২১ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সংগীতের গুরু খ্যাত আজম খান। ভারতের মেঘালয়ের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কখনও বাটি, চামচ, কৌটা, ডিব্বায় টুংটাং সুর তুলে গানের তালে সহযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছেন; কখনও অস্ত্র হাতে যোগ দিয়েছেন সাহসী গেরিলা অপারেশনে।
Published : 16 Dec 2018, 05:37 PM
ঢিলেঢালা টি-শার্ট আর রঙচটা জিন্স পরা এক উঠতি শিল্পী থেকে আজম খানের কণ্ঠযোদ্ধা-মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠার গল্প বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনালেন তার কন্যা ইমা খান।
রাজধানীর আজিমপুরে জন্ম নেওয়া এ শিল্পী পরিবারের সঙ্গে কমলাপুরে চলে আসেন পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে। কমলাপুরের আলো-হাওয়ায় কৈশোর পেরোনো আজম খান গান শুরু করেন ষাটের দশকের গোড়ার দিকে। গান বলতে, রোজ সন্ধ্যায় গলির মোড়ে গিটার বাজিয়ে চায়ের কাপে কোরাস তোলা।
পাড়ায় পাড়ায় হামলে পড়ছে হানাদাররা। আজম খানদের বাড়িতেও একদিন অস্ত্র উঁচিয়ে হাজির তারা। ছেলের খোঁজে মা-বোন-বাবাকে তিরস্কার করে গেলেন।
আজম খানের ভাই আলম খানের বরাত দিয়ে ইমা খান বললেন, “দাদাকে (আজম খানের বাবা) যখন পাকিস্তানীরা জেরা করছিলেন, তার ছেলেদের খুঁজছিলেন, ছেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে দাদা দুই রাকাত নামাজ পড়তে চান। তারা তাকে নামাজ পড়তে দিয়েছিল। সেইবার কিছু না পেয়ে হানাদার বাহিনী চলে গিয়েছিল।”
গিটার ফেলে গানের বন্ধুদের নিয়ে অস্ত্র হাতে যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। কুমিল্লা বর্ডার পেরিয়ে ত্রিপুরার আগরতলা হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে গেলেন মেলাঘরে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের ২নং সেক্টরে মেজর এটিএম হায়দারের কাছে দুই মাস গেরিলার যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর।
“প্রশিক্ষণ শেষে সন্ধা ৬টার পর সদলবলে সবাই ক্যাম্পে আত্মশক্তি জাগানোর জন্য বাটি, চামচ, ক্যান, কৌটা, ডিব্বা পিটিয়ে বাজিয়ে সবাই মিলে গাইতেন গণসংগীত।”, বাবাকে নিয়ে আলাপচারিতায় ইমা খান।
সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কুমিল্লার অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তার সঙ্গে বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন জাকির, রুমিন, সাবু, ফোয়াদ ও ছোটভাই খোকা। কুমিল্লার অপারেশনে সাফল্য পাওয়ায় ঢাকার একটি গেরিলা গ্রুপের সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয় আজম খানকে। যাত্রাবাড়ি, ডেমরা, গুলশানসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সম্মুখ সমরের নেতৃত্ব দেন তিনি। তিনি গেরিলা অপারেশন ‘ক্র্যাক প্লাটুন’র অন্যতম সদস্য।
যু্দ্ধের মাঝে হঠাৎ খবর এলো ছোটভাই খোকাকে ধরে নিয়ে গেছে হানাদাররা; নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভাইকে পাকিস্তানীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার পরবর্তী দেশের বিভিন্ন স্থানের ধ্বংসস্তুপ, লাশ, গণকবর দাগ কাটে তার মনে। বুকভরা আফসোস নিয়ে কণ্ঠে তুলেছিলেন, ‘হায়রে হায় বাংলাদেশ’, ‘জীবনে কিছু পাব না রে’, ‘ওরে ও সালেকা ওরে ও মালেকা’, ‘সব মানুষই সাদা কালো’র মতো কালজয়ী গান। বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী।
২০১১ সালের ৫ জুন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোকে পাড়ি জমানো এ শিল্পী এখনও বাংলা গানের জগতে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছেন।