আমি প্রেম বুঝি না: ডিপজল

দাপুটে খলনায়ক মনোয়ার হোসেন ডিপজল চলচ্চিত্রে এসেছিলেন নায়ক হওয়ার স্বপ্নে; ঘটনাক্রমে খলনায়ক হিসেবে অভিনয় করে খ্যাতির চূড়ায় উঠেন ‘ভয়ংকর বিষু’ খ্যাত এ অভিনয়শিল্পী।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2018, 03:07 PM
Updated : 28 Nov 2018, 03:11 PM

সাভারে নিজের বাসায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মুখোমুখি হন তিনি। দীর্ঘ আলাপাচারিতায় তার অভিনয়শিল্পী হিসেবে উঠে আসা, সংগ্রাম, চলচ্চিত্রের সংকটসহ নিজের ভালোলাগার নানা বিষয়ে কথা বলেন।

গ্লিটজ: ছিলেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী; হঠাৎ অভিনয়ে এসেছিলেন কেন?

ডিপজল: শুরুর দিকে ব্যবসা করলেও পরে ফিল্ম নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ১৯৮৬ সালে আমার প্রথম প্রথম ছবি বের হয় ‘টাকার পাহাড়’। তারপর করলাম ‘হাবিলদার’। বছর পাঁচেক পর কাজী হায়াতের ‘তেজি’ ছবিতে প্রথমবারের মতো ‘এন্টি হিরো’ হিসেবে পর্দায় এলাম।

প্রায় ১৩ বছর কাজ করলাম খলনায়ক হিসেবে। পরে ‘চাচ্চু’ ছবিতে হিরো হিসেবে এলাম। অভিনয় করবো না-এটা কোনোদিন মনে আসে না। যতদিন জীবিত থাকব ততদিন কাজ করব।

মারা যাওয়ার পর তো আর করার কিছু থাকে না। এবার তো চলেই তো গিয়েছিলোম। হার্টে নয়টা ব্লক হলো। দেশের বাইরে চিকিৎসা করালাম।

গ্লিটজ: নায়ক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরুর পর খলনায়ক হিসেবে আপনার ক্যারিয়ারের বাঁকবদল হলো। নায়ক হিসেবে সাফল্য না পাওয়ার কারণেই খলনায়ক হয়েছিলেন?

ডিপজল: এটা পরিকল্পনা করে করিনি। তখন ইন্ডাস্ট্রিতে ভিলেনের সংকট ছিল। পরে যখন আবার হিরোর সংকট শুরু হলো তখন হিরোতে ঢুকলাম। আমার মনে হয়, কোনো আর্টিস্ট কাজ জানলে ‘হিরো’ কিংবা ভিলেন’ না ও দাঁড়াইলেই ভালো কাজ করবে। কাজ শিখতে হবে, জানতে হবে।

গ্লিটজ: অভিনয় শুরুর পর প্রায় তিন দশক কেটে গেল। দিনে দিনে আজকের ডিপজল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আপনার ক্যারিয়ারের সংগ্রামের গল্প জানতে চাই।

ডিপজল: যেখানে যে অবস্থায় ছিলাম সেটাকেই মেনে নিতাম। প্রত্যেক জাহাজে একজন নাবিক থাকেন। নাবিক যেদিকে টার্ন নেবেন জাহাজ সেদিকেই যাবে। একজন ডিরেক্টরকে আমি নাবিক মনে করি।

কোনো ছবি করার আগে গল্পটা দেখতাম। গল্পটাই যদি ভালো না হয় তাহলে নাবিক জাহাজ চালালেও হবে না। আমি গল্প মোটামুটি বুঝি। এখনও আমার কাছে অনেক ছবি আসে কিন্তু মন মতো হয় না বলে করা হয় না।

