‘লাকী ভাই বলতেন, পয়সার কাছে হার মানবে না’

গুণী শিল্পী ও সুরকার লাকী আখন্দের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2018, 03:46 PM
Updated : 21 April 2018, 04:09 PM

নব্বইয়ের দশকে লাকী আখন্দের সুরে ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটি গেয়ে তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ। গানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও প্রায় চল্লিশ বছরের সখ্যতা ছিল তাদের।

গ্লিটজ: লাকী আখন্দের সঙ্গে আপনার পরিচয় সেই আশির দশকের গোড়ার দিকে, আরামবাগে। আলাপের শুরুতে ৪০ বছর আগের সেই দিনগুলিতে ফিরতে চাই..

কুমার বিশ্বজিৎ: হ্যাপীর (হ্যাপী আখন্দ) সঙ্গে আমার খুব ভালো সখ্যতা ছিল। প্রথম অ্যালবামের চারটা গান সুর করে হ্যাপীর সঙ্গে দেখা করলাম। ও সেগুলো ইম্পোভাইজ করে কম্পোজিশন করে দিয়েছিল। ওই অ্যালবামে কাজ করতে গিয়েই লাকী ভাইয়ের বাসায় উঠেছিলাম। 

১৯৮১ সালের ঘটনা।..আমি আর হ্যাপী ফ্লোরে ঘুমাতাম, লাকী ভাই বেডে ঘুমাতেন। চাচা তখন বেঁচে ছিলে; উনি অন্য রুমে ঘুমাতেন। পনের বিশ দিন পর গানগুলোর রেকর্ড হলো। সেই থেকেই ওনার (লাকী আখন্দ) সঙ্গে আমার সখ্যতা তৈরি হয়েছিল। সংগীত আমার কাছে সাধনা। সাধনার শুরুতেই যাদের পেয়েছি তাদেরকে আমি সবার উর্ধ্বে রেখেছি।লাকী ভাইকে সবার উর্ধ্বে রাখি আমি।

পরে ওনার সুরে ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটি গেয়ে তো দারুণ সাড়া পেলাম। গানটা ওনার প্রতি আমার ঋণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

গ্লিটজ: প্রায় ৩০ বছর আগের রেকর্ডিং করা ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটা আপনার ক্যারিয়ারের মানচিত্রই পাল্টে দিয়েছে। গানটার জন্মকথা জানতে চাই। 

কুমার বিশ্বজিৎ: বিটিভিতে মুসা আহমেদের একটা অনুষ্ঠান ছিল। ১৯৯০ সালের ঘটনা। অনুষ্ঠানের নামটা ভুলে গেছি। মুসা ভাই বললেন, ‘দুইটা গান করতে হবে। টেলিভিশনে অতো আয়োজন করতে পারব না। যদি পারো নিজের খরচে করো।’

বললাম,‘ঠিক আছে।’ দুটি গানেরই কথা ছিল কাওসার আহমেদ চৌধুরীর। দু’টি গানের একটি ছিল, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’। তখন লাকী ভাইকে পাওয়া খুব দুষ্কর ছিল। সত্যিকারের শিল্পী যে রকম হয় আরকি। উনি প্রচন্ড আবেগী আর উদাসী। অনেক চেষ্টায় ওনাকে পাওয়া গেল।

এলভিস স্টুডিওতে গানটা রেকর্ডিং করানো হলো। উনি সুর করলেন। সঙ্গে গানের উনি মুখ দিয়ে পিচ করলেন। সেই মুখের পিচটা কিন্তু বাংলাদেশের কোনো গানে প্রথম ব্যবহার করা হয়।

গানটা পরে টেলিভিশনে গেল। কিন্তু কিছুই হলো না। পরে ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’সহ আরও  কয়েকটি গান নিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ করলাম। অ্যালবামের নামও ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’। তারপর তো গানটা ইতিহাস হয়ে গেল।

গ্লিটজ: আপনি বলছেন, বিটিভিতে প্রচারের পর গানটি সেভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি। পরে অ্যালবাম প্রকাশের পর দর্শকদের কাছে গানটি পৌঁছেছে?

কুমার বিশ্বজিৎ: প্রথমবার বিটিভিতে প্রচারের পর তেমন সাড়া পায়নি। অ্যালবামটা প্রকাশ হওয়ার পর গানটা সাড়া ফেলেছে। পরে বিটিভির আরেকটা অনুষ্ঠানে গানটি পরিবেশন করে ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। অনুষ্ঠানটার নাম ভুলে গেছি, ‘আনন্দ মেলা’ হতে পারে। পরে আস্তে আস্তে গানটা অন্য জায়গায় চলে গেল।

গ্লিটজ: শিল্পী লাকী আখন্দের বাইরে ব্যক্তি লাকী আখন্দের সঙ্গেও আপনার সখ্যতা দীর্ঘদিনের ছিল। দু’জনের বোঝাপড়াটা কেমন ছিল? 

কুমার বিশ্বজিৎ: উনি তো খুব উদাসী লোক। হঠাৎ করে একবার রাঙামাটি চলে গেলেন। পাহাড়ের চূড়ায় বসে আমাকে ফোন করতেন। আস্তে আস্তে কথা বলতেন, ‘বিশ্বজিৎ, সুন্দর লোকেশন। সূর্য ডুবছে।’

আমি তখন ব্যস্ত কিনা সেটা কোনো ব্যাপার না। উনি আমাকে পুরো দৃশ্যটি বর্ণনা করতেন। আকাশের রঙ কী, আবহাওয়া কেমন, উনি কোন জায়গায় বসে আছেন এবং দুই-তিন দিন সেখানে কী করেছেন-সব বর্ণনা করতেন। মাঝে মধ্যে বাসায়ও চলে আসতেন। আড্ডা হতো। তবে ওনার কাছ থেকে গান নেওয়া খুব দুষ্কর ছিল।

গ্লিটজ: গান নেওয়া দুষ্কর ছিল কেন?

কুমার বিশ্বজিৎ: ওনাকে বলতাম, ‘চলেন, একটা গান দেন।’ উনি বলতেন, ‘দাঁড়াও, নতুন গান বানাই।’ বানাতে বানাতে হঠাৎ বলতেন, ‘আজকে মুড নাই বিশ্ব। পরে আসো একদিন।’ এগুলো হত আরকি।

আমি বলতাম, ‘পুরানো গাট্টি থেকে কিছু গান দেন না।’ বলতেন, ‘আরে এগুলো না, তোমার জন্য নতুন করে বানাব।’

ইম্পোভাইজ মিউজিকের প্রতি উনার ঝোঁক ছিল। কখনও উনি বলতেন, ‘আমি এক’শটা ভায়োলিন ইউজ করে তোমার জন্য একটা গান করব। লন্ডন থেকে মিউজিশিয়ান আনাবো।’

আমরা এখন যেটা করেছি, সেটা উনি ভেবেছেন আশির দশকে। এই দেশে জন্ম না হলে ইউরোপ-আমেরিকায় উনার জন্ম হলে জানি না ওনার অবস্থান কোথায় থাকত।

গ্লিটজ: আসলেই কি লাকী আখন্দকে আমরা মূল্যায়ণ করতে পেরেছি?

কুমার বিশ্বজিৎ: প্রতি বছর অনেক বাজেট হয়। প্রতিটা ক্ষেত্রে কাজ করা হয়। কিন্তু কোনোদিন কেউ ভাবেনি, শিল্পীরা কীভাবে বাঁচেন। আমরা অনেকভাবে বলি, এদেশে শিল্প সংস্কৃতি না থাকলে দেশ থাকবে না। কিন্তু এ পর্যন্ত শিল্পীদের পারিশ্রমিক বাড়ানো হয়েছে কোনো বছর? কেউ চিন্তা করেছে? আমরা একটা শিল্পী সমিতি করেতে পারিনি। আমাদের গানগুলো বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে খাচ্ছে। কেউ কোনোদিন কিছু দেখল না। লাকী আখন্দ চিকিৎসার জন্য কষ্ট পায়। কেন? লাকী আখন্দের কত গান, কতভাবে টেলকোগুলো বেচেছে, কতভাবে খেয়েছে। ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানের পয়সাগুলোও যদি পেত তাহলেও উনার চিকিৎসার খরচ উঠে যেত।

উনি ক্ষণজন্ম মানুষ। কত শত বছর পর আবার এই দেশে একজন লাকী আখন্দ আসবে সেটা আমি জানি না। বা আদৌ আসবে কিনা সেটাও জানি না।

সংগীতে এখন যোগ্য ব্যক্তির মূল্যায়ণ চলে গেছে। সামনে আরও চলে যাবে। এখানে রাজনীতি ঢুকে গেছে। এখানে যোগ্যতার চাইতে ভীষণ কৌশলী মানুষের বিচরণ বেশি। পিওর শিল্পী কী জিনিস, একটি মানুষকে আবিস্কার করলেই বুঝা যাবে। অর্থ বৈভবের প্রতি কোনো মোহ ছিল না লাকী ভাইয়ের।

গ্লিটজ:শেষ দিনগুলিতে লাকী আখন্দের পাশে ছিলেন আপনি। শেষ দিনগুলি কেমন ছিল উনার?

কুমার বিশ্বজিৎ: এটা অনেকেই খারাপ বলবে। আজকে আপনাকে বলেই দিই, আমার প্রিয় মানুষদের এটা শুনতে ভীষণ খারাপ লাগবে। আমার বাবা যখন হসপিটালে ছিলেন তখন হসপিটালের নিচেই ঘুমিয়েছি কিন্তু উপরে গিয়ে দেখতাম না। বাবার মৃত মুখ কিন্তু আমি দেখিনি। ইচ্ছে করেই দেখিনি। আমার চোখে যেটা রেখেছি সেটাই আমার চোখে রাখতে চাই।

লাকী ভাইকে দেখতে হসপিটাল পর্যন্ত গেছি। তারপরে যখন শরীর ভাঙা শুরু করল তখন আর উনার সামনে যেতে পারিনি। সবকিছুতেই ছিলাম। চিকিৎসা থেকে ফেরত পর্যন্ত ওনার সঙ্গেই ছিলাম। তারপরে ফিরার পর তো অনেক উদ্যোম নিয়েই গান করলেন। আবার কাজ করবেন বললেন। সেটা তো আর হলো না।

গ্লিটজ: মৃত্যুর পর উনার গানগুলো অনেক শিল্পীই গাইছেন। সুর বিকৃতিরও অভিযোগ উঠেছে কারও কারও বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে আপনি কী ভাবছেন?

কুমার বিশ্বজিৎ: অনুষ্ঠান চালানোর জন্য কোনো রকমে সুর করে গান উপস্থাপন করি আমরা। তাতে গানগুলো যারা সৃষ্টি করে তাদের খুব অসম্মান হয়। কারণ একটা লোক যেভাবে সুর করেছেন গানটা সেভাবে করতে গেলে সেই ধরনের মিউজিশিয়ান লাগে। খরচ অনেক বেড়ে। তখন অনেকে কোনোভাবে দায়েসারা গোছের অনুষ্ঠান করে। এটা যাতে না করে সেটাই আমি বলব। যদি কারও গান করতে হয় তাহলে তাকে পূর্ণ সম্মান দিয়েই যাতে গানগুলো করা হয়।

গ্লিটজ: শেষ প্রশ্ন।  লাকী আখন্দের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আপনার। দীর্ঘ আলাপ। তার কোন কথাটি আপনি এখনও মনে রেখেছেন?

কুমার বিশ্বজিৎ: লাকী ভাই সবসময় বলতেন, পয়সার কাছে হার মানবে না। আর একটা জিনিস খুব ভালো লাগতো। যেটা আমার জীবনের আদর্শ হিসেবে কাজ করে। উনি বলতেন, দলছুট মানুষ হবা। দর্শকের পেছনে দৌড়াবা না, দর্শককে তোমার দিকে আনবা না। এটা প্রচন্ড ভাবে ছুঁয়ে গেছে। কথাটা মনে রাখার চেষ্টা করেছি। আমি জীবনে ‘কথিত’ ব্যবসায়ীর কাছে হার মানিনি।