‘অপারেশন জ্যাকপট’ নির্মাণ বন্ধ?

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নৌ-কমান্ডোর অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রের নির্মাণ প্রক্রিয়া ‘স্থগিত’ করা হয়েছে; চলচ্চিত্রটির নির্মাণ শুরু হবে কি না, তার কোনো সদুত্তর মেলেনি চলচ্চিত্রটির প্রযোজনার দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2019, 11:57 AM
Updated : 19 Jan 2019, 12:04 PM

নৌ-কমান্ডোদের দুঃসাহসিক এ অভিযানের চলচ্চিত্রায়ন করতে ২০১৭ সালের মার্চে প্রকল্প একটি গ্রহণ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের আওতায় চলচ্চিত্রটির নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘মনপুরা’খ্যাত নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমকে।

দুই বছরে নৌ-কমান্ডোদের সঙ্গে কথা বলে চলচ্চিত্রেরও চিত্রনাট্য চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করেছেন তিনি; লোকেশন নির্ধারণের কাজও অনেকটা এগিয়েছে, পরিকল্পনা করেছিলেন কাস্টিং নিয়ে। সংগীত পরিচালক হিসেবে এ আর রহমানকে নেওয়ার পরিকল্পনা কথাও জানিয়েছিলেন সেলিম।

ছবি: ফেইসবুক থেকে নেওয়া।

নির্বাচনের আগে হঠাৎ তাকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘চলচ্চিত্রটির কাজ ‘স্থগিত’ করা হয়েছে।’

সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা আমাকে নিয়োগ দিয়েছে, সেই অনুযায়ীই কাজ করেছি। একটা জায়গায় এসে ওরা বলল, প্রজেক্টটা স্থগিত। এর বাইরে বিষয়টি নিয়ে আর কিছু জানি না।”

তবে স্থগিতের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করেনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

প্রতিষ্ঠানটির সচিব ওমর ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রজেক্টটি যে স্থগিত করা হয়েছে, তা না। ডিপিপি (ডিটেল প্রজেক্ট প্ল্যান) রিভাইজ করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল; বিষয়টি এখনও ওই রকমই আছে।”

তবে চলচ্চিত্রটির ‘ভবিষ্যত’ নিয়ে আপাতত কিছুই বলতে পারলেন না এ সচিব; সরকারি নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন বলে জানালেন তিনি।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছবিটি নির্মাণের জন্য ৩০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে ডিটেল প্রজেক্ট প্ল্যান পাঠানো হয়। কিন্তু নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় পরিকল্পনাটি গ্রহণ না করে প্রস্তাবনাটি ‘রিভাইজ’ করার জন্য চিঠি পাঠায় চট্টগ্রাম বন্দরকে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ভোলা নাথ দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারপর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এখনও বাজেট রিকাস্টের কোনো প্রস্তাব করা হয়নি।”

দীর্ঘদিন ধরে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চলচ্চিত্রের ডিটেল প্রজেক্ট প্ল্যানের ফাইলটি আটকে থাকায় আদৌ চলচ্চিত্র আলোর মুখ দেখবে কি না-তার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ডিপিপি পাস না হলেও ইতোমধ্যে এ চলচ্চিত্রের পেছনে চট্টগ্রাম বন্দরের ১ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিদায়ী নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্রটির সঙ্গে।

প্রকল্পটির সঙ্গে আগাগোড়ায় যুক্ত থাকা এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এই ১ কোটি টাকার বেশিরভাগ খরচ করা হয়েছে চিত্রনাট্যের পেছনে।

“চিত্রনাট্যের খরচের ভেতর আরও বেশ কয়েকটি খাত আছে। চিত্রনাট্যের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে, চলচ্চিত্রের লোকেশন নির্বাচন করা হয়েছে, লোকেশনে আসা-যাওয়া করেছে চিত্রনাট্যের সঙ্গে যুক্ত টিম- এগুলোর পেছনেই মূলত কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে।”

সম্মানী পাওয়ার কথা স্বীকার করে নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলেন, “আমি কোনো টাকা খরচ করিনি। আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চিত্রনাট্য লেখার জন্য; তার বিপরীতে আমি সম্মানী পেয়েছি। খরচ তো করা হয়েছে বন্দরের অ্যাকাউন্ট থেকে। এর বাইরে আর কিছু জানি না। বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন।”

ডিপিপি পাস হওয়ার আগেই চলচ্চিত্রটির পেছনে অর্থ খরচের বিষয়টি স্বীকার করেছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও।

সচিব ওমর ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, প্রি-প্রোডাকশন বাবদ যে অর্থ খরচ করা হয়েছে তা অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছে।

“এগুলো নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। এখন মূল কাজটা হবে কি না-সেটাই হলো বিষয়।”

বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে চলচ্চিত্রটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা সদ্য বিদায়ী নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি; কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন) মো. জাফর আলমও।

গত বছরের মাঝামাঝিতে তথ্য মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় চলচ্চিত্রটি নির্মাণের ঘোষণার দেওয়ার পর থেকেই চলচ্চিত্রে ‘ইতিহাস বিকৃতির’ তুলেছিলেন ‘অপারেশন জ্যাকপট’র অন্যতম সদস্য নৌ কমান্ডো আবু মুসা চৌধুরী।

নৌ কমান্ডো আবু মুসা চৌধুরী।

গত বছরের ৯ মে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি লেখেন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এ মুক্তিযোদ্ধা; চলচ্চিত্রে ‘ইতিহাস বিকৃতির’ অভিযোগের পাশাপাশি এতে সদ্য বিদায়ী নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানকে ‘অযাচিতভাবে হাইলাইট’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে তিনি দাবি করেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের টাকা খরচ করে চলচ্চিত্রে ‘অসত্য তথ্য’ তুলে আনা হচ্ছে।

তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তোপের মুখে থাকা তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ছবির চিত্রনাট্য ঠিক আছে কি না, তা প্রধানমন্ত্রী নিজে দেখবেন।

গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর চলচ্চিত্রটির মহরত হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে এসে তা আটকে যায়।

১৯৭১ সালের ১৫ অগাস্ট চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একযোগে বাংলাদেশের নৌ কমান্ডোদের প্রথম অপারেশন ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’।

মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন, তাদের এই অভিযান সফল হলে বাঙালি জাতিকে তা এগিয়ে নেবে বিজয়ের বন্দরের পথে। আর ব্যর্থতার ফল হবে মৃত্যু। এ কারণে লিম্পেট মাইন নিয়ে মরণপন সেই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’।