বাড়ির চেয়ে বাবার ছবিগুলো বাঁচিয়ে রাখা জরুরি: কুণাল সেন

ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের ফরিদপুরের পৈতৃক বাড়ি উদ্ধারের দাবিতে ঢাকায় সংস্কৃতিকর্মীদের মানববন্ধনের সাফল্য কামনা করলেও ‘বাড়ির চেয়ে বাবার ছবিগুলো বাঁচিয়ে রাখা’ অধিক জরুরি বলে মনে করছেন তার ছেলে কুণাল সেন।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2019, 06:38 AM
Updated : 30 Dec 2019, 08:20 AM

ফরিদপুরের ঝিলটুলী এলাকার এ চলচ্চিত্রকারের পৈতৃক ভিটাসহ সত্যজিত রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটা উদ্ধার ও সংরক্ষণের দাবিতে মানবন্ধন করছে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশসহ ঢাকার একাধিক চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন।

রোববার বিকেলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মানবন্ধনের আয়োজকদের সাফল্য কামনা করেছেন কুণাল; তবে বাড়ি উদ্ধারের বিষয়টি তার কাছে ‘খুব জরুরি নয়’ বলে জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ইউনিভার্সিটি অব ইলিনোয় থেকে মেশিন লার্নিংয়ের (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) উপর পিএইচডি করে সেখানেই থিতু হওয়া কুণাল বলেন, “ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের মানবন্ধনের খবরটি জেনে ভালো লেগেছে। বাড়িটি উদ্ধারে জন্য কেউ চেষ্টা করছেন শুনে ভালো লাগলো। আমি চাইব, অবশ্যই তারা সফল হোক। তবে আমার কাছে এটা (বাড়ি উদ্ধার) খুব জরুরি না।”

বাড়ি উদ্ধারের চেয়ে মৃণাল সেনের পুরানো ছবিগুলো বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ দিয়ে তিনি বললেন, “বাবার অনেক ছবি হারিয়ে যাচ্ছে। পুরানো অনেক ছবির প্রিন্ট কারো কাছেই নেই। যারা বাড়ি উদ্ধারের আন্দোলন করছেন তারা বাবার প্রতি ভালোবাসা থেকেই করছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বাড়ির চেয়ে বাবার ছবিগুলো বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।

ছবি: কুনালের ফেইসবুক থেকে নেওয়া।

“পুরানো ছবিগুলো রিকোভার করা খুব মুশকিল; আবার ব্যয়সাপেক্ষও। সরকার (ভারত) কিছু ফিল্ম রিকোভার করেছে। কিন্তু সেই ছবিগুলো দর্শকরা দেখতে পাচ্ছেন না। ছবিগুলো রিকোভার করে দর্শকদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য সবার সহযোগিতা দরকার।”

মৃণাল সেন বেঁচে থাকলে বাড়ি উদ্ধারের দাবিতে মানববন্ধন নিয়ে ‘আপত্তি করতেন না আবার খুশিও হতেন না’ বলে জানালেন ছেলে।

কারণ হিসেবে বললেন, তার বাবা কখনোই ‘স্মৃতিকাতর’ ছিলেন না; বরং স্মৃতি জমিয়ে না রেখে ‘মুছে ফেলতেই’ বেশি পছন্দ করতেন।

“বাবার এই নস্টালজিয়া কোনোদিন ছিল না। জীবিত থাকতেও কোনো স্মৃতি রাখেননি। পুরানো জিনিসের প্রতি তার ব্যক্তিগত মমতা ছিল না। যা হয়ে গেছে তার পেছনে ফিরে দেখতে চাইতেন না। তার মধ্যে স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার কোনো তাড়না ছিল না। ফলে এই আন্দোলন নিয়ে আপত্তিও করতো না খুশিও হতেন না; বলতেন, যা হচ্ছে হোক।“

১৯২৩ সালের ১৪ মে বাংলাদেশের ফরিদপুরের ঝিলটুলীর বাড়িতে জন্ম নেন মৃণাল সেন; মাধ্যমিকের পড়াশুনা শেষে তার বাবা বাড়িটি বিক্রি করে কলকাতায় পাড়ি জমান। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর চিরপ্রস্থানের আগ অব্দি কলকাতায় বাস করেছেন এ চলচ্চিত্রকার।

ছবি: কুনালের ফেইসবুক থেকে নেওয়া।

কলকাতায় যাওয়ার পরও কবি জসিম উদদীনসহ ফরিদপুরের অনেকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তার। জসিম উদদীন কলকাতায় গেলে মৃণালের বাড়িতেই থাকতেন।

ফরিদপুর ছাড়ার বেশ কয়েক বছর পর সত্তরের দশকের শেষভাগে স্ত্রী গীতা সেনকে নিয়ে ফরিদপুরের পৈতৃক ভিটা ঘুরে গিয়েছিলেন মৃণাল সেন; তারপর আর আসা হয়নি ফরিদপুরে।

বাবার মুখে গল্পে গল্পে ফরিদপুরকে চিনেছেন কুণাল; মাঝে মধ্যে তার বাবা ফরিদপুরে কাটানো টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো তার সঙ্গে ভাগ করতেন।

মৃণাল সেনের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির একটি অংশ ভেঙে বহুতল ভবন তোলা হয়েছে; এখনও অক্ষত থাকা আদি বসত বাড়িটি উদ্ধার করে তার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি উঠেছে সংস্কৃতিকর্মীদের মানববন্ধন থেকে।

বিষয়টি নিয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানববন্ধনের বিষয়টি আমি জানি না। স্থানীয়ভাবে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। তবে বাড়িটি নিয়ে যদি কোনো অনায্য কিছু ঘটে থাকে তাহলে অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

১৯৫৫ সালে ‘রাত ভোর’ চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে মৃণাল সেনের। তার আগে ১৯৫০ সালে ‘দুধারা’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরিচালক হিসেবে নাম রয়েছে ‘অনামী’। এই ছবিটির কাহিনীও ছিল মৃণালের।

ছবি: কুনালের ফেইসবুক থেকে নেওয়া।

চলচ্চিত্রের অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন গীতা সোম, পরবর্তীতে মৃণাল সেন গীতাকে বিয়ে করেন।

দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘নীল আকাশের নীচে’ তাকে আপামর দর্শকের সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলে। তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘বাইশে শ্রাবণ’ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পান। ১৯৬৯ সালে তার পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়।

তিনি ‘ইন্টারভিউ’, ‘ক্যালকাটা ৭১’, ‘পদাতিক’ চলচ্চিত্র তিনটির মাধ্যমে তৎকালীন কলকাতার অস্থির অবস্থাকে তুলে ধরেছিলেন। মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে তুলে ধরে নির্মাণ করেন ‘এক দিন প্রতিদিন’ ও ‘খারিজ’।

‘খারিজ’ ১৯৮৩ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়। ১৯৮০ সালে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র ‘আকালের সন্ধানে’ মুক্তি পায়। ‘আকালের সন্ধানে’ ১৯৮১ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার জয় করে।