সুবীর নন্দীর সুর সাধনার অবসান

অর্ধশতকের সংগীত জীবনে বাংলা গানের ভুবনে বহু জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে চিরবিদায় নিলেন কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2019, 02:37 AM
Updated : 8 May 2019, 03:39 AM

সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই শিল্পীকে বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

সুবীর নন্দীর দরদী কণ্ঠে ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’র মত বহু গান শ্রোতার হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে।

৬৬ বছর বয়সী এই শিল্পী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। নিয়মিতভাবে তার ডায়ালাইসিস করতে হত। এর মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে গত ১৪ এপ্রিল তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) ভর্তি করা হয়। ১৮ দিন পর তাকে নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে আইসিইউতে থাকা অবস্থায় তার ফের হার্ট অ্যাটাক হয়। তাকে চারটি রিংও পড়ানো হয়েছিল। কিন্তু আজ ভোরে সব শেষ হয়ে গেল।”

এই শিল্পীর মৃত্যুর খবর পৌঁছানোর পর দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় সুবীর নন্দীর মরদেহ সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছাবে। তার কফিন প্রথমে নেওয়া হবে তার গ্রিন রোডের বাসায়।

সেখান থেকে সকাল ৯টায় এ শিল্পীর মরদেহ নেওয়া হবে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। সেখানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।

বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ সুবীর নন্দীকে শেষ বিদায় জানাবে।

পরে তার কফিন রামকৃষ্ণ মিশন হয়ে বেলা ১টায় নেওয়া হবে সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালী মন্দিরে। সেখানেই হবে তার শেষকৃত্য।

২০১৯ সালের ২০ ফ্রেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে একুশে পদক নেন সুবীর নন্দী

১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়ায় সুবীর নন্দীর জন্ম। বাবার চাকরি সূত্রে তার শৈশব কেটেছে চা বাগানে। পরিণত বয়সে গানের পাশাপাশি চাকরি করেন ব্যাংকে।

প্রাইমারিতে পড়ার সময় মা পুতুল রানীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ির পর ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন সুবীর নন্দী। সিলেট বেতারে তিনি প্রথম গান করেন ১৯৬৭ সালে।

এরপর ঢাকা রেডিওতে সুযোগ পান ১৯৭০ সালে। রেডিওতে তার প্রথম গান 'যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়'। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান।

১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্লেব্যাকে আসেন সুবীর । ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় আজিজুর রহমান অশিক্ষিত। সেই সিনেমায় সাবিনা ইয়াসমিন আর সুবীর নন্দীর কণ্ঠে ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।

ধীরে ধীরে তার কণ্ঠের রোমান্টিক আধুনিক গান ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

‘আশা ছিল মনে মনে’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়’, একটা ছিল সোনার কইন্যা’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’র মত গানগুলো সুবীর নন্দীকে পৌঁছে দিয়েছে ভক্ত-শ্রোতাদের হৃদয়ে।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আড়াই হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দেওয়া সুবীর নন্দী চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চারবার বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন। সংগীতে অবদানের জন্য এ বছরই তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে সরকার।

তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’ বাজারে আসে ১৯৮১ সালে। ‘প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘ভালোবাসা কখনো মরে না’, সুরের ভুবনে, ‘গানের সুরে আমায় পাবে’ ছাড়াও ‘প্রণামাঞ্জলী’ নামে একটি ভক্তিমূলক গানের অ্যালবাম রয়েছে তার।