রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার কোনো সুযোগ নেই: তপন মাহমুদ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গ্লিটজের মুখোমুখি হলেন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী তপন মাহমুদ। কথা বললেন, রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, তরুণদের মধ্যে রবীন্দ্র সংগীতের প্রভাবসহ অন্যান্য বিষয়ে।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2018, 07:47 AM
Updated : 8 May 2018, 07:47 AM

গ্লিটজ: শতবর্ষ পেরিয়েও শ্রোতাদের হৃদয়ে রবীন্দ্র সংগীত বেঁচে আছে। গানগুলো কোন শক্তিতে আজও  জীবন্ত বলে মনে করেন আপনি?

তপন মাহমুদ: রবীন্দ্র সংগীত প্রাসঙ্গিক, সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। যে গানটি এক’শ বছর আগে লেখা হয়েছে সেই গানটি আজও প্রাসঙ্গিক। ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ গানটির কথাই বলি, পৃথিবীর অবস্থার কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এখনও পৃথিবীতে হিংসা সমানভাবে বিরাজ করছে।

রবীন্দ্রনাথের শুধু গান নয় উনি সাহিত্য, নাটকে যে কথাগুলো বলতেন কথাগুলো আজও আমাদের চলার পথের পাথেয়।

রবীন্দ্রনাথের গান, চিন্তা, দর্শন সবটাই এখনও সমান ভাবে প্রযোজ্য। আমাদের দেশ ও বৈশ্বিক যে অবস্থান তাতে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা সহজে হারিয়ে যাবেন না।

গ্লিটজ: গানগুলো কালজয়ী হয়ে ওঠার পেছনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রসর চিন্তা-ভাবনাই কি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে?  

তপন মাহমুদ: তার কিছু গান শুধু আজ  নয়, তখনও প্রাসঙ্গিক ছিল। যেমন ‘বরিষও ধারা মাঝে শান্তিরও বাণী’ গানে চারদিকে অশান্তির প্রেক্ষিতে শান্তি চেয়েছেন ইশ্বরের কাছে।

এটাকে অনেকে আবার বর্ষার গান বলে ভুল করেন। এটা বর্ষার গান না। এতে শান্তি বরিষণ করতে বলেছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে।

গ্লিটজ: এখনকার শ্রোতারা পৃথিবীতে চলমান অসহিষ্ণুতা, মানুষে মানুষে বিভেদ আর যুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়ে গানটিকে এই সময়ের মতো করে ভাবতে পারেন।

তপন মাহমুদ: অবশ্যই। ‘আমারও পরাণও যাহা চায়’ গানটি কোনো কালে কি পুরানো হবে? কখনোই হবে না।

গ্লিটজ: ব্যকরণ ভেঙে রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার কাজের ঝোঁক বাড়ছে তরুণদের মধ্যে। এটাকে কীভাবে মূল্যায়ণ করছেন?

তপন মাহমুদ: রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ রবীন্দ্রনাথ তার গানগুলোর স্বরলিপি দিয়েছেন। গানগুলো সেভাবেই গাইতে হবে।

ত্রিশ বছর আগে যে ভাষায় কথা বলতাম এখন কিন্তু সেভাবে বলি না। একটু হলেও আধুনিক হয়েছে। সেইটুকু আধুনিকতা আমার পরিবেশনায় আসতে পারে।

কিন্তু সুর, তাল, লয়, বাণী-এগুলো বিকৃত করার সুযোগ নেই। শুধু পরিবেশনার ঢঙ পরিবর্তন হয়েছে, সেটা গ্রহণ করতেই হবে।

অনেকে অযথা কতগুলো যন্ত্র ব্যবহার করছেন। আমি যন্ত্র বিরোধী নই। তার সময়ে যে ধরনের বাজত সেই ধরনের যন্ত্র প্রায় বিলুপ্ত।এখন কিবোর্ড, গিটার দিয়েই তো করতে হবে।

তবে গানতে ছাপিয়ে মিউজিক যেন না যায়। এখন ফিউশন করছে। গানের মধ্যে কথাবার্তা ঢুকিয়ে যা করা হচ্ছে তা একদমই ব্যভিচার।

গ্লিটজ: তাদের যুক্তিতে, তরুণদের কাছে তাদের মতো করেই রবীন্দ্র সংগীতকে উপস্থাপন করতে চান।

তপন মাহমুদ: রবীন্দ্রনাথকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার জন্য নতুন কোনো সংযোজন দরকার নেই।

হিমালয় পর্বতকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য চুনকাম করার দরকার হয় না।

রবীন্দ্র সংগীতকে তাদের ঢঙে উপস্থাপন করার সুযোগ নেই। রবীন্দ্র সংগীতই অত্যাধুনিক।

গ্লিটজ: তরুণদের মধ্যে রবীন্দ্র সংগীতের প্রভাব কেমন দেখছেন?

তপন মাহমুদ: তরুণরা অনেক বেশি সচেতন। শুদ্ধভাবে রবীন্দ্র সংগীত শিখছেন। আমরা ভুল করলেও তরুণরা ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে। তরুণদের হাত ধরেই রবীন্দ্র সংগীত বেঁচে থাকবে।

গ্লিটজ: শুধুমাত্র রবীন্দ্র সংগীতকে আঁকড়ে ধরে থাকা তরুণ শিল্পী দেশে হাতে গোনা। এটাকে কি রবীন্দ্র সংগীত বিমুখতা বলবেন?

তপন মাহমুদ: এটাকে রবীন্দ্র বিমুখতা আমি বলব না। এখন সংগীতকে অনেকে পেশা হিসেবে নিতে চাইছে। যেটা আমরা নিতে পারিনি।

শুধু রবীন্দ্র সংগীত করলে গান শিখিয়ে যে পয়সা পাওয়া যায় সেটা দিয়ে জীবনধারণ করা যায় না। সেকারণে আধুনিক গান বা অন্য গানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কারণ সেখানে পয়সা বেশি। বাণিজ্যের একটা ব্যাপার আছে।

শুধু রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী দুই বাংলায় খুঁজলেই কম পাওয়া যাবে। তারপরেও শুধু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভালোবেসে যারা গান করেন তারা রবীন্দ্র সংগীত চর্চা করে যাচ্ছেন।

গ্লিটজ: আপনি বলছেন, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীরা শুধুমাত্র গান করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কি কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে?

তপন মাহমুদ: আমাদের মতো রাষ্ট্রে মনে হয় না, পেট্রোনাইজ করে শিল্পীদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।

আমাদের অন্যান্য এত সমস্যা রয়েছে এগুলোকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতিতে সরকারের কিছু করার আছে বলে মনে করি না। যেখানে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাজেট কিন্তু সব থেকে কম।

গ্লিটজ: সেক্ষেত্রে একজন তরুণ শিল্পীর পক্ষে শুধুমাত্র রবীন্দ্র সংগীত চর্চা করাটা চ্যালেঞ্জের নয় কি?

তপন মাহমুদ: আগের থেকে বেশি সুযোগ হয়েছে। আমাদের গান শেখার ও কর্মক্ষেত্রেরও সুযোগ কম ছিল। এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতে শিক্ষিতরা চাকরি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে জায়গাটা তৈরি হচ্ছে।

তারপরও আমাদের চাহিদার শেষ নেই। সবখানে বাণিজ্য ঢুকে যাচ্ছে। একজন শিল্পীর মাসিক আয় ১ লাখ টাকা হলেও অন্য কোনো গানে আরও ২ লাখ টাকা আয় করছেন। এতে করে শিল্পীর সাধনাটা নষ্ট হচ্ছে।

গ্লিটজ: রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে, বারবার জনপ্রিয় গানগুলোই পরিবেশন করেন শিল্পীরা। অপ্রচলিত গানগুলো নিয়ে সেভাবে কাজ হয় না।

তপন মাহমুদ: এটা সস্তা জনপ্রিয়তার কারণে। ইদানীং কিন্তু অনেক নতুন শিল্পীরাও অপ্রচলিত গান করছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীতের গানের আসরে এই ধরনের গানগুলো শুনতে পাওয়া যায়।

আমিও যখন টিভি চ্যানেলে লাইভ গাই, অনুরোধ আসে জনপ্রিয় গানগুলোর। অনুরোধ উপক্ষো করা যায় না।

শিল্পীরাও চায়, শ্রোতাদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে। ওই সস্তা জনপ্রিয়তা ছাড়তে পারছি না। আমি যদি অপ্রচলিত গান গাই তাহলে লোকজন দুটি গান শুনে তো উঠে যাবে। তাহলে তো আয়োজকরা আমাকে আর পরের বার ডাকবেন না।