শুধু সিনেমাতে নয়, প্রেক্ষাগৃহেও পরিবর্তন প্রয়োজন

বিনোদন সাংবাদিক প্রতীক আকবর গ্লিটজের পাঠকদের জন্য জানালেন বিশ্বজুড়ে সিনেমা হলের আদি এবং আগামি রূপ। স্বতন্ত্র পর্দার যবনিকা পাতের কারণ এবং একাধিক রুপালি পর্দার সমন্বয়ের সূচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন এক কলামে।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2020, 03:36 PM
Updated : 10 April 2020, 06:15 PM

সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- এটা কি সঙ্কট? যদি সঙ্কট হয়, তাহলে এই সমস্যা কি শুধু বাংলাদেশেই? একদমই না। সারা পৃথিবীতেই কমে যাচ্ছে সিনেমা হল। তবে বলে রাখা ভালো, এই সিনেমা হল বলতে বোঝানো হচ্ছে সিঙ্গেল স্ক্রিন অর্থাৎ যে সিনেমা হলে একটি পর্দা, আসন সংখ্যা ছয়শ থেকে হাজারের উপরে।

সারা পৃথিবীতেই কমে যাচ্ছে সিনেমা হল- তার কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক।

২০১০ সালের ৫ অক্টোবর বিবিসি এক সংবাদে জানাচ্ছে (https://www.bbc.com/news/world-south-asia-11163403)- ‘কমে যাচ্ছে মুম্বাইয়ের সিঙ্গেল স্ক্রিনের সিনেমা হল’।

প্রতিবেদনটিতে দেয়া পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ২০১০ সালে মুম্বাই শহরে আঁশিটি প্রেক্ষাগৃহ চালু ছিল এবং গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ২০টি সিঙ্গেল স্ক্রিনের সিনেমা হল।

সংবাদটি লিখেছেন বিবিসি নিউজ’র মুম্বাইয়ের প্রতিবেদক প্রাচী পিঙ্গালি। তিনি তার প্রতিবেদনটি শুরু করেছেন মজার একটি গল্প দিয়ে। গল্পটি এখানে তুলে ধরা হলো, কারণ তাতে দর্শকের ধরন সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যাবে।

গল্পটি হলো- মুম্বাই শহরের একজন কর্মজীবী মানুষ নিরঞ্জন পটবর্ধন। সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। একবার, ট্রেনে করে সিনেমা হলে যাবার সময় তিনি তার হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা পান। তার মনে হচ্ছিল হাতটা তার ভেঙে গেছে। নিরঞ্জন সেই ব্যাথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে সিনেমা হলে চলে গেলেন সিনেমা দেখতে। সিনেমা দেখে তারপর গেলেন ডাক্তারের কাছে।

এমন দর্শক থাকার পরও মুম্বাইতে কমে যাচ্ছে সিনেমা হল। দশ বছর আগে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে প্রাচী পিঙ্গালি তুলে ধরেছিলেন সিনেমা হলের পরিবেশগত সমস্যার কথা।

ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াতে ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল ‘দ্য এন্ড অব সিঙ্গেল স্ক্রিন থিয়েটার’ (https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/The-end-of-single-screen-theatres/articleshow/51953249.cms) শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ পায়। সেখানে সাংবাদিক প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত তুলে ধরেন কোলকাতায় ঐতিহ্যবাহী সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ। সেই প্রতিবেদনে মাল্টিপ্লেক্সের উত্থানের কথা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেন প্রতিবেদক।

বাংলাদেশেও হল কমে যাচ্ছে দিন দিন। উপরের আলোচনার মতো বাংলাদেশের সিনেমা হলের পরিবেশগত সমস্যা আর মাল্টিপ্লেক্সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে প্রচুর। আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে আসলে সমাধানটাও জরুরি। আবার সমাধানও খুব সহজ নয়। সবাই যখন সিনেমার পরিবর্তনের কথা বলছেন, তার সঙ্গে দরকার সিনেমা হলের ধারনাগত পরিবর্তন।

