‘শিল্পীরা একসময় দুস্থ শিল্পী হয় কেন?’

জন্মদিনে গ্লিটজের মুখোমুখি হলেন তারকা সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। সাক্ষাৎকারে জানালেন, জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অভিমান, গান-ভাবনা ও অডিও ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা।  

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2018, 04:12 PM
Updated : 16 August 2018, 04:28 PM

গ্লিটজ: জন্মদিন কেমন কাটল?

আইয়ুব বাচ্চু: ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনসহ অনেক ভক্ত বাসায় এসে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, কেক কেটেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে আমার ফ্যান ক্লাবগুলোও দিনটি উদযাপন করছে।

গ্লিটজ: জীবন নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?

আইয়ুব বাচ্চু: বহুদূর যেতে হবে। এখনো পথের অনেকটা বাকি রয়েছে।

গ্লিটজ: গানের জগতে প্রায় ৪০ বছর কাটিয়ে দিলেন। গান থেকে আপনার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী?

আইয়ুব বাচ্চু: আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে-শ্রোতা। শ্রোতাদের যে উচ্ছ্বাস সেটিই আমার বড় প্রাপ্তি। যারা আমাকে ভালোবাসে, আমার গান শোনে; আবার যারা গান শোনেও না কিন্তু আদর করে-সবকিছুই আমার প্রাপ্তি।

গ্লিটজ: শিল্পী হিসেবে আপনাকে যথার্থভাবে মূল্যায়ণ করা হয়েছে?

আইয়ুব বাচ্চু: আমি খুবই আনন্দিত। ভালোবাসার উর্ধ্বে আর কিছু নাই। যেভাবে ভালোবাসা দিয়ে আমাকে মূল্যায়ণ করা হয়েছে-এটা আমার জন্য যথেষ্ট।

গ্লিটজ: ইদানীং গান একটু কমিয়ে দিয়েছেন?

আইয়ুব বাচ্চু: গান তো নিয়মিত গাইছি। আজ  সকালেও একটা নতুন গান প্রকাশ করলাম। ঈদের দিন আরেকটা গান প্রকাশ করব। এখন আমার গান টেলিভিশনে প্রকাশ করছি। আমরা আর ক্যাসেট করি না।

গ্লিটজ: ক্যাসেট রেখে এখন বেশিরভাগ শিল্পীই টেলিভিশন ও ইউটিউবমুখী হচ্ছে। কারণ কী?

আইয়ুব বাচ্চু: ক্যাসেট কে চালাবে? ক্যাসেট কারা করবে? তবে একসময় আবার আগের মতো (ক্যাসেট) হয়ে যাবে; সময় লাগবে। একটা নিয়মের মধ্যে আসতে হবে সবাইকে।

গ্লিটজ: পাইরেসি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পাইরেসি ইস্যুতে দেশে সচেতনতা কেমন দেখছেন?

আইয়ুব বাচ্চু: আমি ক্লান্ত। পাইরেসি হল একটা ক্যান্সার; ক্যান্সারের কোনো অ্যান্সার নেই।

গ্লিটজ: তাহলে আপনাদের প্রতিবাদের ফলপ্রস্যু কোনো উত্তরণই দেখছেন না?

আইয়ুব বাচ্চু: এটা আসলে কিছুই হয়নি। কোথাও সচ্ছতা নাই। কোথাও জিনিসটার সলিড কোনো উত্তর পাইনি। এটা কাকে দোষ দেব? নিজের কপালকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। পার্শ্ববর্তী দেশে কিভাবে পাইরেসি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে? আমাদের দেশেও এভাবে কাজটা করা যায়।

জ্ঞানী-গুণী লোকজন আশাকরি বিষয়টি ভেবে দেখবেন। সংস্কৃতি বাঁচলে এটা আনন্দের ব্যাপার। না হলে শিল্পীরা আস্তে আস্তে সব হারিয়ে যাবে।

গ্লিটজ: ইতোমধ্যে অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেও...

আইয়ুব বাচ্চু: একদম। 

গ্লিটজ: গানে এখন পেশাদারিত্ব কেমন দেখছেন?

আইয়ুব বাচ্চু: এটা ব্যক্তিবিশেষে যার যার মতামতের ব্যাপার; পছন্দের ব্যাপার। আমরা যেমন পেশাদার মিউজিক করি, আমাদের কাছে ব্যাপারটা আমাদের মতো। আমরা কারো মতো করি না। কারো মতো করার চেষ্টাও করি না। যেভাবে যা কিছু করছি আমরা তাতেই আনন্দিত। কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু অভিমান আছে।

গ্লিটজ: কী ধরনের অভিমান?

আইয়ুব বাচ্চু: শিল্পীদের দেখার কে আছে? আমরা ভালো আছি কি না আমাদের কে দেখবে?...বাংলাদেশের শিল্পীরা একসময় দুস্থ শিল্পী হয়ে যায়, কেন? আবার কেউ কেউ বাড়িও বানায়।

গ্লিটজ: শ্রেণী বৈষম্য দেখছেন?

