আগামীর সিনেমা: কম বাজেটে তুখোড় উপস্থাপনা

চলচ্চিত্র সাংবাদিক প্রতীক আকবর, সিনেমা যেমন দেখতে ভালোবাসেন, তেমনই সিনেমা নিয়ে আলোচনাও করতে ভালোবাসেন। গ্লিটজের আমন্ত্রণে তিনি আলোচনা করলেন সিনেমা নিয়ে কিছু আশা - কিছু আগামীর সম্ভাবনা।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 April 2020, 04:14 PM
Updated : 1 April 2020, 06:11 PM

চীনে সিনেমা হলগুলো চালু হবে হবে করেও হলোনা। সেখানে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পুরোটা আসেনি হাতের মুঠোয়। তাই মার্চের মাঝামাঝি সময়ে চীনে সিনেমা হল চালু হওয়ার কথা শোনা গেলেও শেষমেশ তা আবার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কিন্তু, কী মনে হচ্ছে? করোনা নিয়ন্ত্রণে এলেই জমজমাট হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক সিনেমার বাজার? মহামারি কাটিয়ে সহজেই মানুষ যাবে সিনেমা হলে? স্বাভাবিকভাবে ধারণা করাই যায় যে, করোনা আতঙ্ক কমতে সময় লাগবে আরও অনেকদিন। অর্থাৎ করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসার পরও আন্তর্জাতিক সিনেমার বাজার স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।

একইভাবে করোনারভাইরাস প্রভাব ফেলেছে দেশের সিনেমা জগতেও। এমন ধারণা করাটা বোধহয় ঠিক হবে না যে, করোনা পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণে আসবে তখন বড় তারকার সিনেমা মুক্তি দিলেই প্রেক্ষাগৃহে তা চলবে মহাসমারহে।

তাছাড়া, দেশের সিনেমার হালচাল করোনা প্রভাবের আগে থেকেই নাজুক। এই খারাপ অবস্থার কথা গণমাধ্যম ভালোভাবেই জানিয়ে আসছে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ পরবর্তী সময়টা আরও খারাপ হবে- এই ধারণা রেখে কিছু পরিকল্পনা রাখতে পারেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। যেমন- বড় তারকাদের বড় বাজেটের সিনেমা ঈদে বা অন্যসময় একসঙ্গে মুক্তি না দিয়ে নির্দিষ্ট বিরতিতে মুক্তি দেওয়া। একাধিক জনপ্রিয় তারকার সিনেমা একসঙ্গে মুক্তি না দিয়ে, দুই সপ্তাহ পর মুক্তি দেওয়া কিংবা করোনা পরবর্তী সময়কে মাথায় রেখে নতুন ঢংয়ে প্রচারের পরিকল্পনা করা। মুক্তি প্রতীক্ষিত সিনেমার ক্ষেত্রে এই আলোচনাগুলো সামঞ্জস্য।

মহামারি পরবর্তি কিছু সময়ে দর্শকের চলতি ট্রেন্ডের বাংলা ছবি ভালো নাও লাগতে পারে। তাই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরপরই দেশের প্রেক্ষাপটে করোনাভাইরাস সংক্রমন ও এর ভয়াবহতা নিয়ে সিনেমা হতে পারে। যা শুধু একটি সিনেমাই হবে না, হয়ে থাকবে কালের সাক্ষী। আর সঙ্গে যদি পাওয়া যায় ব্যবসায়িক সাফল্য- তাহলে তো কথাই নেই। তবে ধরে রাখা যেতে পারে অবশ্যই এই ধরণের ছবির বাজেট হবে কম। বেশি খাটতে হবে তথ্য সংগ্রহ, গল্পের বিন্যাস, চিত্রনাট্য সর্বোপরি প্রি-প্রোডাকশনে।   

