বাংলাদেশে রবীন্দ্র নাট্যচর্চা

[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশকিছু নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন মঞ্চসারথী আতাউর রহমান। একুশে পদকপ্রাপ্ত এ অভিনেতা- নির্দেশক কবিগুরুর জন্ময়ন্তী উপলক্ষে গ্লিটজ পাঠকের জন্য উপস্থাপন করলেন বাংলাদেশের মঞ্চে রবীন্দ্রনাট্যের নানা দিক]

>>আতাউর রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2018, 12:46 PM
Updated : 9 May 2018, 12:46 PM

বিশ্ব-মানব, বিশ্ব-পথিক এবং সর্বোপরি সমগ্র বিশ্বের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমত এবং প্রধানত একজন বাঙালি কবি, এই সত্যবোধ প্রতিটি বাঙালীকে নিশ্চিত ভাবে গৌরাবাহ্নিত করে। তিনি আমাদেরই মানুষ, শ্লাঘাময় এই অনুভব বাঙালির জীবনকে উজ্জীবিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনকে শিল্পবোধ থেকে কখনই বিযুক্ত করে দেখেননি; আর সেজন্যে তার শিল্প-সৃষ্টি প্রায়শই জীবনলগ্ন।

তিনি কাব্য, গল্প, উপন্যাস, সঙ্গীত, নাটককে জীবনের প্রতিভাষে সিঞ্চিত করেছেন; যা সবসময় প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ দ্যোতনায় হয়েছে উজ্জ্বল; এসেছে নানা বেশে; রূপালঙ্কার, প্রতীক ও বিমূর্ততার মোড়কে আবৃত হয়ে। তার অঙ্কনশিল্প বিমূর্ত হলেও তাতে খুঁজে পাওয়া যায় জীবনের গূঢ় সঙ্কেত। রবীন্দ্রনাথের লেখা অসংখ্য পত্রে ও তার রচিত সোনার খনি-সম প্রবন্ধাবলীতে জীবন দর্শনের বিচিত্র ও বর্ণীল রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। তার শিক্ষা ও কৃষি সম্পর্কিত ভাবনায় প্রতিনিয়ত দেশ, কাল ও সমাজ ঘনিষ্ঠতার স্পষ্ট উম্মীলকে আমরা প্রত্যক্ষ করি। রবীন্দ্রনাথ  নিরন্তর বিশ্বচরাচরের সকল ক্রিয়াকে উৎসুক শিশুর মত জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে দেখেছেন, প্রশ্ন করেছেন এবং নিজের ভাবনার স্তরকে বিন্যাস করেছেন, শুদ্ধ করেছেন, পুনর্নিমাণ করেছেন এবং এইভাবে উনি পরিবর্তন ও জঙ্গমতার স্রোতে ভেসেছেন।

তারই গানের কথা ধার করে বলতে হয়, এইভাবে তিনি বিশ্বমাতার যজ্ঞশালায় আকাশের আলোয় আলোয়, মৃত্তিকার ধুলায় ধুলায় ও ঘাসে ঘাসে এবং সর্বজনের মনের মাঝে জীবন স্রোতের মুক্তি খুঁজেছেন। রবীন্দ্রনাথ শিল্প ও সাহিত্যের সকল শাখায় সহজাত প্রতিভায় বিচরণ করেছেন। তার সাহিত্য ও প্রয়োগ শিল্প কাজ প্রায় হাত ধরাধরি করে চলেছে এবং যেমন ব্যপ্ত হয়েছে নিজ মাতৃভূমিতে, তেমনি পরিব্যাপ্ত হয়েছে বিশ্বচরাচরে। এই রবীন্দ্রনাথকে অর্জন করতে, তাঁকে নিজেদের করে পেতে বাংলাদেশের বাঙালীদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে, দুঃখ-কষ্ট ভোগ ও বৈরী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে; তারপরে আমরা আমাদের আপনজন হিসেবে তাঁকে পেয়েছি। এখন আমরা গর্ব করে বলতে পারি তিনি আমাদেরই লোক।

