বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি মুসলমানদের এলাকায় আজানের ধ্বনি শোনা যায় না। রাফি নামে এক পাহাড়ি কিশোর রমজানজুড়ে সেহরি ও ইফতারের সময় দৌড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইফতার ও সেহরির সময় জানিয়ে আসেন।
বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি, পাহাড়ে ধর্মীয় সম্প্রীতিকে তুলে ধরতেই বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে অনেকের অভিযোগ, বিজ্ঞাপনে ধর্মীয় সম্প্রীতির বদলে ভুলভাবে পাহাড়ি সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়েছেন।
বিজ্ঞাপনটি নিয়ে অঙ্কন চাকমা নামে এক একজন ফেইসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “অবাক করার বিষয় হলো, নির্মাতা এখানে পাহাড়ি ছেলেটির নাম ‘রাফি’ দিয়ে শুরু করেছেন। পাহাড়ি কোনও ছেলের নাম রাফি হতে যাবে কেন? একজন মানুষের নামের সাথে তার পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক সম্পর্ক থাকে। বৃহত্তর বাঙালি সম্প্রদায় ও পাহাড়ের মানুষের সংস্কৃতিগত পার্থক্যটা আকাশ-পাতাল।
“বিজ্ঞাপনের এই মাচাং ঘরটি বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ জানি না। তবে পাহাড়ের ছেলে হিসাবে বলতে পারি, আজ পর্যন্ত কোনও মুসলিম সম্প্রদায়কে দেখিনি এমন মাচাংঘরে থাকতে। প্রতিনিয়ত যেখানে পাহাড়ে ভূমি বেদখল হচ্ছে সেখানে নির্মাতা পাহাড়ের বসতবাড়িগুলো মনস্তাত্বিকভাবে দখল করেছেন কি না জানি না।”
“পাহাড়ের সহজ-সরল মানুষের অনূভুতিগুলো কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করার আগে প্লিজ একবার চিন্তা করুন গোটা দেশের মানুষের কাছে আপনি পাহাড়কে কিভাবে উপস্থাপন করছেন। পাহাড়ের মানুষের যে আলাদা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে-তা কতটুকু অক্ষুন্ন রাখতে পারছেন। পাহাড়কে বুঝতে গেলে তার কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে হবে।”
বিতর্কের মুখে বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের তিনদিন পর বুধবার ফেইসবুকে দেওয়া এক বিবৃতিতে নির্মাতা নুহাশ হুমায়ূন বলেন, “…কনসেপ্টটা হলো পরিবার নিয়ে। একটা প্রত্যন্ত গ্রাম। যেখানে মুসলিমরা হলো সংখ্যালঘু। এটা রমজান মাসের উপর ফোকাস করা একটা বিজ্ঞাপন। কিন্তু এর মূল ভাবনা শুধু রমজানের রোজা রাখায় সীমাবদ্ধ না। এটা একাত্মতা আর বন্ধনেরও গল্প।”
বিজ্ঞাপনে ধর্মীয় সামাজিক সম্প্রীতি দেখাতে গিয়ে ‘ফ্যান্টাসি’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আরেক নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন।
গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেডের কান্ট্রি হেড গাউসুল আজম শাওন ‘রানিং রাফি’ নিয়ে ফেইসবুকে লিখেন, “…আজকের সময়ের তরুণরাই যদি দেশের এইসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি সংবেদনশীল না হয়, তাহলে এই দেশের ভবিষ্যত আমরা কাদের হাতে ছেড়ে যাচ্ছি? গুলশানে বসে বৈশ্বিক হওয়া যাবে কিন্তু দেশের ভিতরের খবর রাখা যাবে না, এটা বড় দুঃখজনক।”
নুহাশ জানান, বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট তার নয়, আইমান তুরাসের। আইমান তুরাস জানান, কনসেপ্ট তার হলেও চিত্রনাট্য তার নয়; বি-রোল ফিল্মের। বি-রোল ফিল্মের কোনো বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
কনসেপ্টটি নিয়ে আইমান তুরাস জানান, সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা হয়েছে কনসেপ্টটি। সাজেক ভ্যালীতে একবার ঘুরতে গিয়ে উপলব্ধি করেন, সেখানে কোনও আজানের ধ্বনি শোনা যায় না। সেই ঘটনা থেকেই বিজ্ঞাপনের কনসেপ্টটি লেখেন তিনি।
বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরুণ নির্মাতাসহ অন্যান্যদের পাশাপাশি এর পেছনে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর দিকেও অভিযোগের আঙুল তোলেন গাউসুল আজম শাওন।
“ওই বাচ্চাগুলো যদি ভুল করেও থাকে, ওদের মাথার উপর বসে থাকা ম্যানেজমেন্টের মানুষগুলোর চোখে কেন এই ভুল ধরা পড়লো না? হয় এই বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোতে শৃঙ্খলার বড় ধরনের সমস্যা আছে অথবা তারাও ওই বাচ্চাগুলোর মতোই দোষী।
“ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কোনও একজন-দু'জন মানুষ কিভাবে, কোন চাপে ধর্মান্তরিত হয়েছে আর আমরা নেমে পড়লাম তাদের নিয়ে ফিল্ম বানাতে। আজকের এই অতি ডান রাজনীতির কাল সময়ে, আমরা বাঙালিরাই তো আলোর পথ দেখাবো। তাই আমাদের এইসব ভুল করলে চলবে না।”
দুঃখপ্রকাশ করলেন নুহাশ হুমায়ূন
‘একাত্মতা’ তুলে আনতে বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করলেও এটি অনেকের মধ্যে ‘বিভেদ’ তৈরি করেছে জেনে দুঃখ প্রকাশ করলেন নির্মাতা নুহাশ হুমায়ূন।
বুধবার রাতে ফেইসবুকে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, “যেহেতু বিজ্ঞাপনের প্রথমে লেখা দেখায় “অ্যা নুহাশ হুমায়ূন ফিল্ম’; তাই পরিচালক হিসাবে এর সব দায়িত্ব আমারই। এই বিজ্ঞাপনটা আমিই নির্মাণ করেছি, গল্পটাও আমার পছন্দ হয়েছে, এর স্ক্রিপ্ট আমি পরিমার্জন করেছি, যেই সোর্স থেকে তথ্য পেয়েছি-তাও বিশ্বাস করেই ব্যবহার করেছি।
বিষয়টি নিয়ে দর্শকদের কাছ থেকে পাওয়া মতামত ভবিষ্যতে তাকে আরও দায়িত্ববান ও যত্নশীল করে তুলবে বলে আশা করছেন তিনি।
বিবৃতিতে তিনি অভিযোগ করেন, অনেকে তার পরিবারকে টেনে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমন করছেন। বিজ্ঞাপনের প্রধান চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তাকেও নোংরাভাবে আক্রমন করা হচ্ছে।