‘মন মজালে ওরে বাউলা গান’

লোকজ জীবনের কথা আর মৃত্তিকালগ্ন সুরে যে গান বাজে বাঙালির অন্তরে-অন্তরে, যে গানে চিত্রিত হয় আবহমানকালের গ্রাম বাংলা; সে গানেই শুরু হল আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এরপর দেশি-বিদেশি শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনায় মেতে থাকেন ঢাকার দর্শকরা।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Nov 2019, 04:08 PM
Updated : 15 Nov 2019, 09:00 PM

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বাউল প্রতিভা অন্বেষণের যে কার্যক্রম, সেই ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা’র ২০১৬ আসরের দুই শিল্পী শফিকুল ইসলাম ও কামরুজ্জামান রাব্বি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শুক্রবারের আসর।

ময়মনসিংহের সন্তান শফিকুল ইসলাম শুরু করেন ‘বাউল সম্রাট’ শাহ আবদুল করিমের ‘মন মজালে ওরে বাউলা গান’টি দিয়ে।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শুক্রবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র দ্বিতীয় দিনে সংগীত পরিবেশন করছেন মালির লোকশিল্পী হাবিব কইটে ও বামাদা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ছুটির সন্ধ্যায় তখনও ভরে উঠেনি আর্মি স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারি। ঢাক-ঢোল, হারমোনিয়াম আর দোতারার সঙ্গতে এরপর শফিক শোনান শচীন দেব বর্মণের ‘বন্ধু তুমি কই গেলা, কই রইলা রে’।

কুদ্দুস বয়াতির ‘কী সুন্দর এক গানের পাখি’ দিয়ে পরিবেশনা শেষ করেন শফিকুল।

২০১৬ সালে ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা’র আসরে নজর কাড়েন কামরুজ্জামান রাব্বি। তিনি শুরু করেন শচীন দেব বর্মণের ‘তাকডুম তাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ গানটি দিয়ে। ততক্ষণে দর্শক গ্যালারিতে শ্রোতা সমাগম বাড়ছে।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শুক্রবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র দ্বিতীয় দিনে সংগীত পরিবেশন করছেন বাংলাদেশের লোকশিল্পী কাজল দেওয়ান। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

রাব্বি শোনালেন ফকিরি গান ‘ভবের ঘরে আলেক শহরে আল্লাহ রসূল বিরাজ করে’, রামকানাই দাশের ‘তোমার সনে কিসের পিরিতি’।

বাউল রাব্বির গানে ততক্ষণে মজেছে দর্শক। তারা কখনও সমস্বরে গাইলেন, কখনও দল বেঁধে নাচলেন গানের তালে।

এরপর রাব্বি শোনান হালের জনপ্রিয় ফোক গান, মাহবুব শাহের লেখা ‘আমি তো ভালা না, ভালা লইয়া থাইকো’।

শাহ আবদুল করিমের ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’ গানটি রাব্বি শুরু করতেই দর্শকরা তাতে গলা মেলান।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শুক্রবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র দ্বিতীয় দিনে সংগীত পরিবেশন করছেন শফিকুল ইসলাম। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ফোক ফেস্টের দ্বিতীয় দিনের আসরে তৃতীয় শিল্পী বাউল কাজল দেওয়ান। কাজল দেওয়ান যখন মঞ্চে উঠেন, তখন আর্মি স্টেডিয়ামের মাঠ ও গ্যালারি কোথাও নেই তিলধারণেই ঠাঁই।

গুরু ও কবি মাতাল আব্দুল রাজ্জাকের ‘দিন ফুরাইলে ভেঙ্গে যাবে এই রঙের মেলা’ গানটি দিয়ে শুরু করেন তিনি। এরপর তিনি শোনান জনপ্রিয় ফোক গান ‘পিরিতির বাজার ভালো না’ ও ‘যত দুঃখ দিলি বন্ধু রে’।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শুক্রবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র দ্বিতীয় দিনে সংগীত পরিবেশন করছেন বাউলিয়ানা’র কামরুজ্জামান রাব্বি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

কাজল দেওয়ান শোনান দেহতত্ত্বের গান ‘তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে’। বাঁশি আর ঢোলের সঙ্গতে কাজল দেওয়ানের সঙ্গে দর্শকরা গাইলেন পবন দাস বাউলের ‘না, না. না না.. আজ আমার মন ভালো না।’

কাজল দেওয়ানের পরে মঞ্চে আসেন মালিয়ান লোকসংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি হাবিব কইটে আর দল হাবিব কইটে অ্যান্ড বামাদা।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রথম অ্যালবাম ‘মুসো কো’র পর মালিয়ান সঙ্গীতে বিশ্ব মাতিয়ে চলেছেন হাবিব কইটে। ১৯৯৪ সাল থেকে ব্যান্ড বামাদাকে নিয়ে তিনি পারফর্ম করেছেন বিশ্বের সব বড় মঞ্চে।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শুক্রবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র দ্বিতীয় দিনে সংগীত পরিবেশন করছেন মালির লোকশিল্পী হাবিব কইটে ও বামাদা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকার মঞ্চে প্রথমবারের মতো গাইতে এসে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাবিব কইটে বলেন, “বিশ্বের নানা দেশে গান গেয়েছি। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা অন্য রকম। লোকসঙ্গীতকে ভালোবেসে এত তরুণ এসেছে এখানে!”

ঢাকায় এসে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ এর বাংলাটি শিখেছিলেন। দর্শকদের উদ্দেশে ‘ধন্য ধন্য’ বলে খানিক চেষ্টা করেও পারলেন না পুরোটা বলতে।

আফ্রিকান ডিজাম্বে, হ্যান্ড ড্রামসের সঙ্গে বেইজ ও গিটারে আফ্রিকার লোকজ সুরের সঙ্গে সমকালীন সঙ্গীতের মেলবন্ধন করলেন আফ্রিকান দল হাবিব কইটে অ্যান্ড বামাদা। আফ্রো-পপের ধারাটির সঙ্গে তিনি ফিউশন করলেন ব্লুজ আর ফ্ল্যামেঙ্গো। একে একে চারটি গান পরিবেশন করেন তারা।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শুক্রবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র দ্বিতীয় দিনে সংগীত পরিবেশন করছেন শফিকুল ইসলাম। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এরপর মঞ্চে আসেন ফকির শাহাবুদ্দিন। তিনি একে একে গেয়ে শোনান ‘একদিন মাটির ভেতরে হবে ঘর’, ‘ছেড়ে দে নৌকা আমি যাব মদিনা’, ‘আর কতকাল থাকব দুয়ারে দাঁড়াইয়া’, ‘রসিক আমার মন বান্ধিয়া’, ‘বন্দে মায়া লাগাইসে’ গানগুলো। জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত ‘ইশকুল খুইলাসেরে মওলা’ গেয়ে পরিবেশনা শেষ করেন তিনি।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শুক্রবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র দ্বিতীয় দিনে সংগীত পরিবেশন করছেন শফিকুল ইসলাম। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

মঞ্চে সবার শেষে আসেন পাকিস্তানের সুফি ধারার গায়িকা হিনা নাসরুল্লাহ, সঙ্গে আসেন ভাই আনসার নাসরুল্লাহ।

দুই ভাই-বোন প্রথমে গেয়ে শোনান ওস্তাদ ফাহিম মাজহারেরর সঙ্গীতায়োজনের ‘সোবহানআল্লাহ ইশক দা জালওয়া’। ভৈরবী ঠাঁটে এই হামদের পরে তারা শোনান নাত ‘ইয়া রাসূল ইয়া রাসূল’।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শুক্রবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র দ্বিতীয় দিনে সংগীত পরিবেশন করছেন বাউলিয়ানা’র কামরুজ্জামান রাব্বি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এরপর তারা শোনান কাওয়ালি ‘সাসো কি মালা পে’ গানটি। ফররুখ আলী খান, নুসরাত ফতেহ আলী খান, তোফাইন হুশাইরপুরের লেখা এ গান বলিউডের ‘কয়লা’ আর ‘জিৎ’ সিনেমাতেও গাওয়া হয়েছিল।

তবে পাকিস্তানি গায়িকা অন্যদের মতো ঢাকার দর্শকপ্রিয়তা পাননি। তিনি যখন মঞ্চে উঠেছিলেন তখন স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারি শূন্য হতে শুরু করে। তৃতীয় গানটি যখন গাইছেন, তখন উৎসব প্রাঙ্গণ ছিল অনেকটা ফাঁকা। মঞ্চের সামনে ভিআইপি গ্যালারিও ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে।

হিনা নাসরুল্লাহ ও আনসার নাসরুল্লাহর চতুর্থ গান ‘মে নারায় মাস্তানা’। হযরত ওয়াসিফ আলীর লেখা সুফি কালাম গানটি ‘মেরে দিল সে’ অ্যালবামে গেয়েছিলেন সুফি গানের কিংবদন্তি আবিদা পারভীন।

এরপর তারা পরিবেশন করেন হামদ ‘আল্লাহ হু’, হযরত বাবা বুল্লে শাহ’র গজল ‘চারদে সুরজ ভালদে ভেখে’। শাহবাজ কালান্দারের সুফি গান ‘দামা দাম মাস্তা কালান্দার’ গেয়ে পরিবেশনা শেষ করেন তারা।

ফোক ফেস্টের সমাপনী দিনে মঞ্চ মাতাবেন বাংলাদেশের কাজল দেওয়ান, চন্দনা মজুমদার, পাকিস্তানের জুনুন এবং রাশিয়ার সাত্তুমা।