বিনোদনের কোনো সেক্টর কি ভালো আছে?

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে জীবনযাপন, সংস্কৃতিচর্চা । বিনোদনের অন্যান্য ক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনার পাশাপাশি ভবিষ্যত ভাবনা উঠে এসেছে এই লেখায় ।

অহিদুজ্জামান ডায়মন্ডবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2018, 03:28 PM
Updated : 28 March 2018, 03:35 PM

সিনেমার বর্তমান মন্দা বাজার নিয়ে অনেকে বেশ হতাশ। একপক্ষ বলছেন নির্মাতারা ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যর্থ হওয়াই এর প্রধান কারণ। আবার আরেক পক্ষ বলছেন বর্তমান অবস্থায় দেশের অধিকাংশ সিনেমা হল অপরিচ্ছন্ন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হওয়ায় দর্শক সিনেমা হল বিমুখ হয়েছে।

যে যাই বলুক, বাংলা সিনেমার বাণিজ্য যে মুখ থুবড়ে পড়েছে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

স্বদেশী সিনেমার গল্প ভালো না, নির্মাতা ভালো না, শিল্পী ভালো না, গান ভালো না, গানের কন্ঠ ভালো না, নাচ ভালো না, ভালো না কিছুই ভালো না।

এই অবস্থা থেকে ‘বাংলা সিনেমাকে বাঁচাতে হবে’ স্লোগান তুলে কিছু সিনেমা প্রেমিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সিনেমা বাণিজ্য রক্ষার্থে ভারতীয় বাংলা ছবি আমদানি করে শত চেষ্টা চালিয়েও সিনেমা ব্যবসা পুনরুদ্ধারেও ব্যর্থ।

সত্যি কি স্বদেশী বাংলা সিনেমার সব গল্পই খারাপ? সব নির্মাতাই মেধাহীন?

আমার তা মনে হয়না। বাস্তবতা অন্যখানে। আর সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার পথ নাই। একটু পেছন ফিরে দেখি।

যখন সিনেমা বাণিজ্য চাঙ্গা ছিল, হল গুলোতে প্রায় প্রতিটি শো রমরমা ব্যবসা করত তখন প্রযুক্তি আজকের মত এত শক্তিশালী ছিল না। ছিল না ইন্টারনেট ইউটিউব ম্যাসেঞ্জার হোয়াটসআ্যপ-এর মত জনপ্রিয় সোশ্যাল মাধ্যম।

আবার বিশ্বজুড়ে আজকের মত অর্থনীতির গ্রোথও এমন তরতাজা ছিল না।

শহরে উপশহরে হরেক রকম কল কারখানা ইন্ডাস্ট্রিজ নিত্য নতুন ব্যবসা, শত শত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ছিল না। ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছিল না। সিজার বা খাৎনার জন্য ডজন ডজন ক্লিনিক ছিল না। কোচিং বাণিজ্য ছিল না।

একসময় যে পথে গরুগাড়ি চলত এই কিছুদিন আগে সেখানে এসেছিল প্যাডেল চালিত রিক্সা। এখন গ্রামগঞ্জে প্যাডেল রিক্সার স্থান দখল করেছে যান্ত্রিক অটো রিক্সা।

সময় পরির্বতনের কারণে ইচ্ছে করলেও কেউ আর এই সময় ঘরে বেকার বসে থাকতে পারেনা। অশিক্ষিত ছেলে মেয়েরাও এখন সকাল আটটায় কাজের জন্য ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করে রাত আটটায় বেরোয়। তার হাতে সময় কোথায় তিন ঘন্টা বিনোদনের জন্য ব্যয় করবার?

আধুনিক শিক্ষার বিকাশ ঘটেছে সর্বত্র। দেশের আনাচে কানাচে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। আগে যেখানে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে নারীরা দল বেঁধে বাটা হলুদের পাত্র হাতে গাইতো গ্রাম বাংলার বিয়ের গীত, আজ সেখানে সাউন্ড সিস্টেমে ভর করে চেপে বসেছে ডিজের ভূত।

অস্বীকার করার উপায় নেই, আমরা যত আধুনিক হয়েছি ততই আবেগকে জলাঞ্জলি দিয়েছি। ষাট বা সত্তর দশকের দর্শকের মত বর্তমান প্রজন্ম হলে বসে শাবানার চোখে পানি দেখে নিজের চোখ ভেজাবে এটা ভাবাই বৃথা।

সময়ের সাথে সাথে আমাদের আচার ব্যবহারেও এসেছে পরির্বতন। প্রযুক্তির বদৌলতে স্মার্ট ফোন হাতে সভা সেমিনার সিনেমা, এমনকি মরার বাড়িতে বসে ফেইসবুক চ্যাট করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ।

বিশ্বের যে কোনো বিনোদন আজ মানুষের হাতের মুঠোয় বন্দি। প্রযুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে পৃথিবীর ঐতিহ্য পোস্টাল ব্যবস্থা এখন প্রায় যাদুঘরে!

ডাক পিয়ন ডাকঘর চিঠির বাক্সে হাতে লেখা চিঠির খাম বা পোস্টকার্ড, ছেলের কাছে বাবা, অথবা মা-বাবার কাছে ছেলের মানি অর্ডার করে টাকা পাঠানোর গল্প শুনলে আজকের প্রজন্ম অবাক হয়।

এখন আর মাস্তুলের মাথায় পাল বেঁধে মাঝি হাল ধরে নৌকা চালায় না। এখন নৌকা চলে স্যালো মেশিনের কল্যাণে। সময়ের কাছে সংস্কৃতি পরাজিত এমন হাজারও উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

সিনেমা ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে!

দর্শক এখন সিনেমা হলে যায়না। সত্য। কিন্তু বিনোদন জগতের কোন সেক্টরটা ভালো আছে? অডিও ব্যবসা আছে? শ্রোতা এখন আগের মত ক্যাসেট বা সিডি কিনে গান শুনে?

না। প্রযুক্তির কাছে সেই প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। আজ আর কেউ ঘরে ছোট বড় ক্যাসেট প্লেয়ার যত্ন করে তুলে রাখেনা।

আমরা এখন হেড ফোন কানে কোমরে ওয়াকম্যান ঝুলিয়ে জার্নি করিনা। তাহলে কি আমাদের গানের রাজ্য শেষ? মেধাবী কন্ঠশিল্পী আর নাই? আছে এবং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ইউটিউবে।

দর্শক কি আগের মত এখন আর মহিলা সমিতি থিয়েটারে টিকেট কেটে নাটক দেখে?

মনে হয়না। তার মানে কি এখন আর এদেশে নাট্য গোষ্ঠীগুলি নাই? আজকের প্রজন্ম  আমাদের সময়ের মত টিভি দেখেনা।

আগে তো দর্শক টিভিতে সিনেমা নাটক এমন কি ছায়াছন্দ দেখার জন্য সাদাকালো টিভি সেটের সামনে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। এখন টিভি দর্শকও আর তেমন আগের মত নেই। কেন?

তাহলে কি টিভি মিডিয়াও মেধাশূন্য হয়ে পড়েছে?

না। প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট ইউটিউবের সাথে সময়ের ব্যস্ততা টিভি সেটের সামনে বসার প্রয়োজনীতা কমিয়ে দিয়েছে।

রেডিওতে কান লাগিয়ে ‘দূর্বার’ শোনার শ্রোতাও ছিল প্রচুর। এখন, শোনে? না। সে সুযোগ আজকের একজন কৃষকেরও নেই, কারণ তার হাতেও এখন একটা স্মার্ট ফোন।

ফেইসবুক রেখে বিনোদন পত্রিকাই বা এখন ক’জন পড়ছে? আজ সেই সংখ্যাও অনেক কম। তার মানে এই নয় যে ওই সব পত্রিকার মানদণ্ড তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে বলে পাঠক পত্রিকার পাতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

বরং বলা যেতে পারে আজকের প্রযুক্তি তাকে এগুলো থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।

এই অবস্থায় হাজার বারোশো’ সিট ক্যাপাসিটির একটি হলে, দিনে তিনটি শো চালিয়ে তিন হাজার ছয়শো মানুষকে বেকার বানিয়ে তিন ঘন্টা করে নয় ঘন্টা, সপ্তাহের সাতটি দিন আটকে রাখা প্রায় অসম্ভম ব্যাপার।

অতএব, একে অন্যকে দোষারোপের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে এই সত্য স্বীকার করে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। প্রযুক্তির উত্থানকে গ্রহণ করে তার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে।

ভয় পাওয়া বা হতাশ হবার কিছু নেই। পথ খুঁজলে, পথ বেরিয়ে আসবে হয়ত, একটু অন্য ভাবে যা আমরা এই মুহূর্তে ভাবতে পারছি না।

সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে গ্রামোফোন, কলের গান ভিসিআর ওয়াকম্যান ডাকঘর। হারিয়ে গেছে জারি-সারি, ভাওইয়া-ভাটিয়ালি, যাত্রা, আলকাপ, সার্কাস, পুতুলনাচ, এক্সিবিশনের মেলা এমন কি গৃহস্থের নিকানো উঠানে জোৎস্না রাতে গল্প বলার পালা।

আমরা যা হারিয়েছি তার অনেক কিছুই আবার ফিরে পেয়েছি তবে নতুন রূপে।

তেমন হয়ত এমন একদিন আসবে যেদিন একসাথে হলে বসে সিনেমা দেখার বিষয়টা হারিয়ে যাবে। ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে সে অধ্যায়!

যেমন আজও স্মৃতি হয়ে আমার মত অনেকের বুকের ভিতর ধ্বনিত হয় শন শন বাতাসের সংমিশ্রণে ঝিকঝিক সুরের সাথে হুইসেল দেয় কয়লার ইঞ্জিন চালিত ট্রেন।

তাতে কি? এখন তো জার্নি করি আগের থেকে বহুগুন দ্রুতগামী ট্রেনে। এভাবেই হয়ত নতুন রূপে নতুন আঙ্গিকে দর্শকের সামনে আবার ফিরে আসবে সিনেমা।

এখন সময় ভয় না পেয়ে নতুন ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করার সাহস সঞ্চয় করা।

লেখক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা ।