মঙ্গলবার ভোরে সুবীর নন্দীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতি ঘটল বাংলা সংগীতের এ জনপ্রিয় জুটির। জীবদ্দশায় প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে একসঙ্গে গান বেঁধেছেন তারা।
মৃত্যুর সাত মাস আগেও সুজেয় শ্যামের সুরে পান্না লাল দত্তের লেখা ‘রাজ প্রাসাদের ঝাড়বাতিটা’ শিরোনামে একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সুবীর নন্দী।
তার কয়েকমাস পর ভারতের বেঙ্গালুরে দেখা হয় দুইজনের। সুজেয় শ্যাম ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন সেখানে। কথায় কথায় সুবীর নন্দী তাকে বলেছিলেন, ‘সুস্থ হয়ে একসঙ্গে আবারও গান করব দাদা। সুজেয় শ্যাম অভয় দিয়েছিলেন, চিন্তা করিস না। অবশ্যই গান করব’। কিন্তু সেই গান আর বাঁধা হল না।
দীর্ঘদিনের সহশিল্পীকে হারিয়ে ‘ব্যথিত’ সুজেয় শ্যাম স্মৃতিচারণ করলেন পুরনো দিনের। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এলো সুবীর নন্দীর শিল্পী হয়ে উঠা ও সংগ্রামের গল্প।
হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়ায় জন্ম নেওয়া সুবীর নন্দীর বাবার চাকরি সূত্রে শৈশব কেটেছে চা বাগানে। প্রাথমিকে পড়ার সময় মা পুতুল রানীর কাছে সংগীতে হাতেখড়ির পর ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন তিনি। ১৯৬৭ সালে সিলেট বেতারে প্রথম গান করেন।
গত শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ বেতারে গানের সুযোগ পেয়ে ঢাকায় এসে সুজেয় শ্যামের মগবাজারের বাসায় উঠেছিলেন তিনি। সুজেয় শ্যামের ভাষ্যে, বাসাটি সুবীর নন্দীর কাছে ‘সরাইখানা’ ছিল। বাসার ব্যালকনি, ছাদজুড়ে গানের সঙ্গে বিচরণ করতেন তিনি।
সেই স্মৃতিচারণ করে সুজেয় শ্যাম বলেন, “সামাদ ভাই (আব্দুস সামাদ) বললেন, নতুন একজন শিল্পীকে দিয়ে গানটা গাওয়াও। আমি বললাম, ভাই, সুবীরের নাম শুনেছেন? উনি বললেন, কিছু কিছু শুনেছি। পরে সুবীরকে দিয়ে ছবির জন্য দুইটি গান করলাম। তবে একটি ছবিতে রাখা হয়নি।”
‘দোষী হইলাম আমি দয়াল রে’ শিরোনামে লোকগানটির মধ্য দিয়েই প্লেব্যাকে অভিষেক হল তরুণ শিল্পী সুবীরের। গানটির জন্য তাকে নির্বাচনের কারণ হিসেবে সুজেয় শ্যাম বলেন,“ওর কণ্ঠে অসম্ভব দরদ দেখেছিলাম। ওর কণ্ঠে লোক সংগীতের সুরটা ছিল।”
পরে সুবীর নন্দীকে বেশ কয়েকজন সংগীত পরিচালকের কাছে পাঠান সুজেয় শ্যাম। তারা সুবীর নন্দীর কণ্ঠের মূল্যায়ন করতে পারেননি। অভিমান বুকে চেপে গান ছেড়ে সিলেটে চলেও যেতে চেয়েছিলেন।
“সেই সুবীর আজ কোথায় গেল? বাংলাদেশে আরেকটা সুবীর নন্দী আসবে?” আফসোস ঝরে সুজেয় শ্যামের কণ্ঠে।
নিজেকে প্রমাণের জন্য দিনের পর দিন সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে তাকে। তার সংগীত জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের গল্প শোনান সুজেয় শ্যাম।
“শুরুতে ওর উচ্চারণে একটু সমস্যা ছিল। আমার স্ত্রী ওকে শুদ্ধ উচ্চারণে সহায়তা করেছিল। একসময় জর্দা দিয়ে পান খেত। গানের জন্য পান খাওয়াও ছেড়ে দিল।”
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই সুজেয় শ্যামের সুরে ‘তুমি তো আমার তুমি তো আমার’, ‘আমি জীবনের আয়োজন সাজিয়েছি শুধু’, ‘ভালোবাসা কিছু আশা’র মতো হিট গানে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করেন নেন।
পরে ‘আশা ছিল মনে মনে’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়’, একটা ছিল সোনার কইন্যা’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’র মত গানগুলো আকাশ ছোঁয়া খ্যাতি দিয়েছে তাকে।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকেই কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন এ শিল্পী। ডায়ালাইসিসের জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হলেও গানকে ভুলে থাকতে পারেননি। সিলেট থেকে গান করে ফেরার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অবসান ঘটে একটি দীর্ঘ পথচলার।