দেশের দর্শকদের বঞ্চিত করেছি: অঞ্জু ঘোষ

‘মধুর ক্যান্টিন’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে যোগ দিতে ঢাকায় এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ খ্যাত নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষ। সাক্ষাৎকারে উঠে এলো তার শৈশব, অভিনয়ে জগতে আসা, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’য় কাজের অভিজ্ঞতা, ঢালিউডকে বিদায় জানিয়ে কলকাতায় থিতু হওয়ার কথা।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2019, 02:03 PM
Updated : 30 Jan 2019, 07:49 AM

গ্লিটজ: আপনার ছোটবেলা কেটেছে চট্টগ্রামে; শৈশবটা কেমন ছিল?

অঞ্জু ঘোষ: আমার শৈশবটা খুবই আনন্দের, শান্তির আর যত্নের ছিল। আমার ধারণা, সেকারণেই আমি শিল্পী হতে পেরেছি।

গ্লিটজ: অভিনয়শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কখনো?

অঞ্জু ঘোষ: একদমই না। এমনকি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগেও জানতাম না আমি শুটিং করছি। অভিনেত্রী হিসেবে মানুষ আমাকে এভাবে মনে রাখবে-এটা কখনোই ভাবিনি।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

গ্লিটজ: অভিনয়ে এলেন কিভাবে?

অঞ্জু ঘোষ: আমার প্রথম ছবি ‘আশির্বাদ’; নির্মাণ করেছিলেন তমিজ উদ্দিন রিজভী। তখন আমি চট্টগ্রামে থাকি, অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করি। চট্টগ্রাম থেকে পরিচালক আমাকে ঢাকায় আনলেন। একটা ছবিতে সাইন করার পর আরো চৌদ্দটা ছবির প্রস্তাব পেয়েছিলাম। এটা হয়তো অনেকেই জানে না। সেই যে অভিনয় জীবন শুরু হলো তারপর আর দম ফেলার ফুসরত পাইনি।

গ্লিটজ: অজ্ঞাত কিশোরী থেকে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। তারকা হয়ে উঠার হওয়ার পেছনে সংগ্রাম কেমন ছিল?

অঞ্জু ঘোষ: আমার ক্যারিয়ারে স্ট্রাগল বলতে কিছু না। এতোই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম যে, স্ক্রিন টেস্টেরও টাইম নিতে পারিনি। সরাসরি শুটিং করতে লেগে গেছি। কখনো রাত চারটা অব্দি শুটিং করেছি এফডিসিতে; পরে স্নান করে মেকাপ তুলে আবার আরেক ছবির শুটিংয়ে যোগ দিয়েছি।

গ্লিটজ: আশির দশকের শেষভাগে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন; তারকাখ্যাতির সেই দিনগুলো কিভাবে যাপন করতেন?

অঞ্জু ঘোষ: বেশিরভাগ তারকাকেই তো খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সবাই যেভাবে পড়ে আমিও সেভাবেই বিড়ম্বনায় পড়েছি।...এবার ঢাকায় এসেও তো বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

গ্লিটজ: কী ধরনের বিড়ম্বনা?

অঞ্জু ঘোষ: পাবনায় গেছি, ওখানে এক অন্ধ মহিলা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে, ‘তুমি আমাদের অঞ্জু’। খুলনা থেকে লাখ লাখ মানুষ আমাকে দেখতে পাবনায় চলে এসেছে। দেশের চলচ্চিত্রে আমার এতোদিন গ্যাপ গেছে, তারপরও এতো মানুষ আমাকে মনে রেখেছে দেখে সাংঘাতিক ভালো লেগেছে। আর বারবার মায়ের কথা মনে পড়ছে।

গ্লিটজ: আশি-নব্বইয়ের দশকে এখনকার চেয়েও অধিক জনপ্রিয় ছিলেন; জনপ্রিয়তার স্রোতের মাঝেও কলকাতায় ডুব দিলেন কেন?

অঞ্জু ঘোষ: (হা হা) ডুব দিলাম! কিছুই করিনি এখনো; এখনো কিছুই হয়নি। আমরা দু’দিনের কথা বলে কলকাতায় গিয়েছিলাম। মা খুব অসুস্থ ছিলেন; বাবা মারা গেলেন। ওখানে যাওয়ার পর মায়ের জন্য আটকে গেলাম। মায়ের জন্য যদি একটু সময় দিতে না পারি তাহলে জন্মগ্রহণ করে লাভ কী?

আমার ভাই মায়ের জন্য কানাডা থেকে কলকাতায় এসে থাকছে। ওখানেই বিয়ে থা করেছে। সত্যি বলতে, কারো উপর রাগ করে আমি দেশ ছাড়িনি; মায়ের জন্য দেশ ছেড়েছি।

গ্লিটজ: কিন্তু বাংলাদেশের দর্শকদের ভালোবাসায় তো আপনি তারকা হয়েছেন। ঢাকার চলচ্চিত্রে অভিনয় ছেড়ে সেই দর্শকদের বঞ্চিত করেছেন বলে মনে করেন?

অঞ্জু ঘোষ: এবার এখানে আসার পর বিষয়টি উপলব্ধি করলাম। এই জেনারেশনের মানুষ আমাকে এতো ভালোবাসে দেখে অবাক হয়েছি। তখন আমার মনে হয়েছে সত্যিই তাদেরকে বঞ্চিত করেছি।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

গ্লিটজ: প্রায় দুই যুগ বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি; দেশের চলচ্চিত্র জগতের বাইরে কেমন ছিলেন?

অঞ্জু ঘোষ: বাংলাদেশের সিনেমার বাইরে কিছু ভাবার ছিল না। সিনেমার বাইরে কী করে ভাবব?

 

গ্লিটজ: অঞ্জু ঘোষের নামের সমার্থক হয়ে উঠেছে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। বলা হয়, এটিই দেশের সর্বোচ্চ ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র। আপনার চোখে ছবিটির এতো দর্শকপ্রিয়তার কারণ কী?

অঞ্জু ঘোষ: প্রথমে তো ছবিটি চলেইনি! বকুল (তোজাম্মেল হক বকুল) অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর থেকে এই ছবির মাধ্যমেই ডিরেক্টর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ছবিটির কাজ শেষ করার পর আমি একের পর একটা সিনেমা করে যাচ্ছিলাম। একদিন বাসায় গিয়ে দেখলাম ছবিটির ‘আমারও লাগিয়া বন্ধু’ গানটা শুনে কাজের সাহায্যকারী ফিট হয়ে পড়ে গেল। বাড়ির সমস্ত কাজের লোক ওই গান বসে বসে দেখছে।

আমি ভাবলাম, কী আছে এর মধ্যে! ইন্ডিয়াতেও ছবিটি হলো। ওখানে ছবির নির্মাণের সময় বাংলাদেশের ছবির রক্ত নিয়ে মুখে দেওয়ার দৃশ্যটা দেখে ইন্ডিয়ার নির্মাতা হাততালি দিয়েছিল। আর সাপ নিয়ে এতে অভিনয় করাটা তো সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

গ্রাম-বাংলায় ছবিটা এমনভাবে সাড়া ফেলল, সেখান থেকে আর বের হওয়া গেল না। ছবিটির জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে বলব, এতে মাটির ছোঁয়া ছিল। সাধারণ মানুষ ছবিটি পছন্দ করেছে। সাধারণ মানুষ যে ছবিকে ভালোবাসবে সেই ছবিই সেরা।

গ্লিটজ: একটি ছবির জনপ্রিয়তার পেছনে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও জনসাধারণের রুচিবোধকে মানদণ্ড হিসেবে ধরা যায়। সে হিসেবে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ এখন নির্মাণ করা হলে কতটা জনপ্রিয়তা পাবে বলে মনে করেন?

অঞ্জু ঘোষ: যারা কাজটা করবে তাদের জন্য কাজটা হয়তো ঝুঁকিপূর্ণ হবে। খারাপ হতে পারে; আবার অনেক ভালোও করতে পারে। কিন্তু এটা সত্য, এই সময়ে কাজটা করলে ঝুঁকিটা কিন্তু থেকেই যাবে।

গ্লিটজ: ছবিটা নাকি প্রথমে ছেড়ে দিয়েছিলেন; কী কারণে?

অঞ্জু ঘোষ: ছবিটা নিয়ে অনেকে আমাকে বলেছিল, ‘এই নামে ছবি করবে? তাহলে একটা পলেটিক্স হয়ে যেতে পারে’। তখন আমার হাতে একাধিক বিগ বাজেটের চলচ্চিত্র। আশেপাশের মানুষগুলো বলছিল, ‘তোমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে ফেলবে এই ছবি।’ সেকারণে প্রথমে ‘হ্যাঁ’ বলিনি।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

গ্লিটজ: পরে নাম লেখালেন কেন?

অঞ্জু ঘোষ: আমি দেখলাম, ছবিতে মাটি ও মানুষের কথা আছে। তবে ছবিটি দর্শকদের এতোটা ভালো লাগবে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। তখন মান্নান সরকারের একটি ছবির শুটিং করছিলাম। বিকেলে শুটিংয়ে গিয়ে বকুল (তোজাম্মেল হক বকুল) বলল, ‘তুমি আমাকে ঘুরাচ্ছো কেন? ‘হ্যাঁ’ বলে দিতে পারছো না?’ তখন আমি ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম।

গ্লিটজ: এরপর তো পাকাপাকিভাবে তাঁবু গাড়লেন টালিগঞ্জে; কেমন ছিল বিদেশ-বিভুঁইয়ের যাপিত জীবন?

অঞ্জু ঘোষ: এখানে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ হওয়ার পর কলকাতায় হয়েছিল ছবিটি। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ করে ওখান থেকে আবার দেশে চলে এলাম। ঢাকার ছবিগুলোর ডাবিং শুরু করলাম। তখন আমার হাতে ৪৫-৫০টি ছবি ছিল। মাঝে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া ছিল।

একেবারে কলকাতায় গেলাম ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র মুক্তির ১৪ বছর পর। এর আগেও কলকাতার ছবি করেছিলাম। কিন্তু অনেকে লিখেছে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র পর একেবারে কলকাতায় চলে গেছি-এটা ঠিক না।

গ্লিটজ: কাটতির বাজারে টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র নিয়ে হতাশার বার্তা শোনাচ্ছেন সেখানকার নির্মাতা-অভিনয়শিল্পীরা। দীর্ঘদিন টালিগঞ্জের চলচ্চিত্রে সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতায় সেখানকার চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

অঞ্জু ঘোষ: কলকাতা ও ঢাকা-দুই ইন্ডাস্ট্রিকেই ভালোবেসেছি। ওরাও আমাকে ভালোবেসেছে। ওরা প্রফেশনালিজমকে সিরিয়াসলি মেইনটেইন করছে; কিন্তু এই দেশে সেটা মেইনটেইন করা হচ্ছে না। ওরা কিছু কিছু ভালো ভালো ছবি বানাচ্ছে। এখন তো তথাকথিত কমার্শিয়াল ছবি কেউ দেখতে চায় না।

গ্লিটজ: কলকাতায় স্থায়ীভাবে থাকছেন দীর্ঘদিন ধরে; সেখানে আপনার দিনকাল কেমন কাটছে?

অঞ্জু ঘোষ: ভালোই কাটছে। তবে এর বেশি কিছু আজ আর বলতে চাচ্ছি না।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি

গ্লিটজ: ঠিক আছে। আমরা ‘মধুর ক্যান্টিন’ চলচ্চিত্রে ফিরি; দীর্ঘ দুই যুগ পর বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন। ছবিটির সঙ্গে যুক্ত হলেন কিভাবে?

অঞ্জু ঘোষ: বিষয়টি আমার চাইতে সাঈদ ভাই (ছবির নির্মাতা সাঈদুর রহমান সাঈদ) বেশি ভালো বলতে পারবেন। আমার কলকাতার বাড়িতে যে কয়েকবার উনি গিয়েছেন সে কয়েকবারই ছবিটির কথা বলেছেন। অনেক আগে থেকেই ছবিটি করার কথা ছিল উনার। যে করেই হোক দেরি হয়ে গেছে।

গ্লিটজ: মধু দা’র স্ত্রী যোগমায়ার চরিত্রে অভিনয করছেন; প্রস্তুতি কী ধরনের নিয়েছেন?

অঞ্জু ঘোষ: স্ক্রিপ্টের কাজ চলছে। স্ক্রিপ্টটা এখনো হাতে পাইনি; হাতে পেলেই প্রস্তুতি শুরুর করব।

গ্লিটজ: বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রগুলো দেখেন?

অঞ্জু ঘোষ: বাংলাদেশের সিনেমা অনেকদিন দেখিনি, অনেকদিন। আমি ওখানে থাকার ফলে ছবি দেখা সম্ভব হয়নি।

গ্লিটজ: এখন থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নিয়মিত হওয়ার পরিকল্পনা আছে?

অঞ্জু ঘোষ: নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, পূর্ণাঙ্গ আন্তরিকতা নিয়ে কেউ সিনেমা করলে হয়তো করব।