কিছু পেতে কখনও তৈল মর্দন করিনি: সোহেল রানা

অভিনেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সোহেল রানা গ্লিটজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানালেন নিজের বর্তমান ব্যস্ততা, রাজনৈতিক ভাবনা ও সামনের পরিকল্পনার কথা।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2018, 12:23 PM
Updated : 7 June 2018, 01:28 PM

গ্লিটজ: কেমন আছেন?

সোহেল রানা: খুব ভালো না। মোটামুটি।

গ্লিটজ: এফডিসি কেন্দ্রিক বিভিন্ন আয়োজনে আপনাকে ইদানীং দেখা যায় না। নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন কিনা?

সোহেল রানা: প্রয়োজন হলে মাঝে মাঝে যাই। অপ্রয়োজনে শুধু শুধু গিয়ে তো লাভ নাই। তাই না?

গ্লিটজ: এখন তাহলে আপনার সময় কাটছে কিভাবে?

সোহেল রানা: পড়াশোনা করে। রাজনৈতিক কিংবা সাধারণ পড়াশোনা না, ধর্মীয় পড়াশোনা।

গ্লিটজ: কবে থেকে ধর্মীয় পড়াশোনা শুরু করেছেন?

সোহেল রানা:
প্রায় ষোল বছর আগে হজ করে আসার পর থেকে। সেটা এখন একটু বেড়েছে আরকি। কারণ এফডিসি তো মৃত। এখন অটোপসি করা ছাড়া আর করার কিছু নাই। সরকার ভালো মায়ের মতো আচরণ না করে সৎ মায়ের মতো আচরণ করলে তো আর করার কিছু নাই। শুধু চিৎকার, লাফালাফি করা যায়।

যেহেতু কোনো কাজ নেই সেহেতু নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করা যায়। মানুষের করণীয় কিছু না থাকলে তো কিছু করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় কারণে গায়ে পড়ে ঝগড়া করছে। সেখানে তো অযথা গিয়ে লাভ নেই। ডাকলে শরীর ভালো থাকলেও যাই। শরীরর এমন অবস্থায় আছে বলাও যায় না যে, কাল অনুষ্ঠান হলে কালই যাব।

গ্লিটজ: এফডিসি তো আপনার কাছে অনেকটা দ্বিতীয় বাড়ির মতো। এফডিসিতে তুমুল ব্যস্ততার দিনগুলি মিস করেন কখনও?

সোহেল রানা: এটা দ্বিতীয় বাড়ি না, আমার প্রথম বাড়ি। কারণ ওখানে ঢুকেছি সকাল আটটায়, বেরিয়েছি রাত দশটায়। দিনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় কাটিয়েছি এফডিসিতে। হিসেবে হিসেবে নিজের বাসাকেই বলা যায়, ‘দ্বিতীয় বাড়ি।’

আর যদি সেই দিনগুলির কথা বলো তাহলে বলব, না মনে হয় না। কিছুক্ষণ আগে ফেইসবুকে একজন আমার পুরানো একটি ছবি পাঠিয়েছে একজন। ছবিটি দেখে চোখে পানি চলে এলো কারণ আল্লাহ তায়ালা মানুষের জীবন এতো ছোট দিল কেন? ছবিটা দেখে বোকার মতো তাকিয়ে ছিলাম।

মনে হলো, আমিই এই ছিলাম! আমি পঁয়ত্রিশ বছরে পরিবর্তন হয়ে গেলাম। ছবির সঙ্গে আজকের মাসুদ পারভেজকে মেলাতে গেলে চোখে পানি আসা ছাড়া তো আর কিছু আসে না।

যে আমাকে ছবিটা দিল তাকে লিখে দিলাম, ‘ছবিটা পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু কখনও আমাকে পুরানো ছবি সুন্দর লাগলে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিও। আমার কাছে পাঠিয়ো না।’

গ্লিটজ: ষাট পেরিয়ে এই মুহূর্তে জীবন নিয়ে কী ভাবছেন?

সোহেল রানা: কাজী নজরুল ইসলামের গানের কথাটা মনে পড়ল। সেই গানটাকে যদি গভীরভাবে দেখা হয় তাহলে এক রকম মনে হয় আর সহজভাবে দেখলে আরেক রকম মনে হয়। গানে লেখা আছে, ‘খেলিছ এ বিশ্বলয়ে বিরাট শিশুর আনমনে।’

এটার পেছনে কিন্তু লুকানো বেদনা আছে। এটা দেখা যায় না। ‘খেলিছ এ বিশ্বলয়ে’ মানে তুমি মনোযোগ দিয়ে খেলছ না। অনেক বাবারা সন্তানকে হারিয়েছেন। সুস্থ হয়ে মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়ে জীবন নিয়ে আর ফিরতে পারছে না। এটা সৃষ্টিকর্তার খেলা। তুমি যে কপাল নিয়ে এসো সেটা নিয়েই ফিরে যাবে। এটা খণ্ডানোর কোনো উপায় নেই।

যার জীবন আছে তার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। জীবদ্দশায় মানুষের মঙ্গল করে যেতে হবে। মারা গেলে যেন মানুষ বলে, ‘লোকটা ভালো ছিল।’

পৃথিবী তো পূণ্যের জায়গা না, পাপের জায়গা। প্রত্যেকটা জায়গায় শয়তান আছে। শয়তানকে তোমার রক্তের মধ্যে ঢোকার শক্তি দেওয়া হয়েছে। আমি যতই চেষ্টা করি আমাকে পাপই করতে হবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে মাফ চাইলে উনি মাফ করবেন। তুমি যতই পাপ করো, আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে মাফ পাবে।

এখন সেটাই করছি, আল্লাহর কাছে মাফ চাইছি। যে অপরাধ করেছি সেগুলোর জন্য মাফ চাইছি।

গ্লিটজ: অভিনয় শুরুর সময় তো নিশ্চয়ই আপনার নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেয়েছেন বলে মনে করেন?

সোহেল রানা: যারা বড় বড় কথা বলে আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। আমার ওই ধরনের কোনো ইচ্ছাই ছিল না। আমার সারাজীবন ইচ্ছা ছিল, আমি একজন ভালো মানুষ হব। আমার দ্বারা মানুষের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। সাধারণত মিথ্যা কথা বলি না। যতটুকু সামর্থ্য ততটুকুর মধ্যেই মানুষকে সহায়তা করি। এটাই আমি চেয়েছিলাম। সেটুকুই করে যাচ্ছি। কোনো পরিবর্তন নেই।

গ্লিটজ: তাহলে প্রাপ্তি নিয়ে আপনার মধ্যে এক ধরনের সন্তুষ্টি আছে..

সোহেল রানা: হ্যাঁ। আমার মধ্যে এই সন্তুষ্টিটা আছে। তবে আমার যদি আরও অনেক ক্ষমতা, টাকা-পয়সা থাকত তাহলে মানুষের জন্য আরও কিছু করতাম। তবে আল্লাহ তায়ালা আমাকে যতকিছু দিয়েছেন তাতেই আমি খুব খুশি।

আমি জ্ঞানত মানুষের কোনো ক্ষতি করিনি। আমি সত্যবাদি। সৃষ্টিকর্তাকে ছাড়া কাউকে পরোয়া করিনি। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কখনও তৈলমর্দন করিনি। করিনি বলেই আজকে এই জায়গায় আছি। করলে হয়তো সামাজিকভাবে আরও উপরে থাকতে পারতাম।

গ্লিটজ: আশির দশক জুড়ে আপনার তুমুল জনপ্রিয় ছিল চলচ্চিত্রাঙ্গনে। আপনাকে ঘিরে লেখা হয়েছে সিনেমার গল্প। চারপাশটাকে আপনাকে নিয়েই মেতেছিল হুল্লোড়ে। জীবনের পরিবর্তনটাকে কীভাবে দেখেন? 

সোহেল রানা: সেই সময়ে এক ধরনের হুল্লোড় হত। এখন যেহেতু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সেকারণে হুল্লোড়ের উপায়ে পরিবর্তন এসেছে। আগে যেকোনো দলেরই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আমাকে নিয়ে ভালো লাগা কাজ করত।

এখন বিশেষ দলের সমর্থক হুল্লোড় করে। রাজনীতিতে এলে তাকে নিয়ে অন্য দলের লোকজন হুল্লোড় করে না। প্রত্যেকেই চেয়ার নিয়ে, পাওয়ার নিয়ে টানাটানি করছে।

গ্লিটজ: বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একজন  তারকার কি রাজনীতিতে জড়ানোর মতো পরিবেশ আছে?

সোহেল রানা: একটু কঠিন। পাঁচচল্লিশ বছর ধরে একটা পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেখান থেকে সরে আসছি। পার্টির সকলেই জানে, ইচ্ছাকৃতভাবে সরে যাইনি। সেকারণে এখনও তারা আমাকে আপন ভাবে। কিন্তু আমি ছাড়া অন্য যারা স্টার আছেন তাদের ব্যাপারে বলব, স্টারের রাজনীতিতে আসার পরিবেশ নেই, জনপ্রিয়তা হারাবে। একটা গ্রুপের কাছে প্রিয় হবে।

ইন্ডিয়াতেও অনেক ফিল্মের লোকজনকে গালাগালি করে। আমেরিকা কিংবা বৃটেনে হতে পারে। ভিয়েতনামে হয়েছে, কম্বোডিয়ায় হয়েছে। তামিল-তেলেগু সাইডটা বাদ দিয়ে সাধারণ নেতার চেয়ে বেশি সম্মান পায় তারকারা।

গ্লিটজ: বর্তমানে আপনার রাজনৈতিক কার্যক্রম সমন্ধে জানতে চাই?

সোহেল রানা: বর্তমানে আমি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার। পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান এখন ঘোলাটে অবস্থায় আছে। আমরা আ.লীগের সঙ্গে মহাজোটের থাকব নাকি স্বাধীনভাবে নির্বাচন করব-এটা বলার সময় এখনও হয়নি। এব্যাপারে আমাদের প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নেবেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলবেন সেটাই ফাইনাল।..

গ্লিটজ: মাঝখানে একবার জাতীয় পার্টি ছাড়ার খবর বেরিয়েছিল..

সোহেল রানা: বের হয়ে যাচ্ছি না। ব্যাপারটা হলো, যদি কোনো অবস্থান না নাও তাহলে তো ঘরে বসে থাকতেই হবে। জাতীয় পার্টি কোনো অবস্থান না নেয় তাহলে তুমি কী করবে?

আমি সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করে এসেছি। এখন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি থেকে তো সরে যাব না। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যদি কেউ কিছু বলে সেখানে আমি নাই। হাসিনাকে নিয়ে যা বলার বলো কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নয়।

এখন যারা বলে, জায়গা থেকে সরে যাচ্ছি তাদের বলি, এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। প্রেসিডেন্ট যতদিন পর্যন্ত আছেন এবং আমাকে যা বলবেন সেটা করার চেষ্টা করব।

গ্লিটজ:অভিনেতা নাকি নেতা-কোন পথে সামনে নিজেকে এগিয়ে নিতে চান?

সোহেল রানা: আমার মতে, সিনেমা ইজ ডেড। সিনেমা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। সম্মান নিয়েই থাকি। বিশ বছরের ইমেজই থাকুক। কারণ সময় আমাকে সমর্থন করবে না।