আইয়ুব বাচ্চু: একদম।

গ্লিটজ: এক্ষেত্রে নীতি-নির্ধারকদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করছেন?

আইয়ুব বাচ্চু: নিশ্চয়ই উপরের মহল ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন। কারণ একটা দেশের শিল্প-সংস্কৃতি বাঁচলেই দেশটা সুন্দর থাকে। আমার বিশ্বাস, উনারা একটা সুন্দর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাবেন ও বিষয়টার একটা সুরাহা করবেন।

গ্লিটজ: অভিমানে গতবছর পাঁচটি গিটার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিলেন…

আইয়ুব বাচ্চু: হা হা। না, ওটা আর বিক্রি করছি না। কারণ ওটা নিয়ে তোলপাড় হয়ে গেছে। আমি বরং আরো ছয়টা গিটার কিনেছি।

গ্লিটজ: গিটার বিক্রির ঘোষণায় চারপাশের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

আইয়ুব বাচ্চু: সবাই অভিমান করেছিল। বলছিল, ‘কেন এটা বেচবেন?’ এমনও হয়েছিল, একজন এসে বলল, ‘সব গিটার কিনে ফেলব।’ আমি গিটার আসলে বেচতে চাইনি। চাইছিলাম, তরুণদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা করাতে, যারা ভালো গিটার বাজায় তারা কাজ করবে। কিন্তু তখন পৃষ্ঠপোষকতা পাইনি। পরে আমি আর কাজটাও করতে পারিনি।

গ্লিটজ: নানা কারণে ব্যান্ডের সেই সোনালী দিনগুলি হারিয়ে গেছে। আগামীতে আবারো ব্যান্ডগুলোর স্বরূপে ফেরার সম্ভাবনা দেখেন?

আইয়ুব বাচ্চু: অবশ্যই ফিরবে। সেক্ষেত্রে ব্যান্ডগুলোকে একাত্ম থাকতে হবে। মানুষে মানুষে ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু কর্মক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে যেন মিল থাকে। এটা এলেই সবকিছু চলে আসবে।

গ্লিটজ: কিন্তু সম্প্রতি ব্যান্ডগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একে অপরের সঙ্গে কাদা ছোড়াছুড়িও করেছে।

আইয়ুব বাচ্চু:..এটা বেশ ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। আশা করছি, সময়ে ঠিক হয়ে যাবে। 

গ্লিটজ: এই প্রজন্মের শিল্পীদের গান শোনেন নিশ্চয়ই। তাদের গান নিয়ে আপনার মূল্যায়ণ কী?

আইয়ুব বাচ্চু: খুবই চমৎকার। উদার মানসিকতা দিয়ে ওদের গান শুনতে হবে। ওরা ওদের মতো করে গাইছে; ওদের মতো করে ভাবছে। আমাদেরও ওদের মতো করেই গান শুনতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।

গ্লিটজ: তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

আইয়ুব বাচ্চু: চালিয়ে যাও; আগামী তোমাদের।

গ্লিটজ: এই প্রজন্মের শিল্পীরা আপনারসহ অনেকের পুরনো গানের ফিউশন করছেন। এটা নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

আইয়ুব বাচ্চু: অন্যদের ব্যাপারে জানি না। আমার দৃষ্টিতে বলতে পারি, ওরা এই সময়টাকে মূল্যায়ণ করে গানগুলোকে আগামীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ওদেরকে বাহবা দিই।

গ্লিটজ: তরুণদের হাত ধরে অটো টিউনের যুগে প্রবেশ করেছে আমাদের সংগীত। বিষয়টি কিভাবে দেখেন?

আইয়ুব বাচ্চু: অটো টিউনকে আমি ব্লেইম করব না। ব্যবহারকারীদের বলব, কোথায় ব্যবহার করলে কী হবে-সেটা জানা উচিত। এর সঠিক ব্যবহার শিখতে হবে। অটো টিউনকে অপবাদ দিয়ে লাভ নেই। এটা বানানো হয়েছে ব্যবহারের জন্য। যিনি অটো টিউন ব্যবহার করেন তিনি শিল্পী না-এটা বলা যাবে না।

গ্লিটজ: গত জন্মদিনে আপনি একটা আত্মজীবনী লেখার কথা বলেছিলেন।

আইয়ুব বাচ্চু: সাজ্জাদ হোসেন কাজটা শুরু করবে। ঈদের পরে কাজটা শুরু করব। ঢাকা ছেড়ে কোথাও চলে যাব যেখানে কোনো ফোন থাকবে না, ইন্টারনেট থাকবে না। নদীর মাছ খাব, ভাত খাব, পানি খাব-এমন জায়গায় চলে যাবো। লেখার কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরব।