স্মৃতিতে আজম খান ও আইয়ুব বাচ্চু

পপগুরু আজম খান ও ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য লিখলেন আজম খানের মেয়ে ইমা খান।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2018, 01:46 PM
Updated : 31 Oct 2018, 01:46 PM

যতদূর জানি, কৈশোরে আইয়ুব বাচ্চু চট্টগ্রামের এক কনসার্টে পপগুরু আজম খানের কনসার্ট দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তখন ‘স্পন্দন’ ব্যান্ডে নয়ন নামের একজন গিটারিস্ট ছিলেন, তার বাজানোর স্টাইল তাকে (এবি) অভিভূত করেছিল। তাকে দেখেই গিটারিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।

একবার আজম খানের সঙ্গে দেখা করতে এলেন আইয়ুব বাচ্চু। আজম খান ভেবেছিলেন, রাজকুমারের মত দেখতে কোঁকড়া চুলের ছেলেটা কে? পরে জানলেন, ছেলেটি তার একজন ভক্ত। দোয়া করেছিলেন তার জন্য। কিন্তু সেদিন তিনি জানতেন না, সেই ছোট ছেলেটিই আজকের আইয়ুব বাচ্চু হবেন। বাবার দোয়া আর নিজের মনের বাসনা নিয়ে বড় হতে থাকলেন তিনি।

চট্টগ্রামে একটি ব্যান্ডও করে ফেললেন; নাম ‘সোলস’। দলের বাকি সদস্যের সাথে মনোমালিন্যের কারণে দল থেকে বেরিয়ে ‘ফিলিংস’ নামে আরেকটি ব্যান্ডের সদস্য হলেন। পরবর্তীতে নিজের মতো করে কিছু করার জন্য সে দল থেকেও এক সময় বেরিয়ে এলেন।

হাতে গিটার আর মনে শিল্পী হওয়ার বাসনা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে এলেন তিনি। এলিফ্যান্ট রোডের একটি ছোট কামড়ায় গিটার নিয়ে নিয়মিত গান চর্চা করতেন। মাঝে-মধ্যে কিছু বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে গান গাইতেন। তার সেই অপূর্ণ স্বপ্নকে সত্যি করতে তখন এবির পাশে দাঁড়ালেন গুণী সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। রুনা লায়লা তাকে সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিলেন।

দিনে দিনে গানের ভুবনে অনেক দূর পাড়ি দিলেন এবি। সেই সঙ্গে সংগীত ও সংস্কৃতি জগতের অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তার। ১৯৯২ সালে ‘এলআরবি’ নামে একটি ব্যান্ডও গঠন করলেন।

একদিন তিনি সন্ধান করে চলে এলেন বাবার (আজম খান) বাসায়। বাবা সবকিছু জেনে-শুনে যেমন অবাক হয়েছিলেন তেমন খুশিও হয়েছিলেন। একদিন এবিকে আমার কাছে এনে বাবা বললেন, ‘মা, তুই ওকে দোয়া করে দে। বড় ভাল ছেলে।’ মহৎ মানুষের মত উদারতার হাসি হাসতেন তিনি। আমার সাথে তার কথা হত কম, দেখা হলে হাসতেন শুধু। বাবার সাথে তার অনেক আলাপ হত আর বন্ধুত্ব ছিল ভাল। একদিন শুনি বাবা ক্যাসেট প্লেয়ারে আইয়ুব বাচ্চু আংকেলের গান বাজাচ্ছেন আর সাথে সাথে গাইছেন। আমি বলি কি ব্যাপার এই গানগুলো তো আগে শুনিনি। জানলাম বাবা উনার করা কিছু গান করবেন ‘পুড়ে যাচ্ছে’ অ্যালবামে।

গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আর মনে-প্রাণে দোয়া করেছিলাম, বাবা যেন খুব ভাল করে গানগুলো গায়। একদিন বাবা এবিকে বললেন, ‘আমি আমার মেয়েকে সংগীত শিল্পী বানাবো।’ এবি বললেন, ‘এখন না, আগে ভালোমত পড়াশোনা করে নিক।’

বাবা আমাকে একদিন ডেকে বললেন, ‘জানিস ইন্ডিয়ার লতা মঙ্গেশকর কোনো দিন বিয়ে করেননি, তুইও কোনোদিন বিয়ে করিসনা!’  আমি অবাক হয়েছিলাম। উত্তর দিয়েছিলাম, ‘আমার নারীত্বের সফলতা সুসন্তানে, আমি বিয়ে করবো।’  বিয়েতে বাবা এবিকে বিয়েতে দাওয়াত করেছিলেন; কেন যেন তিনি আসতে পারেননি। হয়তো বা তখন দেশের বাইরে কোনো প্রোগ্রামে ছিলেন।

