‘নবনাট্যের কাণ্ডারি’ আবদুল্লাহ আল মামুনকে স্মরণ

নাট্যকার-নির্মাতা-অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রকে কেমন করে নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সে কথা তার জন্মদিনে স্মরণ করলেন সহকর্মীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2018, 03:57 PM
Updated : 13 July 2018, 03:58 PM

শুক্রবার শিল্পকলা একাডেমিতে তার ৭৬তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আসা শিল্পী-কুশলীরা কেউ বললেন আবদুল্লাহ আল মামুনের হাত ধরে তারকা হয়ে ওঠার গল্প; কেউ আবার মনে করিয়ে দিলেন টেলিভিশন নাটকের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে তার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 

নাটকের দল ‘থিয়েটার’ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুনের দীর্ঘ দিনের নাট্য সহচর রামেন্দু মজুমদার, যিনি বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউটের (আইটিআই) সম্মানিক সভাপতি।

রামেন্দু মজুমদার বলেন, “বাংলাদেশে নবনাট্য আন্দোলনের কাণ্ডারি ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। টেলিভিশন নাটক যে পর্যায়ে এসেছে তার অন্যতম অবদান তার। তিনি এমন সব চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যা মাইলফলক হয়ে রয়েছে।”

তেমনই দুটি চলচ্চিত্র ‘সারেং বৌ’ ও ‘দুই জীবনে’ আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরীর। সারেং বৌ চলচ্চিত্রের জন্য কবরী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন।

জন্মদিনের স্মরণ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কাজ করা আমার জীবনের অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তার পরিচালনা ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। সারা জীবনের কাজ দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, সৃষ্টিশীল মানুষের কোনো মাধ্যম লাগে না “

ছাত্রজীবন থেকে নাট্য রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ে যুক্ত হওয়া আবদুল্লাহ আল মামুনের হাত দিয়ে সুবচন নির্বাসনে,

আয়নায় বন্ধুর মুখ, শাহজাদীর কালো নেকাব, এখনও ক্রীতদাস, কোকিলারা, দ্যাশের মানুষ, মাইক মাস্টার, মেরাজ ফকিরের মা’র মত নাটক পেয়েছে মঞ্চনাটকের দর্শকরা।

সংশপ্তক, আমি তুমি সে, পাথর সময়, জোয়ার ভাটা, শীর্ষবিন্দু, উত্তরাধিকারের মত ধারাবাহিকের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটককে তিনি নিয়ে যান জনপ্রিয়তার অন্য মাত্রায়। 

সেই আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনাতেই দর্শক পেয়েছে সারেং বউ, সখী তুমি কার, এখনই সময়, দুই জীবন, জনমদুখী, বিহঙ্গের মত চলচ্চিত্র।

প্রয়াত নাট্যকার,নির্মাতা ও অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের ৭৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে স্মরণসভায় অতিথিরা। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আবদুল্লাহ আল মামুন পরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন।

এ দেশের মঞ্চ, টেলিভিশন আর চলচ্চিত্রে ‘সৃষ্টিশীল’ আবদুল্লাহ আল মামুনের অবদানের পাশাপাশি ব্যক্তি আবদুল্লাহ আল মামুনকেও অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তি নায়িকা কবরী।

তার ভাষায়, আবদুল্লাহ আল মামুন ছিলেন, “অত্যন্ত অমায়িক মানুষ, ভালোবাসার মানুষ। একটা মানুষ, যার সাথে প্রেম করা যায়, ভালোবাসা যায়।”

আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার হাত ধরে টেলিভিশন নাটকে হাতেখড়ি হওয়ার কথা স্মরণ করেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা।

তিনি বলেন, “টেলিভিশনে ভালো নাটক ও আবদুল্লাহ আল মামুন সমার্থক। ভালো নির্মাণের পেছনে আনন্দ লাগে। তিনি সেই আনন্দ নিয়ে কাজ করতেন, সবাইকে করাতেন। আমি যে আজকে সুবর্ণা মুস্তফা হয়েছি, এর পুরো কৃতিত্ব তার। তিনিই আমার মাকে বলে প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করান।”

আশি ও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর ভাষায়, ‘মামুন ভাই’ ছিলেন তার বাবা-মায়ের পরে ‘একমাত্র শিক্ষক’।

প্রয়াত নাট্যকার,নির্মাতা ও অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের ৭৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে স্মরণসভায় কথা বলেন তার ছোট মেয়ে দিবা নার্গিস। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