যখন আমাদের আজকের বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল তখন বাঙালীর নিজস্ব শিল্প-সংষ্কৃতি-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এই দেশের বাঙালিদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল পাকিস্তানী সরকার। তখনকার প্রশাসনের একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ ধর্ম বিশ্বাসের মানুষ, সুতরাং রবীন্দ্রচর্চা ইসলাম ধর্মের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। এতদসত্বেও পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শত বর্ষের উৎসব বিরাট ভাবে উদ্যাপিত হয়েছিল। সারা দেশ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাট্যানুষ্ঠান, আবৃত্তির আসর, নৃত্য ও নাট্যানুষ্ঠানে মুখরিত হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ তার নিজের লেখা ‘রক্তকরবী’ নাটক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন যে, তিনি তার ঘরের কোনায় স্তুপকৃত লোহালক্কড়ের জঞ্জাল সরিয়ে দেখতে পেলেন এত বোঝার চাপেও একটি ‘রক্তকরবী’র গাছ বুকে লালফুল নিয়ে বেঁচে আছে এবং রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে যেন বলছে ‘মারতে পারলে কই ভাই’। উৎপীড়নের কষাঘাতে সত্য-সুন্দরকে কখনও ধ্বংস করা যায়না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সত্যও সুন্দরের ফল্গুধারা হয়ে আছেন এবং এই প্রবাহমান জলধারাকে প্রশাসনের রক্তচক্ষু প্রদর্শন ও উৎপীড়ন কখনও বন্ধ করতে পারেনি। আমরা অনেকেই ভাগ্যবান যারা রবীন্দ্রনাথের ১০০-তম জন্মজয়ন্তী এবং ১২৫-তম জন্মজয়ন্তীসহ বর্তমানে তার সার্ধ-শতবর্ষ জন্মজয়ন্তীর সমগ্র আয়োজনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছি।

মনে পড়ে, লন্ডন শহরে রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উৎসবে অংশ গ্রহণ করার জন্যে আমি তাঁর চারটি নাটকের অংশবিশেষের সমন্বয়ে প্রস্তুত করেছিলাম, ‘আগল ভাঙ্গার পালা’। সেই চারটি নাটক ছিল, ‘অচলায়তন’, ‘বিসর্জন’, ‘মুক্তধারা’ ও ‘রক্তকরবী’। এক ঘন্টা স্থায়ী এই নাট্য-মঞ্চায়নে বাঙালী ছাড়াও অনেক বিদেশী দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের গান, নাটক, উপন্যাস ও ছোট গল্পের প্রচার ও প্রসার এই বঙ্গে সবসময় অব্যাহত ছিল। শুধু আজকের স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে নয়, বৃটিশ ও পাকিস্তানী শাষণ কালে বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংষ্কৃতি ও সাহিত্য চর্চা নিয়মিত ভাবে হত। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ন্রোযাখালী জেলায় আমার নানার বাড়ীতে আমার খালারা ও বোনেরা ঘরোয়া ভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘নটীর পূজা’ মঞ্চায়ন করেছিলেন।

আমার নানা অতি প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠে বেসুরে গলায় গাইতেন, ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে’। তখন আমি জানতাম না যে, তাঁর গীত গানের ভগ্নাংশটি রবীন্দ্রসঙ্গীতেরই অংশ। আমি চট্টগ্রামে স্কুলে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটক অভিনীত হতে দেখেছি। এ সবই পঞ্চাশের ও ষাটের দশকের স্মৃতি। উত্তর বঙ্গের রংপুর, ঠাকুরগাঁ, দিনাজপুর, পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অতিচেনা একজন কবি, সঙ্গীত রচয়িতা এবং নাট্যকার। পাকিস্তান আমলে ‘ছায়ানট’  সঙ্গীত বিদ্যালয়ের উদ্ভব আমাদের বঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার ও প্রসার ঘটালো দেশব্যাপী। ষাটের দশের প্রথম দিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে ‘চন্ডলিকা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘মায়ের খেলা’ নৃত্য নাট্য ও গীতি নাট্য দেখে প্রভূত আনন্দ পেয়েছি। তখন রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, ‘নৌকাডুবী’, ‘চোখের বালি’, ‘ঘরের বাইরে’ উপন্যাস ঘরে ঘরে পঠিত এবং আলোচিত হত। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসেবে তাঁর ছোট গল্প পঠিত হত সর্বত্র।

ষাটের দশকের মার্কস আন্দোলনের ঝড়ো হাওয়ায় এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের বীরত্বব্যাঞ্জক প্রকাশ কালেও রবীন্দ্রনাথই ছিলেন বাঙালির জীবনের প্রধান অবলম্বন এবং জীবন চর্যার ধ্রুবতারা।

রবীন্দ্রনাথের নাট্য রচনায় ছিলেন বৈচিত্র সন্ধানী এবং সেই কারণে তার নাটকে পাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মনোলোকের সন্ধান। বাংলাদেশের নাট্যদলগুলো রবীন্দ্র নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত নাটক প্রযোজনা ও নির্দেশনার ক্ষেত্রে আমার নিজের সামান্য কিছু অভিজ্ঞতার বিষয়ে ব্যক্ত করি। আমার নাট্যদল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় আমার নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের এ পর্যন্ত ৯৫ টি প্রদর্শনী করেছে। এই প্রযোজনা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। প্রায় ৮৫ টি প্রদর্শনীতে দর্শক উপচে পড়েছে।

২০০৯ সালে কায়রো আন্তর্জাতিক নিরীক্ষামূলক নাট্যোৎসবে এই প্রযোজনা আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেয়। সেখানে দু’সন্ধ্যা ‘রক্তকরবী’ মঞ্চায়িত হয়। প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য, বাস্তব ও রূপক এমনকি ‘এবসার্ডিটির’ সমন্বয়ে নাটকটিকে আমার কাছে অসামান্য মনে হয়। আমি নির্দেশক হিসেবে নাটকটিকে উচ্চমাপের ধ্রুপদী ধারা থেকে কিছুটা নমিত করে মানুষ যাতে বুঝতে পারে তেমনভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তৈরী করেছি। এতে করে হয়ত দর্শকদের দিক থেকে নাটকটির মঞ্চ সাফল্য এসেছে।

‘রক্তকরবী’ নাটকটি একটি ‘পলিটিক্যাল’ নাটকও বটে, রক্তরবীর সোনার খনির ‘রাজা’ বেশ বুঝতে পারে, শক্তির ভার নিজের অগোচরে কেমন করে নিজেকে পিষে ফেলে। এই সংলাপ বোঝার জন্যে সাধারণ দর্শকদের কোন বিশেষ ধরনের মননের প্রয়োজন হয়না। নাট্য চরিত্র গোঁসাইর জপমালার রশি ও কুকুর পেটাবার চাবুক যে একই বস্তুতে তৈরি সেটাও বুঝতে সাধারণ দর্শকের কষ্ট হয়না। রাজতন্ত্র, পুরোহিত তন্ত্র এবং দুঃশাসনের সত্যিকার স্বরূপ এই সংলাপের মধ্য দিয়ে উদ্ঘাটিত হয়। নাট্য-চরিত্র বিশু যখন বলে- ‘না রাজা, আমি রঞ্জনের ও-পিঠ, যে পিঠে আলো পড়েনা-আমি অমাবস্যা’, তখন দর্শকেরা বুঝেই হেসে উঠেন। বিশু যখন সর্দারকে বলে-খাঁচার পাখি শলাগুলোকে ঠোকরায় সে তো আদর করে নয়। এ কথা কবুল করলেই কি, না করলেই কি’, তখনও দর্শকেরা বুঝেই গেসে উঠেন। আমি শুধু ‘রক্তকরবী’র প্রত্যক্ষ সংলাপগুলোর মধ্যে নিহিত রাজনীতিলগ্ন রসিকতার বিষয়ে সামান্য উল্লেখ করলাম। ‘রক্তকরবী’র রূপলঙ্কার আশ্রিত সংলাপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম না, সেইসব সংলাপ আমাদের চেতন ও অবচেতন মনের মর্মমূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়।

“রাজা ॥ নন্দিনী, একদিন দুরদেশে আমারই মতো একটা ক্লান্ত পাহাড় দেখেছিলুম। বাইরে থেকে বুঝতেই পারিনি তার সমস্ত পাথর ভিতরে ভিতরে ব্যথিয়ে উঠেছে। একদিন গভীর রাতে ভীষণ শব্দ শুনলুম, যেন কোন্ দৈত্যের দুঃস্বপ্ন গুম্রে গুম্রে হঠাৎ ভেঙে গেল। সকালে দেখি পাহাড়টা ভুমিকম্পের টানে মাটির নীচে তলিয়ে গেছে। শক্তির ভার নিজের আগোচরে কেমন করে নিজেকে পিষে ফেলে সেই পাহাড়টাকে দেখে তাই বুঝেছিলুম”।