আমার প্রথম সন্তান মেয়ে হলে নাম রাখলাম ফাইরূজ; এর অর্থ সমৃদ্ধশালী। কয়েক বছর পর জানলাম এবিও তার প্রথম মেয়ের নাম রেখেছে ফাইরূজ; যিনি এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। আরো অবাক হয়েছি, তার ছেলের নাম রেখেছেন আহনাফ। আমার চাচাতো বোনের ছেলের নামও আহনাফ। নিশ্চয়ই আপু ছেলের নাম রাখার সময় এবির ছেলের নাম জানতেন না।

আইয়ুব বাচ্চুর মধ্যে ছিল মডার্ন সোভার লুক আর মানানসই গ্রহণযোগ্য স্টাইল। তিনি একজন সুদর্শন শক্তিশালী যুবক; যার গানের সুরে আছে মানব দরদ আর মানবিক অনুভুতি। তিনি বুদ্ধি করে চলা এক চির তরুণ শিল্পী; যিনি লিড গিটারের মাস্টার আইকন। গিটার কেনার ভীষণ শখ ছিল তার। সংগ্রহেও ছিল প্রচুর গিটার। রাগ করে নাকি অনেক গিটার ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিলেন।

তিনি ছিলেন সিংহ রাশির জাতক। যার জন্ম ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট। আমি তাকে আইয়ুব বাচ্চু আংকেল ডাকতাম। কিন্তু তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে আইয়ুব বাচ্চু আংকেল বলার দরকার নেই। এবি বলবি।’

আমি যখন ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তখন বাবার উডেন গিটারের তালে নিজের মনেই গাইছিলাম এবির সেই গান ‘এমনি চলে যাব বহু দূরে..।’

ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাই আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, যেন ভার্সিটির প্রোগ্রোমে গানটি গাই। তার অনুরোধে আমি জীবনের প্রথম স্টেজ পারফর্মেন্স করি ইউডা ইউনিভার্সিটির কালচারাল শো’তে। অনুষ্ঠানে সবাই সমস্বরে বলে উঠেছিল ‘ওয়ান মোর, ওয়ান মোর..’। তখন আমার মনে হয়েছিল গানটা শুধু আমারই ভাল লাগেনি; ভাল লেগেছে দর্শকদেরও।

তিনি ভাল চিন্তাধারার একজন আদর্শ গায়ক। তার অনেক বিখ্যাত গান আছে; যার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গান ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ..।’

বাবা যখন ক্যন্সারে অক্রান্ত তখন তিনি সব শুনে বাবার সাথে দেখা করতে যান আর আমার কান্নাকাটি শুনে আশ্বস্ত করে বলেন ‘চিন্তা করিস না আমরা তো আছি, আজম ভাইয়ের ভাল চিকিৎসা করাবো।’ তিনি আর টিংকু আংকেল মিলে সকল শিল্পীকে একত্র করে বামবার সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, চ্যানেলের মালিকপক্ষকে নিয়ে টাকা জোগাড় করে বাবাকে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলেন।

বাবা মারা গেলেও এবি আমাদের পাশে যথাসাধ্য ছিলেন। বাবার নামে ‘শিল্পী আজম খান ফাউন্ডেশন’ করার জন্য আমি স্ট্রাকচার রেডি করে নিয়ে যাই তার কাছে। তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন যেন গরীব বাচ্চাদের গান শেখার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান করি-যেখানে উন্নতমানের যন্ত্রপাতিসহ সংগীতের চর্চা করা হবে।

ক’দিন আগে গ্রামীণ ফোনের ওয়েবসাইটে বাবার কিছু গান প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবি আমাকে ফোন দিয়ে বুঝিয়ে বললেন, ‘গানগুলো দিয়ে দিতে, উনারও নতুন অ্যালবামের গান যাবে।’ আমি বাবার সব গান গ্রামীণ ফোনের ওয়েবসাইটে সংরক্ষণ রাখতে বলেছিলাম।

হোটেল ওয়েস্টিনে একটা অনুষ্ঠানে এবির সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এবি যখন হার্টের অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তখন আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি।

আমার আর কখনো তার সঙ্গে দেখা হবে না। বাবার মতো তিনিও স্মৃতির পাতায় রয়ে গেলেন। ২০১৮ সালের ১৭ই অক্টোবর আমি যখন খবর পেলাম, তিনি মারা গেছেন তখন স্তব্ধ হয়ে গেলাম। অনেক কষ্ট পেতে পেতে আজ আমাদের মন সয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করি তিনি ও আমার বাবাসহ সকল আত্মীয়-স্বজন ওপারে ভালো থাকুক, শান্তিতে থাকুক।