আইয়ুব বাচ্চুর গান কেউ বিকৃত না করুক: ফেরদৌস আক্তার চন্দনা

বাংলাদেশের ব্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম নায়ক আইয়ুব বাচ্চুর পরিবার সবসময়ই ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। সামনে আসেনি। জীবিত অবস্থাতেও এই ব্যক্তিজীবনের আড়ালটা পছন্দ করতেন আইয়ুব বাচ্চু। তার মৃত্যুর এক বছর পর কেমন আছেন তারা? গ্লিটজের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপে সেই ‘থাকা’টাই জানালেন প্রয়াত গায়কের স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনা।

রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2019, 06:14 AM
Updated : 18 Oct 2019, 06:46 AM

সবে মাত্র চট্টগ্রামে গিয়ে পৌঁছেছেন ফেরদৌস আক্তার। সেই সময়ে জানালেন একটু সময় লাগবে কথা বলতে। কারণ আয়োজন কম নেই। আইয়ুব বাচ্চুর ছোটবেলা আর কৈশরমাখা ভূমিতে তার স্মরনে আয়োজন তো বড় হবেই।

এরপর কথা বলতে শুরু করেই যখন জানতে চাওয়া হলো- কেমন আছেন! নিজেকে আটকাতে পারলেন না তিনি। কান্নায় ভেয়ে পড়ে জানালেন, “গত একবছরে এই জানতে চাওয়ার জন্য হলেও কেউ একটা বারও ফোন করেনি। আমি তার সহকর্মীদের কথা বলছি।”

তিনি আরও বলেন, “এই যে সকাল থেকে আয়োজন করছি- বুকে পাথর চেপে করছি।”

এরমাঝেই চট্টগ্রামে নেমে আসার পথেই দেখেছেন সড়ক দ্বীপের রুপালি গিটার। সেটা দেখে মা এবং মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব আবারও কান্নায় ভেঙে পড়েন। ফেরদৌস আক্তার বলেন, ‘আমরা ভাবতেও পারি না এতো কম বয়সে একটা মানুষ চলে যাবে আর স্মৃতি স্তম্ভ আমাদের দেখতে হবে।”

কথায় কথায় জানালেন গায়কের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কি কি আয়োজন করছেন। আইয়ুব বাচ্চু যা করতে ভালোবাসতেন সেগুলোই করা হবে, যেমন গরীবদের খাওয়ানো, এতিম শিশু কিশোরদের জন্য আহারের ব্যবস্থা, দোয়া- মোনাজাত ইত্যাদি।

আইয়ুব বাচ্চুর জীবন রাজহাঁসের জীবনের মত ছিল বলে জানান তার স্ত্রী। যে মানুষ গায়ে কোনও দুঃখ, বেদনা, কষ্ট লাগতে দেননি। অভিমান করেছেন, কিন্তু মাথা নত করেননি। তিনি কখনোই কারও সাহায্য চাননি বা সেটির আশাও করেননি বলে জানান ফেরদৌস আক্তার।

তবে শিল্পী হিসেবে সম্মান যা তার প্রাপ্য, সেটির জন্য মুখিয়ে থাকতেন। ফেরদৌস আক্তার কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন, “আইয়ুব বাচ্চুকে সারা দেশের মানুষ যে ভালোবাসা জানিয়েছে, তার মৃত্যুর আগে, পরে- সব সময়। সেই ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না। বিশেষ রে চট্টগ্রামের মানুষ তাকে ভুলে যায়নি। আমি এজন্য আমার পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ।”

তবে এ পর্যায়ে মনের সামান্য বেদনাও জানালেন তিনি। বলেন, “কিন্তু অবাক লাগে তার অনেক সহকর্মীও যখন তাকে মনে রাখে না। এই একটা বছর আমরা কোনও ফোনও পাইনি। কেউ জানতে চায়নি- আইয়ুব বাচ্চুর পরিবার কেমন আছে।”

এমন কী পশ্চিম বাংলার অনেক শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর প্রয়াণের পর তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও নিজ দেশের, একই মঞ্চের শিল্পীরা বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন বলে জানান শিল্পীর স্ত্রী।