আমি রবীন্দ্রনাথের তিনটি ‘কাব্য নাট্য’, ভিন্ন অভিধায় ‘নাট্য কাব্য’, একসঙ্গে ‘নাট্যত্রয়ী’ শিরোনামে মঞ্চায়ন করেছি। তিনটি নাট্য কাব্যই ক্ষুদ্রায়তণের, মঞ্চায়ন সময় ১ ঘন্টা ২৫ মিনিটের মত। আমি এই তিনটি নাট্য কাব্যের প্রতি আকৃষ্ট হই; এই তিনটি নাটকের চির প্রাসঙ্গিক সংলাপ পাঠ করে। এই নাটক তিনটি হল, ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’, ‘বিদায়-অভিশাপ’ ও ‘গান্ধারীর আবেদন’। প্রথম নাটক ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’-এ কর্ণের অন্তিম সংলাপ আমার কাছে যথার্থ মনে হয়, বিশেষ করে এই নষ্ট ও ভ্রষ্ট সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। সংলাপের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হল- “যে পক্ষের পরাজয় সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহবান / জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান / আমি রব নিস্ফলের, হতাশের দলে”। নাটকের পরিসমাপ্তিতে শুনি, “শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে / জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি, বীরের সদ্গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই”। ‘বিদায় অভিশাপ-এ কচ দেবযামীর কাহিনী শুধু মনোগ্রাহী নয়, সবার উপরে যে মানুষ সত্য এই বোধটি নতুন ভাবে মনকে নাড়া দিয়ে যায়। যে বিদ্যা অর্জণ, মানুষের কোন কাজে লাগেনা, যে বিদ্যাশিক্ষা কেবলমাত্র পান্ডিত্যপূর্ণ ও স্বার্থপর, সেই কট্টর-নিষ্ঠুর বিদ্যা ধিক্কার যোগ্য শুধূ নয়, সেই কঠোর বিদ্যার্থী বিদ্যার কেবল ভারবাহীই হয়ে থাকে। ‘বিদায় অভিশাপের’র এই চিরায়ত বক্তব্যে আমি বারম্বার আকৃষ্ট হয়েছি। ‘গান্ধারীর আবেদন’ নাট্যের প্রতি আকৃষ্ট হই গান্ধারীর জন্যে, শ্রেয়ঃ বোধের স্বপক্ষে নারীর এমন শক্তিরূপ দর্শণ ইতিহাসে ও সাহিত্যে বিরল। দুটি ছোট সংলাপ উদ্ধৃত হল যেখানে গান্ধারী পুত্র দুর্যোধনকে ত্যাগ করার জন্যে ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিচ্ছেন। “ধৃতরাষ্ট্র ॥ কি রাখিব তারে ত্যাগ করি ? গান্ধারী ॥ ধর্ম তব। ধৃতরাষ্ট্র ॥ কী দেবে তোমারে ধর্ম ? গান্ধারী ॥ দুঃখ নব নব / পুত্রসুখ রাজ্যসুখ অধর্মের পণে / জিনি লয়ে চিরদিন রহিব কেমনে / দুই কাঁটা বক্ষে আলিঙ্গিয়া”। বলা বাহুল্য রাজমহিষী গান্ধারী ধর্ম বলতে এখানে চিরায়ত ধর্মকে বুঝিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ আমার খুব প্রিয় নাটক। আমার নিজের দলের বাইরে গিয়ে আমি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে এবং ‘ঢাকা লিটল থিয়েটার’ নামে তরুণ প্রজন্মের একটি নাটকের দলের হয়ে নাটকটির দু’টো ভিন্ন প্রযোজনার নির্দেশনা দিয়েছি। রূপকথার রূপকের মোড়কে আমি স্বৈরাচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এমন দ্রোহবাদী নাটক আর পড়িনি। শুধু তাই নয়, হরতনী ও রুইতনের যুগ্ম অভিনয়ে নৃত্যের রূপকল্পের মধ্য দিয়ে বিশ্বচরাচরে মানব-স্বভাবের আবহমান কালের পরম্পরাকে অপূর্ব শৈল্পিক দ্যেতনায় মূর্ত করা হয়েছে।

আমার নাট্যদল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ৮ টি নাটক মঞ্চায়িত করেছে। নাগরিক-এর হয়ে রবীন্দ্র নাট্য প্রযোজনায় আমি সম্পৃক্ত হই সবাইর শেষে। ‘রক্তকরবী’ ২০০১ সালে এবং নাট্যত্রয়ী ২০০৫ সালে। আমি সম্প্রতি ‘পালাকার’ নামে নাট্যদলের একটি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ ভিত্তিক এই নাট্যরচনা করেছেন আমাদের দেশের প্রতিভাবান নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অবস্থান করেছেন। নাট্যকাল হল, ১৮৮৯-১৮৯৫ খৃষ্টাব্দ, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসরে পিতার আদেশে জমিদারির দেখাশুনা করতে যে কয় বৎসর অবস্থান করেছিলেন সে সময়-কাল। এই নাট্য প্রযোজনায় কয়েকটি গল্পের ও কাব্যের খন্ড অভিনয় এবং নৃত্যাংশ রয়েছে ! আছে কন্ঠ সঙ্গীত ও আবৃত্তি। নাটকের নাম ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। এই প্রযোজনার মাধ্যমে আমি কবির ১৫০ তম জন্মজয়ন্তীতে নিজেকে নিজে পুরস্কৃত করার চেষ্টা করেছি। আমার মূল লক্ষ ছিল রবীন্দ্রনাথকে এই দেশের জলবায়ু, বিশেষ করে পদ্মা পারের মানুষের সুখ-দুঃখ কি ভাবে একজন সত্যিকার ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল, তার কিছুটা হলেও মূর্ত করা। একজন বিশ্বনন্দিত সৃজনশীল মানুষের গড়ে উঠার ও হয়ে উঠার একটি চিত্র এই নাট্য প্রযোজনায় হয়ত পাওয়া যাবে, এমনটা আমি আশা করি।

রবীন্দ্রনাথের সমগ্র নাট্য-সাহিত্য জুড়ে বিরাজ করছে ধর্মীয় গোঁড়ামি, ভণ্ডামি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ক্ষুদ্রতার স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং পাশাপাশি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সোচ্চার উচ্চারণ। আমার ধারণায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় পলিটিক্যাল নাট্যকার, যে ভাবে’ বের্টল্ট ব্রেশটকে জার্মানির সেরা ‘পলিটিক্যাল’ নাট্যকার বলা হয়। রবীন্দ্রনাটক হয়ত ব্রেশটের নাটকের মত প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি ঘনিষ্ঠ নয় যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রতীকের আবরণে মোড়া ও ইঙ্গিতবহ এবং পাশাপাশি এক অনিন্দ্যসুন্দর নান্দনিক সৃজনও বটে।

নবীন্দ্রনাথের কাব্যনাটক ‘সতী’ তে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার উদ্ভাস দেখতে পাই। ‘সতী’ নাটকের নায়িকা অমাবাই-এর কণ্ঠ-নিঃসৃত সংলাপ নিচে উদ্ধৃত হল।

হৃদয় অর্পণ

করেছিনু বীরপদে। যবন ব্রাম্মন

সে ভেদ কাহার ভেদ ? ধর্মের সে নয়।

অন্তরের অন্তর্যামী যেথা জেগে রয়

সেথায় সমান দোঁহে।

অমাবাই আরো বলেন,

করেছি পতির পূজা; হয়েছি যবনী

পবিত্র অন্তরে; নহি পতিতা রমণী

পরিতাপে অপমানে অবনত শিরে

মোর পতিধর্ম হতে নাহি যাব ফিরে

ধর্মান্তরে অপরাধী সম।

ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’ কাব্য নাট্যের রাজমহিষী উচ্চারণ করেন-“ধর্ম কি খুঁজিতে হয় ? সূর্যের মতন ধর্ম চিরজ্যোতির্ময়, চিরকাল আছে”।

‘রথের রশি’ কাব্য নাটক রবীন্দ্রনাথের একটি শক্তিশালী রচনা। রথের রশির কবি চরিত্রের কন্ঠে আমরা শুনি-

পূজো পড়েছে ধুলোয়, ভক্তি করেছে মাটি।

রথের দড়ি কি পড়ে থাকে বাইরে।

সে থাকে মানুষে মানুষে বাঁধা,

দেহে প্রাণে-প্রাণে।

সেইখানে জমেছে অপরাধ, বাঁধন হয়েছে দুর্বল।

রবীন্দ্রনাথের এই নাটকের মূল ভাব হল, ইতিহাসের রথ একদিন ব্রাম্মনের টানে চলেছে, তারপরে একে একে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের টানে চলেছে, এবার শুদ্রের টানের প্রয়োজন। হলোও তাই, ম্লেচ্ছ শুদ্রের টানে রথ চলল। এই নাটকের অন্যতম চরিত্র কবির কথা শোনা যাক-

ওদের দিকেই ঠাকুর পাশ ফিরলেন-

নইলে ছন্দ মেলে না।

এক দিকটা উঁচু হয়ে ছিল অতিশয় বেশি,

ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে,

সেইখান থেকে মারলেন টান,

বড়োটাকে দিলেন কাত ক’রে।

সমান করে দিলেন তাঁর আসনটা।

রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ নাটকে অর্থহীন ধর্মীয় আচারের বিরুদ্ধে অচলায়তনের বেপরোয়া ছাত্র পঞ্চক এবং উপাধ্যায়ের কিছু উক্তি উদ্ধৃত হল।

সুভদ্র ॥ উপাধ্যায় মশায় !

উপাধ্যায় ॥ কী বলছিলে ?

সুভদ্র ॥ আমি পাপ করেছি।

উপাধ্যায় ॥ পাপ করেছ ? আচ্ছা বেশ। তা হলে বোসো। শোনা যাক।

সুভদ্র ॥ আমি অচলায়তনের উত্তর দিকের-

উপাধ্যায় ॥ বলো, বলো, উত্তর দিকের দেয়ালে আঁক কেটেছ ?

সুভদ্র ॥ না, আমি উত্তর দিকের জানালায়-

উপাধ্যায় ॥ বুঝিছি, কুনুই ঠেকিয়েছ। তা হলে তো সেদিকে আমাদের যতগুলি যজ্ঞের পাত্র আছে সমস্তই ফেলা যাবে। সাত মাসের বাছুরকে দিয়ে ঐ জানালা না চাটাতে পারলে শোধন হবে না।

আজকের বিশ্ব-পরিস্থিতিতে ‘বিসর্জন’ রবীন্দ্রনাথের একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক নাটক, আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তো বটেই। এই নাটকে অহেতুক প্রাণ বলির বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার উচ্চারণ শুনতে পাই। পরিশেষে ধর্মীয় অনুশাসনের লৌহ জাল ছিন্ন করে মানব ধর্মেরই জয় হয়, তবেতার জন্যে অনেক বড় মূল্য দিতে হয়; জয়সিংহের মত শুদ্ধ মানুষের প্রাণ। রবীন্দ্রনাথের একাধিক নাটকে আমরা এমন একজন মানুষকে দেখি যিনি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-ঞযব ঝধারড়ঁৎ ঞযৎড়ঁময উবধঃয। ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী এবং ‘মুক্তধারা’  নাটকের কুমার অভিজিৎ নিজ নিজ প্রাণবিসর্জন দিয়ে মানবতা বোধ ও শ্রেয়ঃ বোধের ধ্বজাকে চির-উন্নত করে রেখে যান পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে।

আমি ধারনা করি, রবীন্দ্রনাথের অন্তিম রচনা ‘রূপ-নারানের কূলে’ কবিতায় তাঁর জীবন ও শিল্প-বিশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। একটি পংক্তি উদ্ধৃত হল।

“রূপ-নারানের কুলে

জেগে উঠিলাম;

জানিলাম ও জগৎ

স্বপ্ন নয়।

রক্তের অক্ষরে দেখিলাম

আপনার রূপ-

চিনিলাম আপনারে

আঘাতে আঘাতে

বেদনায় বেদনায়;

সত্য যে কঠিন,

কঠিনেরে ভালোবাসিলাম-

সে কখনো করে না বঞ্চনা”।

আমার বিশ্বাস, গীতাঞ্জলি’র ‘দুঃখে যেন করিতে পারি জয়’, তাঁর সমগ্র লেখনী সত্বার মূলমন্ত্র ছিল এবং তাঁর নাট্য রচনায় এই জীবন দর্শনের ব্যত্যয় ঘটেনি। এই লেখনীর উপসংহারে যুক্ত করতে চাই- রবীন্দ্রনাথই বাংলা নাট্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, শুধু তাই নয়, তিনি সমগ্র বিশ্বের অন্যতমসেরা নাট্যকার, চির নতুন এবং চির প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্র-নাট্যচর্চার মধ্যেই বাংলাদেশের নাট্যচর্চার মোক্ষ ও সারাৎসার নিহিত।

মঞ্চসারথি আতাউর রহমান

অভিনেতা-নাট্য নির্দেশক, লেখক

২১-শে পদক প্রাপ্ত