ইরফান সেদিন আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন: মাহমুদুল ইসলাম

২৯ এপ্রিল সকালের খবরে শোক ছড়িয়ে পড়ে ভারত-বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমীদের মাঝে। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইরফান খান চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু রেখে গেছেন তার বন্ধু-স্বজন, পরিবার, অসংখ্য ফ্যানদের।

রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2020, 11:12 AM
Updated : 4 May 2020, 09:42 AM

আর যারা তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাদের মনের ভেতরের বিউগলের করুণ সুর, কখনও বেজে উঠেছে স্মৃতির পাতায় সুখের স্মৃতি মনে করে, কখনও আবার তাকে হারানোর বেদনা অনুভব করে।

তেমনই একজন, পরিচালক মাহমুদুল ইসলাম। ইরফান খানের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার বেশ ক্ষাণিক পরে তিনি সামাজিক মাধ্যমে তার অনুরাগ জানান।

গ্লিটজ যোগাযোগ করে বিস্তারিত আলাপ করতে।

কোয়ারেন্টিনের এই সময়ে মনের কথা বলতে পারাটাও যেন সবচেয়ে বড় মুক্তি। মাহমুদুল ইসলামও গ্লিটজের সঙ্গে কথা বলে একটু হালকা হলেন বটে।

প্রথমেই জানালেন যখন সংবাদটি তার কাছে আসে তখন কেমন মনে হয়েছিল তার।

তিনি বলেন, “মোটামুটি ঘণ্টাখানেক থম মেরে বসেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী বলবো বা কী করা উচিৎ।”

উল্লেখ্য মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ সিনেমায় ইরফান খান অভিনয় করেন। যে কারণে ঢাকায় এসেছেন অনেকবার। কাজ করেছেন, সখ্যতাও হয়েছে অনেকের সঙ্গে। যাদের মধ্যে মাহমুদুল ইসলাম অন্যতম।

ইরফানের চলে যাওয়া নিয়ে মাহমুদুল ইসলাম জানালেন তার নানা স্মৃতি কথা।

তার ভাষায়, “ঘুম থেকে উঠেই ইরফান খানের মৃত্যুর সংবাদ একেবারে হতবিহ্বল করে দিলো। কিন্তু তার সঙ্গে তো বিশেষ কোনো সখ্যতা আমার ছিল না। ডুবের শুটিংয়ের সময় কয়েকদিন তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এই যা।”

নিজেকে কীভাবে প্রতিনিয়ত চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করতেন ইরফান সে প্রসঙ্গে মাহমুদ বলেন, “ইরফানের কাজ দেখার সময় বুঝেছি, কীভাবে একজন অভিনেতা মনের অজান্তে নিজেকে তৈরি করে একটা চরিত্রের জন্য। কীভাবে সে পরিপার্শ্ব থেকে অল্প অল্প করে তথ্য উপাদি সংগ্রহ করেন।”

শুধু তাই নয়, ইরফানের স্ক্রিপ্ট নিয়ে হোম ওয়ার্ক করা প্রসঙ্গে বলেন, “তাকে প্রথম যখন দেখি তখনই কেন যেন মনে হয়েছিল, সে ওই চরিত্রটা করার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে এসেছেন। তার চোখ, কথা বলার ভাবভঙ্গি, হাঁটাচলা, এমনকি চুলও। সে তার নিজের মতো একটা স্কেচ করে নিয়ে এসেছে চরিত্রটার। যেখান থেকে তাকে নড়ানো মুশকিল। এরকম খুব কম অভিনেতা অভিনেত্রীর মধ্যে দেখাছি আমি।”

ইরফানের মৃত্যুর আগের দিন হাসপাতালে ভর্তির খবর জেনেছিলেন ‘ইতি তোমারই ঢাকা’র ‘ঢাকা মেট্রোর’ পরিচালক মাহমুদ।

তখনই তার মনে অশনিসংকেত উঁকি দেয়।

বলেন, “যখন তার অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তির খবর পড়লাম তখনি কেন জানি আমার মনে হয়েছিল, তিনি আর মনে হয়ে ফিরে আসতে পারবে না। কিছু কিছু খবরের মধ্যে অশুভ ইঙ্গিত দেওয়া থাকে। আমি ওই খবরটার মধ্যে সেই অশুভ ইঙ্গিতটা দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু কাউকে বলি নাই এই ভয়ে যে, যদি ইঙ্গিতটা বাস্তবে রূপ নেয়। কিন্তু ভবিতব্যকে ঠেকানো গেলো না।”

এরপর তিনি তার স্মৃতির পাতা হাতড়ে বললেন, “প্রথমদিন ইরফানকে যখন আমি গাড়িতে তুললাম, পাঁচ মিনিট চুপচাপ থাকার পর তার প্রশ্নের বাণ শুরু হল। বাংলাদেশ নিয়ে একে একে সব কিছু জানতে চান তিনি। ঢাকা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে চলে, দেশের ইকনমি কীসের ওপর নির্ভরশীল। এদেশে আমাদের মতো ফিল্ম-মেইকাররা কীভাবে ছবি বানায়। আরও কত কী!”

শুটিংয়ের মাঝখানে ইউনিটের সবাইকে নিয়ে ক্রিকেট খেলাকে স্মরণ করলেন বাংলাদেশের এই পরিচালক।

একদিন শুটিং থেকে ফেরার সময় ইরফান খান তার গাড়ির সামনের সিটে বসে ড্যাশবোর্ডের ওপর পা তুলে জিজ্ঞাস করেছিলেন, “আশপাশে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যাবে এরকম কোন জায়গা আছে কিনা?”

এর উত্তরে তখন মাহমুদ বলেন, “আছে, নিয়ে যাব একদিন শুটিংয়ের ফাঁকে।”

কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

মাহমুদ বলেন, “সেই আক্ষেপ আমার সবসময়ই থেকে যাবে। আপনি খালি পায়ে ঘাসের ওপর হাঁটতে ভালোবাসতেন। আশা করি ওপারের শিশির ভেজা সবুজ তাজা ঘাস আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

মনের সবটুকু আবেগ দিয়ে মাহমুদ বলেন, “ইরফান খান আপনার এই যাত্রা শুভ হোক।”

কিছু কিছু মৃত্যু সংবাদ অতি আপন জনের মৃত্যু সংবাদ থেকেও অনেক ভারী হয়। মনের আকাশটা এই রোদ-উজ্জ্বল দিনেও ভয়াবহ মেঘলা হয়ে থাকে। এমনই একটা সকাল ছিল ইরফানের চলে যাওয়ার সকালটা বলে জানান মাহমুদ।

পরিশেষে মাহমুদুল ইসলাম বলেন, “ইরফান খান আপনি চলে গেলেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে কাটানো ওই কয়েকদিন সারাজীবন মনে থেকে যাবে।”