আমার ছবি এখনও টিভিতে চললে ঘরের রান্না বন্ধ হয়ে যায়। আমার ছবি দেখার জন্য মানুষ পাগল হয়ে থাকে। আমার ছবিতে দর্শক অনেক জায়গায় অনেক কিছু দেখতে পারে।

ছবি দেখে কখন কান্না আসবে বুঝতে পারবে না। আগামীতে যে কয়টা ছবি করব ভালোভাবে করব। দর্শকদের দেখার আনন্দ দেবো।

গ্লিটজ: পর্দায় আপনি ‘ভয়ংকর বিষু’ রূপে আবির্ভূত হন। ব্যক্তিগত জীবনে আপনার চোখে ‘ডিপজল’ কেমন?

ডিপজল:
 ডিপজল অবশ্যই ভালো মানুষ। যে আমার সঙ্গে মিশেছে, কথা বলেছে তার অবশ্যই ভালো লাগবে। আমার সঙ্গে একবার যে বসবে সে আমাকে খুঁজবে, আমার সঙ্গে মেশার চেষ্টা করবে। কারণ আমার কোনো লোভ নেই। আল্লাহ যা দিয়েছেন সেটাই অনেক। মানুষের লোভ-লালসা থাকলে আরও বড় হতে চান। মানুষ কত বড় হতে পারেন?

গ্লিটজ: সরাসরি আপনাকে দেশে কারও ভয় পাওয়ার কোনো ঘটনা আছে?

ডিপজল: এই ধরনের কোনো ঘটনা চোখের সামনে পড়েনি। যার সঙ্গে পরিচয় হয় আমার হাসিটা আগে চলে আসে। কারও উপর রাগ করার পরিবেশ হয়ে উঠেনি।

গ্লিটজ: জীবনকে কিভাবে দেখেন?

ডিপজল: ওপেন হার্ট করার পর নাকি মানুষ বাঁচে কম আবার বাঁচেও বেশি। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করালাম। কয়েকদিন আগে চেকআপ করালাম। এখন আমার চাওয়া, সুন্দরভাবে যেন মৃত্যুটা হয়।

গ্লিটজ: আপনার জীবনের চাওয়া-পাওয়া পূরণ হয়েছে?

ডিপজল: সব পূরণ হয়েছে। আমার আর চাওয়ার কিছু নাই।

গ্লিটজ: চলচ্চিত্রে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেই হঠাৎ নিজের জগতে ডুব দিলেন; কাজে আর নিয়মিত দেখা গেল না কেন?

ডিপজল: ভালো-খারাপ মিলেই তো দুনিয়া; ফিল্মের মধ্যেও কিছু বাজে লোক ঢুকে গেছে। বাজে মানে খারাপ না। ফিল্ম বোঝে না; কিন্তু ওরা ভাবে সব বুঝছে। বাংলাদেশের মানুষের যার পকেটে টাকা থাকবে তখন যা খুশি তাই করে।

চলচ্চিত্রে টাকা ইনভেস্ট করতে এলো প্রাইভেট কার নিয়ে বের হলো রিকশা নিয়ে। এখন যারা ফিল্মের কাজ করছে-তারা অজ্ঞ। ছবির গল্প বুঝতে হবে তারপর ছবি বানাতে হবে। শুধু টাকা হলেই ছবি হয় না।

গ্লিটজ: কিন্তু যারা আপনার মতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ইন্ডাস্ট্রির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এগিয়ে আসার উচিত বলে মনে করেন অনেকে।

ডিপজল: ইনশাল্লাহ। আমি সুস্থ হয়েছি, মাস দুয়েকের মধ্যে কাজ শুরু করব। আমার তিন-চারটা কাজ শেষ করা আছে। নতুন করে আরও কাজ আরম্ভ করব।

গ্লিটজ: চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বলেন, অশ্লীল যুগে দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে। সেই সময়টা আপনি খুব কাছে থেকে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে দেখেছেন। আপনার কী মত?

