ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অসংখ্য কমার্শিয়াল চলচ্চিত্রে অভিনয় করা ঋতুপর্ণাকে এখন ‘রাজকাহিনি’, ‘বেলাশেষে’র মতো ভিন্নধারার চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে। ক্যারিয়ারের বাঁক বদলের কারণ কী?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: আমির খান, শাহরুখ খান, হৃত্বিক রোশনও টিপিক্যাল কমার্শিয়াল চলচ্চিত্রের সঙ্গে কনটেন্ট নির্ভর সিনেমায়ও কাজ করছেন। তা না হলে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে চলতে পারব না। আমিও এখন কিছু দ্রষ্টব্যমূলক আর্টের কাজ করছি যেটা এখনকার দর্শকরা চাইছেন। সিনেমার কমার্শিয়াল ভ্যালুটাকে ঠিক রেখে আরও বিষয়ভিত্তিক ছবি করা গেলে সেটা অবশ্যই ভালো।
আমির খানের মতো সুপারস্টার ‘দঙ্গল’, ‘থ্রি ইডিয়টস’ করেছেন। বিদ্যা বালানও ভিন্ন ধরনের গল্পের চরিত্রে নিয়মিত কাজ করছেন। দীপিকা পাড়ুকোনের মতো গ্ল্যামারাস নায়িকাও একজন অ্যাসিড ভিক্টিমের চরিত্র করছেন।
আমার এখনকার চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘একটি সিনেমা গল্প’ ও ‘আহা রে’ কিন্তু কমার্শিয়াল। ক্যারিয়ারে আমি ব্যালেন্স আনতে চাইছি; দর্শকরা আমাকে সব রকমভাবে পাবে।
আমার কাছে ‘পার্সেল’ নামে একটি ছবি এসেছে। বিষয়টা খুবই ইন্টারেস্টিং। অনুরাগ কাশ্যপের সঙ্গে আমার হিন্দি ছবি ‘বাসুরি’ আসছে। আমি পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে এক্সপ্লোর করতে চাই। নতুন স্বাদের সিনেমার সঙ্গে থাকতে চাই।
আমাদেরও তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। আমি সিনেমাকে এতোটাই ভালোবাসি। সিনেমায় এক্সপেরিমেন্টটাই করতে চেয়েছি। এক্সপেরিয়েন্স ও এক্সপেরিমেন্ট-এই দুটোর মধ্যেই আমরা থাকতে চাই। সিনেমা আমার কাছে বন্ধুর মতো, সিনেমা আমার কাছে ভালোবাসার জায়গা। সিনেমা ছাড়া আমি কিছুই ভাবি না।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: একদম টিপিক্যাল কমার্শিয়াল সিনেমা সেই অর্থে সাকসেসফুল হচ্ছে না। সিনেমাকে এখন মানুষ অন্যভাবে দেখতে চাইছে। বরুণ ধাওয়ান ‘অক্টোবর’র মতো সিনেমা করছে, রাজকুমার রাও ভিন্নধারার সিনেমা করছে। আয়ুষ্মান খুরানাকে জ্বলন্ত উদাহরণ ধরা যেতে পারে! ‘আর্টিকেল ১৫’ করছেন। তারা সবাই বয়সে তরুণ। তবুও করছেন কারণ এখনকার সিনেমার প্যাটার্নটাই বদলে গেছে।
সাইফ আলী খান ‘সেক্রেড গেমস’ করছেন। সত্যি কথা বলতে, একদম কমার্শিয়াল সিনেমা চলছে না। দর্শকরা সিনেমা থেকে কিছু না কিছু বিষয় দেখতে চায়।
দর্শকরা তাহলে আগের তুলনায় ম্যাচিউর হলো বলে আপনি মনে করছেন?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: এক্সাটলি। তারা পুরো পৃথিবীর সিনেমা দেখে। নেটফ্লিক্স এসে গেছে। সারা পৃথিবী দেখতে পাচ্ছে এক জায়গায়। আমরা সিনেমাকে কতটা উর্বর করতে পারছি সেটাই বিষয়। সে হিসেবেই আমার চরিত্রে বৈচিত্র এনেছি। আমি রাজকাহিনী, দহন, পারমিতার একদিনের মতো চলচ্চিত্রে কাজ করেছি।
আমরা এখন আর কুক্ষিগত নেই যে, শুধুমাত্র চারটে ফাইট আর দুটো গান ইনজয় করছি। আমাদের উপভোগের মাত্রা ও প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। আমরা এখন ‘আন্ধাধুন’ ‘বাধাই হো’র মতো ছবি চাইছি। মানে সিনেমার কালচারটা কোথায় চলে গেছে! আজকে ‘কালাম’ ছবিটা যতটা অ্যাক্সেপ্টেড হওয়ার কথা ছিল ততটা অ্যাক্সেপ্ট করেনি। যেটা ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ চলচ্চিত্রে হয়েছিল। কিন্তু ছবিতে পছন্দের অ্যাক্টর থাকতে পারে আবার গানগুলো সুন্দরও হতে পারে। আমি সাবজেক্টের কথা বলছি।
আজকে যখন শ্রীদেবী ‘মম’, ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ করছে তখন হাইলি অ্যাক্সেপ্টেড হচ্ছে। উনি কিন্তু ‘তাথাইয়া তাথাইয়া’র নায়িকাও ছিলেন। সিনেমার কমার্শিয়াল ফ্লেভারটা চেঞ্জ হয়েছে। ‘বাহুবলী’ তো সবকিছু হতে পারে না। সেটা পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করা হয়েছে। সেটা তো সিনেমার উদাহরণ না। ইটস ওয়ান অব এ টাইপ, নট দ্য স্টেপ।
এখনও বাণিজ্যিক সাফল্যেই কোন সিনেমা ভালো আর কোনটি খারাপ তা নির্ধারণ করা হয়। বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: দর্শকপ্রিয়তা থাকতে হবে কিন্তু শুধুই দর্শকপ্রিয়তা না। ভালো সিনেমার মাপকাঠি কিন্তু অনেক রকম হয়। শুধুমাত্র কমার্শিয়াল সাকসেসই ভালো সিনেমার মাপকাঠি নয়। তাহলে নাসিরুদ্দিন শাহর ‘ইজাজাত’ এতো পপুলার হতো না। `লাম্ভে’ এতো পপুলার হতো না। ছবিটা অতো কমার্শিয়াল সাকসেস পায়নি কিন্তু জীবনের গল্প রয়ে গেছে। ভালো ছবি হতে গেলে ভালো বিষয়, ভালো অভিনয়, ভালো বার্তা থাকতে হবে। অনেক ছবি আছে কমার্শিয়াল সাকসেস না পেয়েও মানুষের হৃদয়ে রয়ে গেছে।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: সেই সিনেমাগুলোকে কোনোদিন প্রত্যাখান করতে পারব না। ওই সিনেমাই কিন্তু আমাকে আজকের ঋতুপর্ণা বানিয়েছে। আই অ্যাম প্রডাক্ট অব কমার্শিয়াল ফিল্ম।
ক্যারিয়ারের প্রায় শুরুর দিকে থেকেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কাজ করছেন; এখানকার দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছেন। এবার এসেছেন প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্নার কৃতাঞ্জলি প্রোডাকশনের ‘জ্যাম’ চলচ্চিত্রের শুটিং। শুটিয়ের অভিজ্ঞতা কেমন?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: বাংলাদেশ আমার খুবই প্রিয় জায়গা। বাংলাদেশে আসতে ভীষণ ভালোবাসি। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক। দেশটাকে খুবই আপন লাগে। এখানকার আর্টিস্ট, পরিচালকদের সঙ্গে আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটি আমার কমফোর্ট।
তাছাড়া বাংলাদেশে প্রচুর বন্ধু আছে, পরিবারের মতো হয়ে গেছে। সেই জন্যই সখ্যতা আমাদের নাড়া দেয়। বাংলাদেশে সত্যিই আমার ছবির চাহিদা তৈরি হয়েছে। ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিটিও দর্শকরা ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। এই জন্য মনে করি, বাংলাদেশে কাজ করাটা আমার জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার।
আপনার পরে কলকাতার কোনো আর্টিস্ট সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে..
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: সবাই এক সময় নতুন থাকে। আস্তে আস্তে পুরানো হয়। তাদের চাহিদা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা হয় আবার হয় না। হলে সেটিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করি। কিন্তু ইদানীংকালে চাহিদা কিংবা গ্রহণযোগ্য পাচ্ছে না।
‘জ্যাম’ সিনেমার সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন মান্না। তার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: মান্না ভাইয়ের চলে যাওয়াটা আমার মাঝে একটা ব্যথার জায়গা। মান্না ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম, আছি, থাকবও। উনি আমাকে বিভিন্ন ছবিতে রেকমেন্ডও করতেন। ওটা আমার খুব ভালো লাগে। মানুষটাকে আমি সম্মান করি এই কারণে যে, উনি শুধু অ্যাক্টর হিসেবেই ইন্ডাস্ট্রিতে ছিলে না। উনি বড় প্রোডাকশন করে ইন্ডাস্ট্রিতে কনট্রিবিউট করে গেছেন।
শুধুমাত্র নিজেরটা দিয়ে যাননি, অনেক দিয়ে গেছেন। তার সিনেমা থেকে অনেক বাণিজ্য হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি বেনিফিট করেছেন। ওনার সিনেমা করে অনেক ডিরেক্টর-প্রডিউসার দাঁড়িয়ে গেছেন। সিনেমাকে ভালোবাসতেন উনি। আমি চাইবো, কৃতাঞ্জলি প্রোডাকশন হাউস সামনে আরও ভালো করুক।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: আমি যদি থাকি, আমি নিশ্চয় শেলী আপার সঙ্গে ভালো একটি প্রজেক্ট করব। সিনেমার বিষয়টাকে চয়ন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ এই মুহূর্তে। এখন প্রতিযোগিতামূলক সিনেমা হচ্ছে। আমাদের সারাক্ষণ ভাবতে হয়, দর্শককে নতুন কী দিবো।
জ্যাম’ চলচ্চিত্রে আছেন আরিফিন শুভ। সাম্প্রতিক সময়ে ‘আহা রে’ ও ‘একটি সিনেমার গল্পেও আপনার সহশিল্পী হিসেবে শুভকে দেখা গেছে। শুভ কি আপনার জালে আটকে গেল?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: (হা হা) শুভ ভালো বলতে পারবে! ইন্সিডেন্টলি কিংবা কো-ইন্সিডেন্টলি শুভর সঙ্গে বেশ কয়েকটা কাজ করা হয়েছে। ওর সঙ্গে ম্যাচিং হয়। শুভর সঙ্গে নিশ্চয় সামনে আরও ভালো ভালো কাজ হবে। ওর ‘সাপলুডু’র ট্রেইলার দেখলাম। খুব ভালো হয়েছে। ও নিজেই বলছিল, আমি যখনই ঢাকায় আসি তখনই সিনেমা রিলিজ হয়। ওর জন্য শুভকামনা।
জ্যামের শুটিয়ে এসে ঢাকার জ্যামে পড়েছেন?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: ওহ এটাই তো বলতে চাইছিলাম। ঢাকা শহরে একটাই সমস্যা। তাও এবার একটু কম। আগের বার খুবই সমস্যা দেখেছিলাম। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগেছিল। আশা করছি, শিগগিরই সমস্যা কেটে যাবে।
সব শহরেই জ্যাম আছে কিন্তু এখানে একটু বেশিই। বেঙ্গালোরে, হায়দরাবাদেও প্রচন্ড জ্যাম আছে। জ্যাম নিয়ে কত রকম মিস আন্ডারস্টান্ডিং হতে পারে সেটাই তুলে আনা হয়েছে সিনেমায়।
জ্যাম নিয়ে কলকাতায় ‘অলীক সুখ’ নামে আরেকটি ছবি করেছিলেন…
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: হ্যাঁ। আমি দেশশঙ্কর হালদার ছবিটা করেছিলাম। জ্যামের পড়ার কারণে একটি বাচ্চা মারা যায়-এই রকম গল্প ছিল ছবিটর।
শেষ প্রশ্ন। আপনার প্রায় তিন যুগের ক্যারিয়ারে আপনার কোনো অপ্রাপ্তি আছে?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: আমার জীবনের অপ্রাপ্তি অনেক কম কিন্তু প্রাপ্তি অনেক বেশি। পাওয়ার তো কোনো শেষ নেই। কিন্তু যেটা পেয়েছি সেইটা কখনও ইগনোর করতে পারব না। এটাই বা কয়জন পায়। তবে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। আমার ভেতরের ক্ষুধাটা এখনও আছে। আরও কাজ করতে চাই।