অসংখ্য কালজয়ী বাংলা গানের সুরস্রষ্টা ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর আমাদের মাঝে নেই। তার চিরপ্রস্থানে শোকের হাওয়া বইছে সারাদেশে। সংগীতশিল্পী কনক চাঁপা তার কণ্ঠে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের অসংখ্য গান ধারণ করেছিলেন। তার সংগীত জীবনে প্রতিষ্ঠার পেছনেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার গানেই জীবনের অধিকাংশ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন শ্রোতাদের মনে ঠাঁই।
হাজারও গানের স্রষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের গান তৈরি করেছেন। কালজয়ী অসংখ্য গানের স্রষ্টা তিনি। কেমন ছিলো শিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের অন্তর্জগত? কেমন করে গান তৈরি করতেন তিনি? তাকে কাছ থেকে দেখা কনক চাঁপার বয়ানে পাওয়া গেলো সেসব উত্তর। কনক চাঁপা লিখেছেন-
“তার গানে প্রেম, বিরহ, কটাক্ষ, অনুরাগ, দেশপ্রেম, শিশুর সারল্য, সামাজিক নাটকীয়তা, বিদ্রোহ, চাওয়া মাত্রই পাওয়া যেতো। তাই ছবির গানের ফরমায়েশি জগতে তার কদর ছিল আলাদা। তার সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল নিজেই গান লিখতেন, তাই সুর আরও সুন্দর করে বসে যেতো। মনে হত, এই গানের সুর ও কথা একসাথেই জমজ হয়ে জন্ম নিয়েছে! তিনি আসলে একজন স্বভাবকবি ছিলেন। মুখে মুখে গান বানানোর অসম্ভব দক্ষতা তার ছিল। একই সাথে নিজের সৃষ্টি কে অবহেলা করার দারুণ স্পর্ধা ও ছিল। গান রেকর্ড হয়ে গেলে সে লেখা তিনি ছিঁড়ে ফেলতেন। আমরা আপত্তি জানালে বলতেন, “আমার গান আমি কেনো সংগ্রহ করবো। গান ভালো হলে কালের প্রবাহেই তা জমা থাকবে।”
“ব্যক্তিগত জীবনে বোহেমিয়ান টাইপ মানুষটা নিজের জন্য কিছুই করেন নাই। গান, গান, গান করেই জীবন পার করলেন। জীবনের প্রথম দিকে বেহালা গিটার বাজাতেন, মাঝ বয়সে এসে সেগুলোকেই আবার নতুন করে শেখার জন্য কি প্রচেষ্টাই না ছিলো তার! কিন্তু নিজেকে আরও জ্ঞানের গভীরে নিতে নিজেই নিজের শিক্ষক ছিলেন।”
শিল্পী হিসেবে কনক চাঁপার উত্থান নব্বই দশকে। এদিকে তারও প্রায় দুই দশক আগে থেকে সংগীতজগতে সদর্পে বিচরণ করছেন। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী কনক চাঁপা জানালেন, তার সংগীতজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের অবদান ছিলো সবচেয়ে বেশি। কনক চাঁপার কণ্ঠ শুনে তিনি নিজেই খুঁজে বের করেছিলেন তাকে-
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কনক চাঁপা বলেন, “সত্যিই সেদিন থেকেই আমার আর অবসর ছিলো না। বুলবুল ভাই মাসে গড়ে প্রায় দশটা ছবি হাতে নিতেন এবং তার বেশির ভাগ গান আমাকে দিয়েই গাওয়াতেন। নিজে অনেক গবেষণা করতেন কিন্তু গানের কন্ঠের ব্যাপারে নির্ভরশীল হতে চাইতেন। এরপর আসলেই আমাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রায় প্রতিটি গানই মাইল ফলক হয়ে যাচ্ছিল। তার গানেই প্রায় সব পুরস্কার পাওয়া আমার! তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।”
মৃত্যুর আগে শেষ কথপোকথনেও কনক চাঁপার কণ্ঠে নিজের গান শুনতে চেয়েছিলেন বুলবুল। কনক চাঁপা লিখেছেন, “ক’দিন আগে তিনি যখন অসুস্থ হলেন, খোঁজ নিতে ফোন দিলাম, তখন গানপাগল মানুষটা সব কথা বাদ দিয়ে বললেন, “ভাবী, অনেক সাধনার পরে গানটি ধরেন তো!” আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেতেই আমার হাজবেন্ড বললেন গাও, “আমি আরও বিপদে পড়তেই বুলবুল ভাই, গানটি নিজেই শুরু করলেন। আমি তার সাথে গলা মিলিয়ে পুরো মুখটি গাইলাম! হঠাৎ উনি আমাকে অনেক দোয়া করলেন! আমি হচকচিয়ে গেলাম। এটাই আমার ওনার সাথে শেষ কথা। পরিচয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওনার দোয়া পেয়ে গেলাম, সাথে পেলাম অসংখ্য অনবদ্য গান, যা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।”
“কি দিয়ে আমি তার ঋণ শোধ করি, আমি আসলেই জানিনা!”
মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল অংসখ্য জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান সৃষ্টি করেছেন। গানের কথায় দেশকে তুলে ধরতে জুড়ি ছিলো না তার। কনকচাঁপার ভাষ্যে, “অসম্ভব সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সারাজীবন তার গানেও অপার দেশপ্রেম, দ্রোহ, প্রতিবাদ তুলে ধরেছেন। ছবির গানেও তিনি নিজে বায়না করে দেশের গান ঢোকাতেন। আমি বিশ্বাস করি, আমরা পুরো জাতীই ধন্য যে আমাদের একজন ‘আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল’ আছে। আর একটি কথা আমি উচ্চকণ্ঠে বলতে চাই, ‘সব কটা জানালা খুলে দাওনা’ এই গানটি ছাড়া আর যদি কোন গানই সুর না করতেন তাহলেও বাংলাদেশ তাঁর কাছে সমান কৃতজ্ঞ থাকতো।