ডিপজল: অশ্লীলতার চেয়েও বড় যুগ এখন এসেছে না? ফিল্ম ধ্বংস করে দিয়েছে, দেশও ধ্বংস করে দিয়েছে। কালচারই পরিবর্তন করে দিয়েছে। ইন্ডিয়ান ছবি চলছে বাংলাদেশে। ইন্ডিয়ান ছবি বাংলাদেশকে আরও বেশি ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের কালচার আর ইন্ডিয়ান কালচার কোনোদিনই এক হতে পারে না। ওদের বাংলা কথা আর আমাদের কথা মিল হতে পারে না। প্রচুর ছবি আসছে কিন্তু একটা দুইটা ছবির বেশি চলছে না।

ওদের বিশাল বড় মার্কেট। আমাদের ক্ষুদ্র জায়গা। আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে আমরা বাঁচতে চাই। সেদিন দেখলাম, এফডিসি একটা অন্ধকার ভূতের গলি। কোনো ছবি নাই, কাজ নাই। অনেকে কান্নাকাটি করলো। যারা ফিল্মে কাজ করে তারা অন্য কোথাও যেতে পারে না।

গ্লিটজ: এই পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যত কী অবস্থা দেখছেন?

ডিপজল: ইন্ডাস্ট্রি তো এখন বন্ধই হয়ে গেছে। কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। সিনিয়র ডিরেক্টররা নেই, নেতারা নাই; মারা গেছেন বেশিরভাগ। শুনলাম আমজাদ হোসেন ভাই  অসুস্থ। উনি খুব অভিজ্ঞ ডিরেক্টর। দিলীপ বিশ্বাসও ভালো লোক ছিলেন। এই টাইপের লোক নাই। এখন বেড়েছে টাকার চাহিদা। এখন ভালো কিছু উদ্যোগ দিতে হবে।

গ্লিটজ: সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই আপনি কয়েকটি চলচ্চিত্র করছেন?
 

ডিপজল: হ্যাঁ। কয়েকটা ছবি শেষ করেছি। নতুন করে আরও কয়েকটা ছবি করব। আমার গল্প বানাতে ২ মাস থেকে ৩ মাস লাগবে। আর এখন যারা ছবি বানাচ্ছে এগুলো ছবি না নাটক?

ছবি আর নাটকের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। নাটক দেখতে দেখতে টিভি চ্যানেল পাল্টানো যায়। কিন্তু একটা ছবি তিন ঘণ্টা ধরে দেখতে হবে, এক সিটে বসে। ছবির মধ্যে বহু কিছু থাকতে হবে। এখন যারা বানাচ্ছে সেগুলো নাটক। নাটক কোনোদিন ফিল্ম হয় আর ফিল্মও কোনোদিন নাটক হয় না।

গ্লিটজ: নির্দিষ্ট করে কোন বৈশিষ্টের কারণে আপনি সেগুলোকে নাটক কিংবা সিনেমা বলে বিভাজন করছেন?

ডিপজল: নাটক হলো টিভির আর ফিল্ম হলো সিনেমা হলের।

গ্লিটজ: ভালো-মন্দ মিলিয়ে অনেক ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। স্বপ্নের কোনো চরিত্র আছে কি-না সেটা আপনি করতে আগ্রহী?

ডিপজল: সামনে কিছু ছবির নিয়ে কাজ করেছি। সালমান খান একটা বাচ্চা নিয়ে কিছুদিন আগে ছবি করেছে। ওই ধরনের গল্প নিয়ে আমি একটা সিনেমা করব।

গ্লিটজ: বিখ্যাত কোনো লেখকের চরিত্রে কাজ করতে চান?

ডিপজল: গল্প ভালো হলে অবশ্যই করব। আমি হলাম গল্পের পাগল। আপনি টাকা দিবেন আমি ছবি করব না। আমি চাইলে প্রতিদিনই অনেকগুলো ইন্ডিয়ার ছবি ধরতে পারব। আমি আরেক দেশের কামলা খাটা লোক না। বাংলাদেশের ছবি নিয়েই থাকতে চাই।

গ্লিটজ: খলনায়ক হতে চাইলে একজন তরুণ শিল্পীর কী কী যোগ্যতা থাকা চাই?

ডিপজল: ভিলেনকে হিরোর চেয়েও সুন্দর হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ওর জানা থাকতে হবে-আমার এই এই বিষয়গুলো লাগবে। চলাফেরা ভঙ্গিমা-সবকিছুর মধ্যে ভিলেনের লুক লাগবে।
 

গ্লিটজ: বেশিরভাগ শিল্পী খলনায়ক না হয়ে নায়ক হতে চায় কেন?

ডিপজল: বিষয়টা নির্ভর করছে, গল্পটা কার উপর? ৩ ঘণ্টার ছবি হলে দুই ঘণ্টা ৪৫ মিনিট হিরো থাকে ভিলেন। আর শেষ ১৫ মিনিট হিরো থাকে হিরো। পর্দায় একাই রাজত্ব করে খলনায়ক। ফাইট করে শেষে জিতলে সে হয়ে যায় বাংলাদেশের হিরো।

আমিও এক সময় ভিলেন ছিলাম। আমাকে কে কত গালি দিতে পারে-সেগুলো নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আবার যখন হিরো হয়েছি তখন আবার হিরো। ভিলেন হওয়ার সময় অনেক ডায়লগ বিখ্যাত হয়েছে। এর মধ্যে ‘সানডে মানডে ক্লোজ’, ‘খাইছি তোরে’ ডায়লগগুলো এখনও দেখি অনেকে বলে।

গ্লিটজ: আপনার প্রিয় অভিনেতা কেন?

ডিপজল: যে ভালো অভিনয় করে সেই আমার প্রিয় অভিনেতা!

গ্লিটজ: কার অভিনয় আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?

ডিপজল: কারো অভিনয় দেখে কাজ করা সম্ভব হয় না। আমি যা তেমনই থাকতে চাই। কাউরে দেখার সময় আমার নাই। একটা ছবির গল্প ভালো হলে দেখি। কারো অভিনয় ভালো লাগে এটা ভেবে দেখি না। তবে ফারুক ভাই, রাজ্জাক ভাই, শাবনূর, শাবানা ম্যাডামের ছবি ভালো লাগে।
 

গ্লিটজ: প্রিয় কাজ?

ডিপজল: লেখালেখি বেশি করি। আর ফিল্ম নিয়েই থাকতে চাই। সাতটা গল্প লিখছি।

গ্লিটজ: গল্পগুলো আপনিই লিখেছেন?

ডিপজল: নাহ! শুধু লাইনআপ করে দিয়েছি। লেখাটা অন্যদের।

গ্লিটজ: প্রিয় মানুষ?

ডিপজল: বাবা-মা ছিল; মারা গেছেন।

গ্লিটজ: প্রিয় জায়গা?

ডিপজল: মসজিদ; নামাজঘর।

গ্লিটজ: প্রেমে পড়েছেন কখনও?

ডিপজল: বিয়ে করেছি; ছেলে-মেয়ে হয়েছে।

গ্লিটজ: প্রথম কবে প্রেমে পড়েছিলেন?

ডিপজল: আমি প্রেম বুঝি না। প্রেম মানে; বিয়ে করেছি অল্প বয়সে। ওদের নিয়েই ভালোবাসা। পরিবারটাই আমার আসল বিষয়।

গ্লিটজ: শেষ প্রশ্ন। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ধরে নিয়ন্ত্রিত জীবনটা কেমন চলছে?

ডিপজল: ডাক্তারদের নিয়ম মেনে তো চলতে পারি না। যেটা খেতে মানা করে ওটার দিকেই চোখ যায়। (হা হা)