“এখন আমি অভিনয় যতটা করতে পারি, তা মামুন ভাই শিখিয়ে গেছেন। সে সময়ে তিনি যেসব নাটক নির্মাণ করতেন সেগুলো তখনকার সিনেমার চেয়ে অনেক বেশি সিনেম্যাটিক ছিল।”

জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটকের ওপর আলোচনা করেন অভিনেতা, নির্দেশক ও লেখক আতাউর রহমান।

তিনি বলেন নাটক লেখার সঙ্গে নির্দেশনাকে মিশিয়ে মঞ্চনাটকের চরিত্রকে ‘নিজস্বতা দেওয়ার যোগ্যতা’ তিনি আব্দুল্লাহ আল মামুনের মধ্যে দেখেছেন।

“তিনি চরিত্রের অন্তর্গত সত্যকে প্রকাশের জন্য শিল্পীকে তৈরি করতেন। চিত্রনাট্য অনুসরণ করার বিষয়ে তিনি ছিলেন কঠিন ও কঠোর। মঞ্চের প্রতি তার অমোঘ টান ছিল, নিবিড় ভালোবাসা ছিল।”

সে কারণে উইলিয়াম শেক্সপিয়র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকে ‘বাঁধ ভাঙ্গার’ সুযোগ থাকলেও আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটকে তা ছিল না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“এ পৃথিবীকে সুন্দর করে যেতে যারা অবদান রেখেছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আবদুল্লাহ আল মামুন তাদের মধ্যে অন্যতম। মৃত্তিকালগ্ন ও সমাজলগ্ন নাটক করতেন তিনি।”

প্রয়াত নাট্যকার,নির্মাতা ও অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের ৭৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে স্মরণসভায় ফেরদৌসী মজুমদার।ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে নাট্যদল থিয়েটারের বর্তমান সভাপতি ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, “আমার নাট্যজীবনটা আবদুল্লাহ আল মামুনের হাতে গড়া। আমার শুরুটাই হয়েছে তার হাতে। ভাগ্য ভালো, তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। না হলে আমার জন্মটা সার্থক হতো না।

“আজকে মঞ্চ, টেলিভিশন নাটকে আমি যে অবস্থানে এসেছি, তার নিরানব্বই ভাগই আবদুল্লাহ আল মামুনের অবদান।”

নাট্যকার ও অভিনেতা ড. ইনামুল হক বলেন, “তার আগ্রহেই আমি নাট্যকার হতে পেরেছি। পাকিস্তান আমলে টেলিভিশনের শেষ নাটক ‘আবার আসিব ফিরে’ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নাটক ‘বাংলা আমার বাংলা’ নাটকটি প্রচার করেছিলেন তিনি। তিনি নীরবেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করে গেছেন।”

অভিনেতা কেরামত মাওলা বলেন, “আবদুল্লাহ আল মামুনের জীবনে কোনো লোভ ছিল না। একমাত্র নাটকের প্রতি তার ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুর প্রতি টান ছিল না।”

আব্দুল্লাহ আল মামুনের মেয়ে দীবা নার্গিসও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। 

তিনি বলেন, “বাবা যে এত কাজ করেছেন, তার কতটুকু জানি? বাবা নেই এটা আমাদের জন্য কষ্টের, কিন্তু তিনি যে এত মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন, সেটা আমাদের জন্য গর্বের।”

প্রয়াত নাট্যকার,নির্মাতা ও অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের ৭৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে স্মরণসভায় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

অন্যদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফি আহমেদ, নাট্যকার-অনুবাদক আবদুস সেলিম, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লাকী ইনাম ও সেক্রেটারি জেনারেল কামাল বায়েজীদ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান শেষে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয় আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত ও নির্দেশিত থিয়েটারের নাটক ‘মেরাজ ফকিরের মা’।

নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, ত্রপা মজুমদার, মজিবর রহমান জুয়েল, তানজুম আরা পল্লী, মারুফ কবির, সাইফ জোয়ারদার, আব্দুল কাদের ও তোফা হোসেন।

মঞ্চ পরিকল্পনায় ছিলেন হাসান আহমেদ, আলোক পরিকল্পনায় ঠাণ্ডু রায়হান এবং আবহসঙ্গীতে প্রদীপ কুমার নাগ।

১৯৮০ সালে ‘এখনই সময়’ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান আব্দুল্লাহ আল মামুন। ২০০০ সালে পান একুশে পদক।

১৯৪২ সালের ১৩ জুলাই জন্ম নেওয়া আবদুল্লাহ আল মামুন ২০০৮ সালের ২১ অগাস্ট মারা যান।