এখন দেশের সিনেমার ব্যবসা ভালো না, সিনেমায় কেউ টাকা ঢালতে চায় না- এসব কথা তো সিনেমার মানুষদের খুব ভালো করেই জানা। তাহলে কী হবে? এভাবেই চলতে থাকবে? নিশ্চয়ই না। এখানেই প্রয়োজন কৌশল-বুদ্ধি ও মেধার। কম টাকায় ছবি বানিয়ে, গল্প এবং অভিনয়ের বাহাদুরিতে কীভাবে তার ব্যবসায়িক সাফল্য আনা যায়- সেই পরিকল্পনাটি করার সময় অনেকদিন ধরেই বোধহয় চলছে। গল্প, শুটিং লোকেশন, অভিনয়শিল্পী নিয়ে ভিন্নভাবে পরিকল্পনা করলে কমিয়ে আনা সম্ভব সিনেমা নির্মাণের খরচ। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে গল্প নির্বাচন এবং প্রি-প্রোডাকশনের ভিতের উপর দাড়িয়ে থাকবে প্রোডাকশনটি।

করোনা পরবর্তী সময়ই শুধু না আরও আগামী দিনের সিনেমা হবে বুদ্ধির খেলায়। এমন আভাসই দিচ্ছে বিশ্ব সিনেমা। এমনকী দেশের সিনেমা পাড়ার পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে বলে ধারণা। বড় তারকার বড় বাজেটের সিনেমাও এখন বড় মুনাফা এনে দিতে পারছে না। কারণ, সেইসব ছবির কিছু শুটিং লন্ডন, মালয়েশিয়া, থাইল্যন্ডে হলেও থাকছে না গল্পের চমক। সংলাপ এবং দৃশ্যায়নে থাকেন কোনো মুন্সিয়ানা। নাচে, গানে আর অ্যাকশনেই খরচ করতে হচ্ছে অনেক অনেক টাকা। এসব দিয়েও এখন আর কাজ হচ্ছে না, তাই প্রয়োজন গল্পের টুইস্ট।

বড় তারকারা বড় বাজেটের সিনেমা করুক না! সিনেমার ব্যবসা ভালোর দিকে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন আরও অনেক ছবি। হলিউড, বলিউডও হাঁটছে একই পথে।

বিশ্বব্যাপী বড় বাজেটের অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ড গেম (বাজেট-৩৫৬ মিলিয়ন ডলার, আয়-২.৮বিলিয়ন ডলার) যেমন আলোচনায় ছিল, তেমনি প্যারাসাইট’র (বাজেট-১১ মিলিয়ন ডলার, আয়-২৬৬ মিলিয়ন ডলার) মতো শেকরে আঁটা ছবিও ছিল তুমুল আলোচনায়, পেয়েছে প্রশংসা। ‘জোকার’ (বাজেট-৫০ থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলার, আয়- ১.০৭ বিলিয়ন ডলার), ‘১৯১৭’সহ (বাজেট-৯০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার, আয়-৩৬৮ মিলিয়ন ডলার) অনেক সিনেমাই তুলনামুলক কম বাজেটে নির্মিত হয়েছে, কিন্তু ব্যবসা করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন।

বলিউডে ‘জিরো’ ফ্লপের পর শাহরুখ খান সিনেমাই করছেন না অনেকদিন। সালমান খান বাধ্য হচ্ছেন তার নির্মিতব্য সিনেমার দৈর্ঘ্য কমাতে। কারণ দর্শক বেশি সময়ের সিনেমা পছন্দ করছেন না। আর আমির খান বিষয় এবং গল্পকে গুরুত্ব দিয়ে সিনেমা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এই তিন খনের বাইরে অনেক সিনেমা নির্মিত হচ্ছে তুলনামূলক কম বাজেটে। আর সেগুলোই টিকিয়ে রেখেছে বলিউডকে। ব্যবসাও করছে ছবিগুলো।

যার মধ্যে অন্যতম ‘স্ত্রী’, ২০ কোটি রুপি বাজেটের সিনেমা ১৮ দিয়ে আয় করেছে ১০০ কোটি রুপি। আরও আছে ‘বাধাই হো’- ৩০ কোটি রুপি বাজেটের সিনেমার আয় ১৩২ কোটি রুপি, ‘রাজি’- ৪০ কোটি রুপি বাজেটের সিনেমার আয় ১৫৮ কোটি রুপি, ‘আন্ধাধুন’- ২৫ কোটি রুপি বাজেটের সিনেমার আয় ৭২ কোটি রুপি।