বাংলাদেশে সিঙ্গেল স্ক্রিন বন্ধ হলেও মাল্টিপ্লেক্স কিন্তু বাড়ছে। সেই হলগুলোতে দেশের সিনেমার পাশাপাশি চলছে বিদেশি সিনেমাও। সেই সিনেমা দর্শকরা দেখতে যাচ্ছেন, আনন্দ করছেন। অথচ অন্যদিকে সিঙ্গেল স্ক্রিনের মালিকরা হা-হুতাশ করছেন প্রতিনিয়ত। চলচ্চিত্রাঙ্গনের নেতারা দুঃখ করে বলছেন, ‘এমন চলতে থাকলে হল সব বন্ধ হয়ে যাবে’। সরকারের সহযোগিতা চাইছেন তারা।

এমন সমস্যা আসলে পৃথিবীব্যাপী। বাংলাদেশে তো তবুও অ্যাপ ভিত্তিক ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটগুলোর জনপ্রিয়তা কম। কিন্তু ভারতসহ আরও অনেক দেশে নেটফ্লিক্সসহ রয়েছে অনেক ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট। ভারতেই এর সংখ্যা ত্রিশের বেশি। এসব সাইটের সিনেমা এবং কনটেন্ট দেখার পর অনেকেই আর সিনেমা হলে যেতে চাইছে না।

ব্যবসা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ফোর্বসে ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘আগামীর থিয়েটার কীভাবে পরিবর্তন করবে নেটফ্লিক্স’ (https://www.forbes.com/sites/danafeldman/2019/07/28/how-netflix-is-changing-the-future-of-movie-theaters/#7dc732515f46)। সেই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে লস অ্যাঞ্জেলসের একজন সিনেমা দর্শক জানাচ্ছেন, রাতে সিনেমা দেখতে যাওয়া সঙ্গে খাওয়া দাওয়া অনেক ব্যয়বহুল। তাছাড়া গাড়ি পার্কিং সমস্যা রয়েছে। তাই ঘরে বসে নেটফ্লিক্সে ছবি দেখাই ভালো।

লস অ্যাঞ্জেলসের ‘রিগ্যাল সিনেমা স্টেডিয়াম ১৪’ এখন প্রায়ই দর্শক শূণ্যতায় ভোগে। নেটফ্লিক্সসহ অন্যান্য হোম এন্টারটেইনমেন্ট আসার পর মাল্টিপ্লেক্স মালিক ও ডিস্ট্রিবিউটররাও কিছুটা চিন্তিত। পুরো সিস্টেমটা নিয়েই তারা নতুন করে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে তারা একটা উপায় বের করেছে। এটিও অনেকটা ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটে সাবস্ক্রিপশনের মতো।

‘রিগ্যাল সিনেমা স্টেডিয়াম ১৪’ তার দর্শকের জন্য একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। যে পরিকল্পনাটির নাম ‘মুভি টিকিট সাবস্ক্রিপশন প্ল্যান’। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আগ্রহীরা ১৮ ডলার থেকে ২৪ ডলার দিয়ে রিগ্যাল সিনেমা হলের একমাসের সাবস্ক্রিপশন পাবে। যার মাধ্যমে রিগ্যালের নানা এলাকার সিনেমা হলে প্রদর্শিত হওয়া বিভিন্ন সিনেমা তারা দেখতে পারবে।

নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলসে এই সাবস্ক্রিপশন ফি কিছু বেশি, আবার অনেক জায়গায় কিছু কম। সিনেমা হল এবং সিনেমার সংখ্যার ওপর এই সাবস্ক্রিপশন ফি নির্ভর করে। এমনকী দর্শকের জন্য রয়েছে বিভিন্ন প্রনোদনা। যেমন- কোনো দর্শকের জন্মদিনের দিন সে সিনেমা দেখতে আসলে সে ফ্রি পাবে একটি পপকর্ন। এছাড়াও রয়েছে ডিসকাউন্টের সুবিধা।

