ে তাক লাগাতেন সরোজ খান। যার দেখানো মুদ্রাতে নাচতো তারকার চোখ- হাত, আঙুল বা অবয়ব। সেই সরোজ খান চলে গেলেন হঠাৎ করেই। আর তাকে নিয়ে লিখলেন আরাফাত শান্ত।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2020, 05:35 PM
Updated : 3 July 2020, 05:54 PM

সরোজ খান আজ চলে গেলেন।

২০২০ সাল যে কত কত মানুষকে নিয়ে যাবে সে হিসাব কে রাখবে? সরোজ খানের অবশ্য বয়স ৭১ হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে ডায়বেটিসে ভুগছিলেন।

তবুও এরকম সময়ে চলে যাবেন তা আর কে ভেবেছিল? শেষ পোস্ট ছিল সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে। কে জানতো সুশান্তের মত তিনিও প্রয়াত হবেন।

সরোজ খানকে নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের চলে যেতে এ উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি, দেশভাগের দিনগুলোতে। তখনও তিনি জন্ম নেননি। তার পরিবার ছিল যথেষ্ট বড়লোক। থাকতেন উনারা পাকিস্তানে। এক রাতের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে পরিবার ভারতে আসার জন্য বের হয়। সাথে ছিল কাপড়ের ব্যাগ আর স্বর্নের ব্যাগ। ভাগ্যের পরিহাসে ব্যাগ বদলে গেল এত মানুষের ভীড়ে। বোম্বের এক রিফিউজি ক্যাম্পে হলো আশ্রয়।

১৯৪৮ সালে সরোজ খানের জন্ম হয়। তিন বছর বয়সে সরোজ খানের মা দেখলেন আয়নায় হাত পা ছুঁড়ে নাচে। ভাবলেন মেয়ের কোনো মানসিক সমস্যা। সরোজ খানের মা তখন আরেকবার গর্ভবতী, চেক আপে গিয়ে ডাক্তারকে বলেন, 'আমার মেয়ে এরকম কেন?' ডাক্তার বলেছিলো, 'আপনার মেয়ে ঠিক আছে। তাকে নাচ শেখাতে পারেন কিনা দেখেন? যদি সিনেমায় যদি শিশু ড্যান্সার হয় তাহলে রোজগারের আর ভাবনা নাই, সেই পরিবার চালাতে পারবে।' সেই ডাক্তারই তাকে সিনেমায় নিয়ে যান পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে। মাত্র তিন চার বছর থেকেই তিনি নিজের পরিবার চালান। ড্যান্স গ্রুপেও অনুষ্ঠান করেন। নয় দশ বছরে কাজ উনার কমে গেল। সিনেমা তে কাজ আসে না। তো উনি খুব ভালো ওয়েস্টার্ন ড্যান্স শিখেছিলেন। এক্রোব্যাটিক, ক্যাবারে এসব পারতেন। চুল ছোট রাখার কারনে তাকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভাবতেন অনেকে। এরপর তিনি নায়িকাদের সাথে নাচতেন। মাত্র তের বছর বয়সে উনার এক ড্যান্স মাস্টারের সাথে বিয়ে হয়। একটা ছেলেও হয়, কিন্তু তার তখনকার স্বামী সন্তানকে মেনে নেননি। তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। সরোজ খান তখন একা একা ট্রেইনার হিসাবে কাজ করতেন। সিনেমায় বিখ্যাত সব নায়িকাদের নাচের স্টেপ প্র্যাকটিস করাতেন। একবার এক ড্যান্স মাস্টার অনুপস্থিতিতে তিনি কোরিওগ্রাফার হিসাবে কাজ শুরু করেন।

কিন্তু তখন তামিল লোকজনই এ কাজ করতো। বলিউডে তাদের এ কাজে সুনাম ছিল।

নায়িকা সাধনা প্রযোজিত 'গীতা মেরে নাম' ছবি দিয়ে তার একক কোরিওগ্রাফার হিসাবে কাজ শুরু। কিন্তু লোকজন একটা মেয়েকে কোরিওগ্রাফার বা ড্যান্স মাস্টার হিসাবে মানতে চাইতো না। বলিউডে তখন সেক্সিজমের আখড়া। উনি বড় সিনেমায় কাজ পেতেন না। হেমা মালিনীর এক ছবিতে কাজ পেয়ে নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি।

তাকে বদলে দেয় 'তেজাব' ছবির কাজ। একটা গানের নৃত্য পরিচালনা করেই তিনি রাতারাতি বলিউডে বিখ্যাত হয়ে যায়। প্রযোজক তাকে বলেছিল, 'আপনার একটা ড্যান্সই আমার কপাল খুলে গেছে।' এর আগে কোরিওগ্রাফি শব্দটা ব্যবহার হতো না। সরোজ খানকে দিয়েই শুরু।

তিনি তখন এক গানে পারিশ্রমিক নিতেন ১৫ হাজার, সেই ছবির পরেই তা এক লাখে ঠেকলো। ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারে ক্যাটাগরি শুরু হলো। উনি ফিল্মফেয়ার পেলেন প্রথমবারেই। সেই থেকে তার উত্থান শুরু। সিনেমায় জম্পেশ নৃত্য মানেই সরোজ খানের নির্দেশনা। এ পর্যন্ত আটটা ফিল্ম ফেয়ার তিনি পেয়েছেন কোরিওগ্রাফার হিসাবে। তিনটা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার যুক্ত হয়েছে তার মুকুটে। জেনারেশনের পর জেনারেশনের সাথে তিনি কাজ করেছেন। শ্রীদেবী অভিনীত সেই কালজয়ী নাচ 'মিস্টার ইন্ডিয়া'তে কে ভুলতে পারে। বিখ্যাত নায়িকা মাধুরী দীক্ষিত তার এত অর্জনের জন্য অন্যতম কৃতিত্ব দেন সরোজ খানকে।

দেবদাস সিনেমায় 'দোলারে দোলারে' এখনও আপনার মনে দোলা দিবেই। ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সে আইকনিক নাচ 'হাম দিল দে চুকে সানাম' ছবিতে কত অসাধারণ!

এই তো সেদিন 'কলংক' ছবিতে আবার মাধুরীর সাথে কাজ করলেন। টেলিভিশনে রিয়েলিটি শো এর বিচারক হিসাবেও ছিলেন তিনি বিখ্যাত।

অনেকেই জানেন না, তার আসল নাম, নির্মলা নাগপাল। আবার যখন বিয়ে করেন সে স্বামীর নাম ছিল সরদার খান। সেখান থেকেই নিজের ডাক নামের সাথে হয়ে যায়, সরোজ খান। তাদের ছিল সুখের সংসার। ইন্ডাস্ট্রিতে তাকে ডাকতো সবাই 'মাস্টারজী' বলে। সরোজ খানের ছেলে রাজু খানও কোরিওগ্রাফি করতেন, চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও সফল। সরোজ খানের সাথে সাথে চলে গেল এক নারীর বলিউডের সংগ্রামের গল্পও।

এমন নারীকেই তো বিজলি বলা যায়, যার প্রতিটা মুদ্রয়ি বিদ্যুতের ঝলক। তাই সরোজ আজ অজানার আকাশে সৌদামিনী হয়ে গেলেন। বিজলির আরেক নাম যে সৌদামিনী তা কে না জানে! আর সরোজ মানেই যে ‍বিদ্যুত গতি তা কে না মানে?