কলকাতার সিনেমায় গল্পের বৈচিত্র, অভিনয় নিয়ে অনেকদিন আগে থেকেই চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কলকাতার সুপারস্টার দেব অভিনীত গত কয়েক বছরের সিনেমার মধ্যে অন্যতম ককপিট, আমাজন অভিযান, ধূমকেতু, কবীর, পাসওয়ার্ড, সাঁঝবাতি। ছবিগুলোর বিষয় এবং ছবিগুলোতে দেবের উপস্থিতি নতুন বার্তা দেয় সিনেমা সংশ্লিষ্টদের। একই অবস্থা জিতের, ‘প্যান্থার-হিন্দুস্থান মেরি জান’, ‘শেষ থেকে শুরু’, ‘বাচ্চা শ্বশুর’, ‘বাঘ বন্দি খেলা’ আশা পূরণ করতে পারেনি দর্শকদের। বরং তার অভিনীন ‘অসুর’ চিত্রায়ণে মূল ধারার ছবি হয়েও ভিন্ন স্বাদের।

এছাড়াও কলকাতায় নির্মিত হচ্ছে একের পর এক গোয়েন্দা কাহিনী নির্ভর সিনেমা। যা বরাবরই উৎকণ্ঠিত করে আসছে দর্শকদের। কলকাতার ফেলুদা, ব্যোমকেশ বাংলাদেশেও জনপ্রিয়।

শুধু তাই নয়, সারাবিশ্বে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নেটফ্লিক্সসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে সুপারস্টারদের প্রোডাকশন নেই বললেই চলে। এছাড়াও এই প্রোডাকশনগুলো দেখলে ধারণা করা যায় যে, এগুলোর দৃশ্যধারণ, সংলাপ এবং কাহিনী এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছিল খুব ভালো একটি পরিকল্পনা। মূলত ভিন্ন রকম গল্পের কারণেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো।

তা না হলে হিন্দি ভাষার সিনেমা পিঙ্ক, গেম ওভার, ঘৌল, বাদলা’র মতো সংলাপ নির্ভর সিনেমা জনপ্রিয় ওঠার আর কোনো কারণ পাওয়া যায় না। এসব ছবিতে পপুলার ফরমেটের কোনো উপাদান নেই বললেই চলে। তবু ছবিগুলো শেষ পর্যন্ত দেখতে উৎসাহি করে এর গল্প এবং সংলাপ। ছবিগুলোর বাজেট তুলনামূলক কম তবে এর সংলাপ, চিত্রনাট্য ও দৃশ্যাধারণের জন্য বুদ্ধি খাটাতে হয়েছে বেশি।   

এই প্রতিযোগিতায় দেশের প্রযোজক এবং পরিচালকদেরও খুঁজে নিতে হবে ভিন্ন রকম গল্প, করতে হবে চমকপ্রদ উপস্থাপনা এবং কাজে লাগাতে হবে পার্ফেকশন। সম্প্রতি গতানুগতিক ধারাকে পাশ কাটিয়ে কিছু ভিন্ন গল্পের সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। যার মধ্যে ‘কাঠবিড়ালি’ ছবিটি অন্যতম। ছবিটি মুক্তি পায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। প্রথম সপ্তাহে ১৮টি হলে প্রদর্শিত হয় ছবিটি এবং ছবিটি তার নির্মাণ খরচ তুলে আনতে পেড়েছে। এছাড়াও ‘ন’ডড়াই’, ‘গণ্ডি’ সিনেমাটিও ভিন্ন গল্পে চমকে দিয়েছে দর্শকদের। এতে করে দেশের চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা তৈরি হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

সুপারস্টার হলে ভালো, কিংবা না হোক, অভিনয়ের সঙ্গে ভিন্ন ঢং-গন্ধ-বর্ণের গল্প নিয়ে কম পয়সার সিনেমা নির্মাণ করে দর্শকদের চমকে দেওয়াটাই এখন মূখ্য বলে মনে করাতে একরকম বাধ্যই করছে সিনেমার ব্যবসায়ী পরিবেশ এবং দর্শকদের চাহিদা। অন্তত বিশ্ব সিনেমার উদারহরণ তো তেমনটাই বলছে।