প্রকাশ্যে এলেন ‘মধু হই হই’ গানের মূল শিল্পী

নানা শিল্পীর কণ্ঠে ফেরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ‘মধু হই হই’র প্রকৃত শিল্পী আবদুর রশীদ মাস্টার এই প্রথম এলেন প্রকাশ্যে; জানালেন তুমুল জনপ্রিয় গানটির পেছনের গল্প এবং তার ক্ষোভের কথা।

রুদ্র হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2019, 11:23 AM
Updated : 6 Feb 2019, 11:23 AM

প্রেমিকা ‘মীনারা’কে হারিয়ে এক সাধারণ মানুষের ভেতর জেগে ওঠে বিচ্ছেদের সুর। সেন্টমার্টিন দ্বীপের সমুদ্রের তীরে বসে তিনি সৃষ্টি করেন একের পর এক গান; হৃদয়ের কষ্ট গাঁথেন সুরে ও কথায়।

কিন্তু বাদ্যের তালে তালে তা সবার সামনে গাইতে পারেননি তখনই। জাহাজে করে আসা এক বিদেশি পর্যটক তার গান শুনে উপহার হিসেবে হাতে তুলে দেন ম্যান্ডোলিন।

সে ম্যান্ডোলিন শিখে ২০০৪ সাল থেকে প্রকাশ্যে গান গাইতে শুরু করেন আব্দুর রশীদ মাস্টার। টুকটাক মার্শাল আর্ট জানায় লোকমুখে নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘মাস্টার’। বর্ষাকালে মাছ ধরতে সমুদ্রে যান তিনি আর শীতকালে সেইন্ট মার্টিন দ্বীপে আসা পর্যটকদের গান শোনান।

প্রেমিকা মীনারার বিচ্ছেদে লেখা ‘মধু হই হই’ গানটির তার মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক অনলাইন টেলিভিশন সিপ্লাসটিভির এডিটর ইন চিফ আলমগীর অপুর বয়ানে জানা গেল আব্দুর রশীদ মাস্টারের জীবনের গল্প। গত ৪ ফেব্রুয়ারি তার উদ্যোগেই সিপ্লাস টিভি লাইভে আসেন এ শিল্পী।

আলমগীর অপু গ্লিটজকে বলেন, “এই প্রথম প্রকাশ্যে এলেন এ শিল্পী। সাধারণত সেইন্ট মার্টিন থেকে বের হতে চান না। বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষী জনগোষ্ঠির ভেতর এ গানের জনপ্রিয়তা দেখে আমরা অনুসন্ধানের চেষ্টা করি মূল শিল্পীর। আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি সাইফুল আলম বাদশা সেইন্ট মার্টিনে তার বাড়িতে গিয়ে তাকে অনুরোধ জানান, আমাদের চ্যানেলে এসে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে।”

আলমগীর অপু জানান, গানের মূল কথা পরিবর্তন করেই গাওয়া হয়েছে গানটি। এতে ক্ষোভ আছে রশীদের।

 

গ্লিটজের কাছেও আক্ষেপের সুরে সে কথা জানালেন রশীদ মাস্টার। সেইন্ট মার্টিন থেকে বুধবার গ্লিটজকে তিনি বলেন, “পুরা গানটা কেউ গাইতে ফারে না। মূল গানটা কেউ বলে না। গানে একটা কথা আছে ‘কোন দুষহান ফাই ভালোবাসার মূল ন’দিলা’-এখানে সবাই বলে ‘কোন কারণে দাম ন’ দিলা’।  গানের শেষে আমার নাম আছে সেটাও ব্যবহার করা হয় না।”

রশিদ মাস্টার জানান, গানটির সৃষ্টি ২০০০ সালের আগে।

“আমার তো ওইভাবে হিসাব মনে নাই। ২০০০ সালের ফরে ২০০৩ এর দিকে সন্দীপন দাস আমার কাছ থেকে গানটা লিখে নিয়ে যায়। আমার কাছ থেকে অনেকেই এরকম করে, গান লিখে, ভিডিও করে নিয়ে যায়। সবাই আমার গানটা গায়, গানের মধ্যে আমার নামটাও বলে না। সবাই দাবি করতেছে, আমার গান, আমার গান, আমি লিখছি। আমি কী বলব, কী করব? আমি তো একটা গরিব মানুষ, আছি আমার মতো।”

সন্দীপন দাসের কণ্ঠ হয়ে দেশের জনপ্রিয় অসংখ্য শিল্পীদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া গানটি মোবাইল ফোন অপারেটর রবির বিজ্ঞাপনেও ব্যবহৃত হয় ভ্রাম্যমাণ ক্ষুদে শিল্পী জাহিদের কণ্ঠে। এমনকি ‘মধু মধু হই বিষ খাওয়াইলা’ নামে একটি চলচ্চিত্রও মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। চলচ্চিত্রটির আইটেম গান হিসেবে বিকৃত উপস্থাপনের সমালোচনাও আসে।

দারুণ জনপ্রিয় গানটি অনেকেরই ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটালেও মূল শিল্পী রশীদ মাস্টার মৎসজীবী হিসেবেই দরিদ্রতার ভেতর দিন যাপন করছেন। এ নিয়ে খুব বেশি আক্ষেপও নেই শিল্পীর মনে।

তিনি বলেন, “কার কাছে চাবো, আমি কার কাছে চাবো, আমার মতো আমি আছি। কেউ যদি আমাকে সাহায্য করলে পারতো, কেউ তো আমাকে তেমন করে না। চারিদিকে থৈ থৈ পানি, মাঝখানে একটা দ্বীপ, অল্প মানুষজন। এরকম একটা জায়গায় আমরা থাকি। মাছ ধরি, মাছ মারি। সিজন যখন আসে তখন টুরিস্টরা আমাকে খোঁজে। ওরা আমাকে ডাকলে আমি যাই, আমার গান শুনাই। কার কাছে চাবো, কেউ আমাকে মূল্য দেয় না। আমি গরিব মানুষ, বউ বাচ্চা নিয়ে থাকি। আমিতো আরও গান লিখছি, নিজে গাই, নিজে বাই (বাজাই)। আমি একটা ম্যান্ডোলিন বাই। কেউ ডাকলে গাই, না ডাকলে না গাই। দামাদামি করি না। হাজার হাজার পর্যটক আমার গান শোনে এটাই।”

‘মধু হই হই’ গানের জন্মকথন বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়লো রশীদের কণ্ঠে। তার ভাষ্যে, “এটা আমার প্রেমের একটা ইতিহাস। আমিতো প্রেম করছি, কিন্তু তাকে বিয়া-শাদি করতে পারি নাই। ওরে পাই নাই। ও আমারে যেরকম বলছিল, ওই রকম করে নাই। ওই উপলক্ষে গানটা গাইছি আরকি।”

সিপ্লাস টিভির লাইভ অনুষ্ঠানে রশীদ মাস্টারের কণ্ঠে ‘মধু হই হই’ গানটি।