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মুভি চেইন ‘এএমসি’। ২০১৮ সালে তাদের দর্শক সাবস্ক্রিপশন প্ল্যানের টার্গেট ছিল ৫ লাখ। দেখা গেল সেই সাবস্ক্রিপশন টার্গেটকে অতিক্রম করে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজারে।

একই সঙ্গে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে সাবস্ক্রিপশন করতে চাওয়া দর্শকের সংখ্যাও কিন্তু বেড়েছে। ২০১৮ সালের এক জড়িপে দেখা গেছে ২০২০ সালের মধ্যে একাধিক প্ল্যাটফর্মে সাবস্ক্রিপশন করতে চায় এমন দর্শকের সংখ্যা চায়নাতে ৫৩ শতাংশ, স্পেনে ৪২, ইটালিতে ৪০, সিঙ্গাপুরে ৩৮ শতাংশ।

তাই ধরেই নেওয়া যাচ্ছে যে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে দর্শকরা বেশি যাচ্ছে। আবার প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া দর্শকের সংখ্যাও কম না। কিন্তু কিছুটা ভিন্ন উপায়ে, বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে, একটা ঘরের মতো পরিবেশে দর্শকদের নিয়ে যেতে হবে প্রেক্ষাগৃহে।

২০১৯ সালে এনসিবিসি’র ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে (https://www.cnbc.com/2019/04/08/netflix-isnt-killing-theaters-people-who-steam-more-see-movies-more.html) সারাহ হিটেন উল্লেখ করছেন, কোয়ান্টেটিভ ইকোনোমিক্স অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্সের একটি গ্রুপের গবেষণা বলছে, যারা সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যান তারাই ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটে কনটেন্ট উপভোগ করেন।

প্রতিবেদনটিতে আরও জানানো হয়, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় বক্সঅফিস মোট আয় করেছে ১২ মিলিয়ন ডলার। যা এখন পর্যন্ত রেকর্ড। ঐ অঞ্চলের ৭৫ শাতাংশ মানুষ কমপক্ষে একটি করে সিনেমা দেখেছে বলেই বক্স অফিসের এই ইনকাম।

এটা সত্যি যে ওয়েব স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে দর্শকদের এখন যাতায়াত বেশি। তবে বিদেশের থিয়েটার বা সিনেমা হলগুলোর অবস্থা করোনাভাইরাস সমস্যা ছাড়া এখনো এতোটা খারাপ হয়নি। ভালো কনটেন্ট আর ভালো সিনেমা হলের মাধ্যমে তারা এখনো দর্শক ধরে রেখেছে।

বাংলাদেশেও কিছু ‍কিছু সিনেমা মুক্তি পেলে দর্শকরা পছন্দসই প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি দেখতে যায়। চলচ্চিত্রাঙ্গনের এমন সময়ে তাই কিছু সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলেও দর্শকের চাহিদা বিশ্লেষণ আর ভালো সিনেমার নির্মাণ বৃদ্ধি করে সিনেমা হলের নতুন একটি রুটপ্ল্যান দরকার এই সময়।

এছাড়া বাংলাদেশের সিনেমা হলে রয়েছে বুকিং এজেন্টের কমিশন  আদায়ের সমস্যা।

একটি অনুষ্ঠানে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সিনেমা মুক্তির সময়ে ভাগা দিতে দিতেই তো অবস্থা খারাপ।’ নতুন সময়ের সিনেমা হলে এমন সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। হল মালিকের পাশাপাশি প্রযোজককেও দিতে হবে লাভ। তবেই হবে সিনেমা, তবেই ভাবা যাবে কোথায় সেই সিনেমা দেখানো হবে। তৈরি হবে নতুন নতুন পরিকল্পনা, আর তার বাস্তবায়ন হলে নিশ্চয়ই কাটবে সমস্যাও।