এবারও তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনও বড় আয়োজন না দেখে বেশ হতাশ এবং হতবাক ফেরদৌস আক্তার। তিনি বলেন, “আমার আশা ছিল সরকারী এবং শিল্পীদের উদ্যোগে আইয়ুব বাচ্চুকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হবে। হয়নি- তাতে আমার রাগ নেই। কষ্ট পেয়েছি। এবং নিজেরাই যা করার করছি।”

এমনিতেও জীবিত অবস্থায় আইয়ুব বাচ্চু কখনোই চাইতেন না তার পরিবার মিডিয়ার সামনে আসুক। এমন কী মৃত্যুর পরেও ছেলে আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব ছাড়া পরিবারের  আর কেউ শহীদ মিনারে যাওয়া থেকে বিরত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি জানানম “আমরা চেয়েছি আইয়ুব বাচ্চুর ইচ্ছা সবসময় অপরিবর্তিত থাকুক। তার মৃত্যুর পর আমরা নিজেদের পাবলিসিটি চাইনি- চাবও না কোনও দিন।”

তবে তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি চাওয়া অবশ্যই আছে। সেটা হলো- শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর সম্পদ হলো তার সৃষ্টি করা সঙ্গীত। এই সঙ্গীতের যেন অপমান না করা হয়। ফেরদৌস আক্তার বলেন, “অবশ্যই আইয়ুব বাচ্চুর মত গুণি শিল্পীকে সবাই সম্মান জানাবে, তার গান গেয়ে তাকে ট্রিবিউট করবে। কিন্তু সুর যেন না বিকৃতি হয়। তার মৃত্যুর পর অনেকেই তার গান বিকৃত সুরে গেয়েছে। বিষয়টা দুঃখজনক এবং একজন প্রয়াত শিল্পীর জন্য অপমানজনক তো বটেই।”

তিনি আরও যোগ করেন , “আইয়ুব বাচ্চুর করা প্রতিটা গানের আইনি হিসাব আছে। রয়ালিটি- কপিরাইট সবই তার নামে। হ্যা, আমরা কোনও আইনি ব্যবস্থা নেব না। শুধু চাইবো এই শিল্পীর প্রতি অন্যদের সম্মান থাকুক। তারপরেও কেউ যদি সেটা না মানেন, আমার বিশ্বাস তাদের জন্য অসীমে কোনও আদলতের কাঠগড়া অপেক্ষা করবে।”

ফেরদৌস আক্তার, যার সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চু ঘর বেধেছিলেন ১৯৯১ সালের ৩১ জানুয়ারি, এতো বছরের হাতধরা মানুষটি চলে গেলে কেমন লাগবে সেটির জন্য শব্দ নয়, তার অশ্রুই যথেষ্ট। সেই অশ্রুর ধারা জমে আরও বেশি যখন স্ত্রী ফেরদৌস বুঝতে পারতেন, শরীর খারাপ স্বত্ত্বেও কিভাবে এই ব্যান্ড তারকা কনসার্ট নিতেন, গান গাইতেন- শুধুমাত্র তার সহকর্মীদের কথা চিন্তা করে।

স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার আইয়ুব বাচ্চুর এইসব অবদানের কোনও প্রতিদান চান না। শুধু চান সাধারণ মানুষ যেভাবে শিল্পীকে ভালোবেসে আগলে রেখেছেন, শুধু ব্যবসায়িক বা উপার্জনের জন্য নয়, শিল্পীকে তার সহকর্মীরাও এভাবে আগলে রাখুক।

আপাতত আইয়ুব বাচ্চুর সামাজিক মাধ্যমের দেখভাল করছে এই পরিবার। এ নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছেন ফেরদৌস আক্তার চন্দনা। তিনি মনে করেন,, আইয়ুব বাচ্চুর প্রতিটা বিষয়ই দেশের সম্পদ এবং তারপর পরিবারের অধিকার। এর কোনও দ্বিতীয় প্রশ্ন হতে পারেনা।

গ্লিটজের সঙ্গে আলাপ শেষে প্রয়াত ব্যান্ড লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনা বলেন, “এদেশের প্রশাসন, সরকার এবং সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষের ভালোবাসায় আমরা কৃতজ্ঞ। একজন শিল্পী মানেই মানুষের ভালোবাসা। তা টিকে থাকুক। এবং শিল্পীর পরিবারের জন্য দোয়া অব্যাহত থাকুক।”

ছবি কৃতজ্ঞতা: আইয়ুব বাচ্চু পরিবার

আরও পড়ুন: