মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও আমাদের মঞ্চ-নাটক

শুধু মৌলিক নাটকই নয়, অনুবাদ ও রূপান্তরিত নাটকও পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সংগ্রাম-মুখর জীবনের চলচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

>>আতাউর রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2018, 09:51 AM
Updated : 26 March 2018, 09:51 AM

আজ থেকে ৪৭ বছর আগে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এই দেশে একটি বিস্ময়কর ও গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা ঘটেছিল।

পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্ব-মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের আত্মপ্রকাশ; যার নাম বাংলাদেশ।

পিছনে ফিরে এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি, আসলে এটা স্বপ্ন ছিল না সত্যিই ঘটেছিল?

আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যতটুকু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এবং তার পরবর্তী স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দ ও দুখঃ-কষ্টের প্রতিফলন থাকার কথা ছিল ঠিক ততটা পড়েনি।

তবে এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এত বছর পরেও বই লেখা হচ্ছে, চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে।

তবে এই কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে ভিত্তি করে বেশ কিছু ভাল উপন্যাস, কবিতা, ভাষ্কর্য, ছোটগল্প, অঙ্কন শিল্প এবং নাটক রচিত হয়েছে।

প্রয়োগশিল্প মাধ্যমগুলো, যেমন থিয়েটার, যাত্রা, নৃত্যশিল্প, পুতুল নাচসহ অন্যান্য লোকজ অভিনয়, নৃত্য ও সঙ্গীত প্রধান মাধ্যমগুলোতে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিভাস পরিলক্ষিত হয়।

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’

থিয়েটার বা মঞ্চনাটককে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ ফসল। মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশেই দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার সূচনা হয় যা আজ একটি ব্যাপক ও দর্শক-প্রিয় শিল্পমাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

আজ সারা দেশে দু’শোর ও বেশি নাটকের দল মঞ্চ-নাটকের চর্চায় নিয়োজিত।

নাট্যকলা বিষয় হিসেবে দেশের চারটি প্রধান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। এছাড়া কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও নাট্যকলা শিক্ষা-সূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

নাট্যকলা শেখানের জন্য দেশে কয়েকটি প্রাইভেট স্কুল নিয়মিতভাবে সক্রিয় রয়েছে। যথেষ্ট না হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নাটকের মঞ্চ গড়ে উঠেছে।

মঞ্চ-নাটক ভিত্তিক একাধিক সাময়িকী বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। দৈনিক প্রত্রিকাগুলো মঞ্চ-নাটককে গুরুত্ব দিয়ে নিয়মিতভাবে প্রতিবেদন ও খবরা-খবর পরিবেশন করে।

ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে একটি বিশেষ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।

ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় প্যারিসে অবস্থিত।

বিভিন্ন দেশের আই,টি,আই (ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট) কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কেন্দ্র নাট্যক্রিয়া এবং প্রকাশনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সক্রিয় এবং উজ্জ্বল সে সত্যটি দেশে বিদেশে স্বীকৃত।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন দেশের নাটকের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান।

নাটকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুকৃতী অর্জনের এই হল অতি সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

আজ যারা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অভিনয়ের ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছে তাদের অনেকেই মঞ্চ-নাটকের অভিযাত্রী।

মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল আল মামুন

টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রয়োজনীয় কারিগরী সহায়তায় এবং অংশগ্রহণেও মঞ্চ-নাটকের কর্মীরা বর্তমানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের প্রধান নাট্যকারদের লেখায় আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে যথেষ্ট পরিমাণে।

একটি বিষয় এই ছোট লেখাটিতে উল্লেখ করা প্রয়োজনীয় যে, লিখিত নাটকসমুহ যা আমাদের দেশে মঞ্চায়িত হয়ে আসছে; প্রায় সব নাটকেই আমাদের সংগ্রামের, প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

এই ক্ষেত্রে শুধু মৌলিক নাটকই নয়, অনুবাদ ও রূপান্তরিত নাটকও পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সংগ্রাম-মুখর জীবনের চলচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

আমাদের মৌলিক নাট্যকারদের মধ্যে সেলিম আল দীন, মমতাজ উদ্দীন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন,মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ হেল মাহমুদ, মান্নান হীরা, মাসুম রেজা একাধিক প্রতিবাদী নাটক লিখেছেন যেসব নাটকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিভাত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

এই ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আল-মামুনের ‘এখনও ক্রীতদাস’, মামুনুর রশীদের ‘জয় জয়ন্তী’, সেলিম আল দীনের ‘কেরামত মঙ্গল’, মমতাজ উদ্দিন আহমেদের ‘রাজা অনুস্বারের পালা’ ও সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, নুরুলদীনের সারাজীবন’ এবং ‘যুদ্ধ এব যুদ্ধ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রথম সফল মঞ্চ নাটক ‘কিংশুক যে মেরুতে’, রচনা আহসান উল্লাহ।

এই নাটকটি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রথম নাট্যোৎসবে অভিনীত হয় খুব সম্ভবতঃ ১৯৭৪ সালে। ‘সারথী’ নাট্যগোষ্ঠী এই নাটকটি এই উৎসবে মঞ্চায়ন করে।

আমাদের প্রধান নাট্যকারদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে প্রধানতঃ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র বেশি ফুটে উঠেছে।

সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে রচনা করেছেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নাটকটির সূচনা হয় এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা অর্জন, এই দুই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তিনি জীবনের মৌল জিজ্ঞাসার অন্তরে প্রবেশ করেছেন।

সেলিম আল দীন, সৈয়দ শামসুল হক

মুক্তিযুদ্ধের উপর রচিত নাটকগুলোর মধো আমার ধারনায় বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হল ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।

তার রচিত ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের শত্রু রাজাকারদের বিরাজমান দৌরাত্ম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে।

নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বেলের সাম্প্রতিক নাট্য প্রযোজনা সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, প্রত্যক্ষ ভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর রচিত নাটক।

উনি তার উপন্যাস ‘নীল দংশন’-এর উপর ভিত্তি করে এই নাটকটি রচনা  করেছেন। এই নাটকটির নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছে বর্তমান লেখক।

সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ও এক অর্থে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেরই নাটক।

মামুনুর রশীদ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে একটি চমৎকার নাটক রচনা করেছেন, ‘জয় জয়ন্তী’।

এই নাটকটি মঞ্চ-সফলও বটে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ‘হরিণ চিতা চিল’সহ একাধিক সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ নাটক রচনা করেছেন।

আমাদের অন্যতম প্রধান নাট্যকার সেলিম আল দীন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের নাটক না লিখলেও তার নাটকের প্রধান উপজীব্য স্বদেশ ও মানুষের সংগ্রামী জীবনচর্যা।

এই ক্ষেত্রে আমি তার প্রথম দিককার নাটক ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ ও ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসী’ এবং পরবর্তীতে লেখা ‘কিত্তনখোলা’র নাম উল্লেখ করব।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবক্ষয়কে কেন্দ্র করে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক রচনা করেছেন, ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’।

সবশেষে বলব আমাদের মঞ্চ-নাটকের সব অর্জনই আমাদের মুক্তি যুদ্ধের ফসল।

মুক্তিযুদ্ধে গৌরবান্বিত এই দেশ একদিন বিশ্ব-মানচিত্রে মঞ্চ-নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ হয়ে উঠবে এই প্রত্যয় আমাদের আছে।

লেখক: মঞ্চসারথি আতাউর রহমান, ২১শে পদক প্রাপ্ত অভিনেতা-নাট্যনির্দেশক-লেখক