শ্রীদেবীর নায়কেরা

এ আলোচনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিনেমার উল্লেখযোগ্য সাত নায়কের কথা..

প্রদীপ করবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2018, 10:33 AM
Updated : 4 March 2018, 01:21 PM

মাত্র চার বছর বয়সে তামিল ছবি ‘‌থুনাইভান’-এ‌ প্রথম ক্যামেরার মুখোমুখি। ৫৪বছর বয়সের ৫০বছরই কেটেছে সিনেমার সঙ্গে । বলিউডের ‘লেডি বচ্চন’ কাজ করেছেন অনেক নায়কের সঙ্গেই, উপহার দিয়েছেন অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবি ।

শ্রীদেবী সবথেকে বেশি অভিনয় করেছেন তেলুগু ভাষায়, ৮১টি । তামিল ভাষায় ৭২টি, মালয়ালাম ভাষায় ২৩টি, কন্নড় ভাষায় ৬টি এবং হিন্দি ভাষায় অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৭২টি ।

কামাল হাসান:

দক্ষিণের অন্যতম খ্যাতিমান অভিনেতা কামাল হাসানের সঙ্গে ১৯৭৬সালে ‘মুনরু মুদিচু’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কাজের সূচনা ।

তারপর এই জুটির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিকতার বাইরে সারা ভারত জুড়েই । তামিল, তেলুগু, হিন্দি মিলিয়ে ২১টি চলচ্চিত্রে একসঙ্গে কাজ করেছেন তারা ।

১৯৮৩তে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাদমা’ ছবিটি এই জুটির সর্বকালীন জনপ্রিয় সিনেমা । ১৯৮২ সালের ‘মুন্দ্রাম পিরাই’ ছবিটির হিন্দি সংস্করণটিও নির্মাণ করেছিলেন বালু মহেন্দ্র ।

এই চলচ্চিত্রে ইলাইয়া রাজা’র সংগীত পরিচালনায় ‘এক দফা এক জঙ্গল থা’ গানটিতে কন্ঠ দিয়েছিলেন শ্রীদেবী এবং কামাল হাসান ।

এই চলচ্চিত্রে শ্রীদেবী অভিনীত ‘রেশমি’ চরিত্রটি দর্শক ভুলতে পারেননি এখনও ।

হিন্দি ভাষার এই ‘সাদমা’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে শ্রীদেবী, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে কামাল হাসান এবং শ্রেষ্ঠ কাহিনির জন্য বালু মহেন্দ্র ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন ।

 

রজনীকান্ত:

১৯৭৬ সালে এই ‘মুনরু মুদিচু’র মাধ্যমে রজনীকান্তের সঙ্গেও শ্রীদেবীর কাজের শুরু । দক্ষিণের এই সুপারস্টারের সঙ্গে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত সময়কালে তামিল, তেলুগু, হিন্দি মিলিয়ে ২২টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ।

এই দুই কিংবদন্তির অভিনয় দক্ষতাকে এখনও কুর্ণিশ করে গোটা চলচ্চিত্র দুনিয়া।

এই ‘মুনরু মুদিচু’র যখন শ্যুটিং হয়, তখন কামাল হাসান প্রায় স্টার । কিন্তু রজনীকান্ত তখন নবাগত অভিনেতা । শ্রীদেবীর বয়স ১৩বছর ।

এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য এখন দক্ষিনী সুপারস্টার রজনীকান্তের চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন শ্রীদেবী ।

এই ছবিতে রজনীকান্তের পারিশ্রমিক ছিল দুই হাজার রুপি । আর শ্রীদেবী নিয়েছিলেন পাঁচ হাজার রুপি ।

১৯৮৪ তে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জুলম কি জঞ্জীর’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য:

 

জিতেন্দ্র:

বলিউডের খ্যাতিমান অভিনেতা জিতেন্দ্র’র সঙ্গে শ্রীদেবী কাজ করেছেন ১৮টিরও বেশি ছবিতে ।

‘হিম্মতওয়ালা’ সিনেমার মাধ্যমেই বলিউডে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেন শ্রীদেবী।

চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে ‘হিম্মতওয়ালা’ সিনেমাতে জিতেন্দ্রর থেকে অনেকটা আলো কেড়ে নিয়েছিলেন শ্রীদেবী।

তেলুগু চলচ্চিত্র ‘উরু কি মোঙ্গাডু’র হিন্দি সংস্করণ ‘হিম্মতওয়ালা’ ছবিতে প্রথম জিতেন্দ্রর সঙ্গে কাজ করেন শ্রীদেবী ।

কে. রাঘবেন্দ্র রাও নির্মিত চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৩ সালে । এই চলচ্চিত্রের ‘নয়নো মে স্বপ্না’, ‘তাকি ও তাকি’ গানগুলি এখনও সমান জনপ্রিয় ।

জিতেন্দ্র-শ্রীদেবী জুটির‘হিম্মতওয়ালা’,‘জানি দোস্ত’,‘তোফা’,‘আগ অওর শোলা’,‘ঘর সংসার’, ‘সোনে পে সুহাগা’সহ অধিকাংশ চলচ্চিত্র এখনও ভীষণ জনপ্রিয় ।

‘হিম্মতওয়ালা’ ছবির একটি জনপ্রিয় গান:

 

মিঠুন:

মাত্র চারটি চলচ্চিত্রে একসঙ্গে কাজ করলেও বলিউডের সবচেয়ে বিতর্কিত জুটি মিঠুন-শ্রীদেবী ।

শ্রীদেবী-মিঠুন প্রেম কাহিনি বলিউডের অন্যতম সাড়া জাগানো রোমান্স উপাখ্যান। আশির দশকে চলচ্চিত্র পত্রিকাগুলি সরগরম ছিল এই গুঞ্জনে।

শ্রীদেবী চেয়েছিলেন মিঠুন তার স্ত্রী যোগিতাবালিকে পরিত্যাগ করে বিয়ে করুক তাকে|। যদিও পরবর্তী এক সময় বুঝতে পারলেন তাকে ভালোবাসলেও যোগিতাবালিকে মিঠুন ছেড়ে আসতে পারবেন না । ততদিনে শ্রীদেবীর জীবনেও আবির্ভাব ঘটে গেছে বনি কাপুরের ।

১৯৮৪ সালে ‘জাগ উঠা ইনসান’ চলচ্চিত্র দিয়ে দুজনের অভিনয় শুরু । তারপর ১৯৮৭ তে টি. রামা রাও পরিচালিত ‘ওতান কে রাখওয়ালে’, ১৯৮৮তে ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’ এবং ১৯৮৯-এ ‘গুরু’ ।

‘আমার নায়িকারা’ বইয়ে শ্রীদেবী’র স্মৃতিচারণায় মিঠুন লিখেছেন, “কাজ করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল সুন্দর একটা সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের সূত্রে আমি আর শ্রী ক্রমশ জড়িয়ে গেছিলাম একটা ভালোলাগার বন্ধনে।

সেই সম্পর্কে হয়তো ছিল প্রাপ্তির প্রত্যাশা। চাহিদার প্রতিশ্রুতি। দায়বদ্ধতা …জানি না, সত্যি জানি না।

তবে এটুকু জানি , সেই ‘দায়’ কখনও আমি মেটাতে পেরেছি, কখনও  পারিনি …আর এই পারা, না -পারার মাঝেই আমার আর শ্রী-র সম্পর্কে তৈরি হল একটা দূরত্ব।

মনে আছে ১৯৮৯ সাল । ‘গুরু’-র লাস্ট শট।

পরিচালক উমেশ মেহরা চিন্তা করছে, আমাদের শট শেষ করা যাবে কি না।

নিশ্চিত করেছিলাম উমেশক, ‘ডোন্ট ওরি, আমি কথা দিচ্ছি, তোমার শট শেষ হবে। শ্রী আমার থেকে যদি দূরে সরেও যায়, ছবি শেষ না করে যাবে না।’

ছবি শেষ। আমাদের ‘বন্ধুত্ব’ও শেষ। আর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি।”

বাপ্পী লাহিড়ীর সংগীত পরিচালনায় ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’, ‘গুরু’ সিনেমার গানগুলি ভীষণ জনপ্রিয়তা পায় ।

 

ঋষি কাপুর:

বলিউডে শ্রীদেবীকে যে ‘চাঁদনি’ নামে অনেকেই জানে, সেই ‘চাঁদনি’ সিনেমার নায়ক ঋষি কাপুর ।

১৯৮৬ সালে হরমেশ মালহোত্রা পরিচালিত ‘নাগিনা’ চলচ্চিত্র দিয়ে দুজনের কাজের সূত্রপাত । এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এই জুটির জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছয়, যে, পরিচালক যশ চোপড়া এই ‘চাঁদনি’ ছবিতে  ঋষি কাপুরের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে রেখা’র কথা ভাবলেও ‘চাঁদনি’চরিত্রে শ্রীদেবীকেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করেন ।

চরিত্রটিতে শ্রীদেবীর অভিনয় দর্শককে এতটাই মুগ্ধ করে যে ‘চাঁদনি’ নামেই পরিচিত হয়ে যান তিনি ।

চাঁদনি ছবিতে, লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া 'মেরে হাথো মে ন ন চুড়িয়া' গানের সঙ্গে শ্রীদেবীর নাচ আজও বলিউডের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।

এরপর আবার হরমেশ মালহোত্রার নির্দেশনায় ১৯৯১-এ ‘বানজারা’ ছবিতে এই জনপ্রিয় জুটি অভিনয় করেন । এছাড়াও বিনোদ মেহেরা পরিচালিত ‘গুরুদেব’ (১৯৯৩) ছবিতে অনিল কাপুর শ্রীদেবীর পাশাপাশি ঋষি কাপুর অভিনীত ইন্সপেক্টর দেবকুমার চরিত্রটিও দর্শকপ্রিয়তা পায় ।

পার্থ ঘোষ পরিচালিত ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কৌন সাচ্চা কৌন ঝুটা’এই জুটির শেষ সিনেমা ।

আশি-নব্বই দশকে স্টাইল আইকন হিসেবেও ঋষি কাপুর-শ্রীদেবী জুটি মানুষের মন জয় করে ।

‘চাঁদনি’ চলচ্চিত্রের এই গানে প্লেব্যাক করেছেন শ্রীদেবী:

 

অনিল কাপুর:

ফিরোজ খান পরিচালিত ১৯৮৬তে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জাঁবাজ’ চলচ্চিত্রে প্রথম অনিল কাপুরের সঙ্গে অভিনয় শ্রীদেবীর ।

যদিও এই ছবিতে অনিলের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে ছিলেন ডিম্পল কাপাডিয়া । সীমা নামের একটি ছোট্ট চরিত্রে অতিথি শিল্পী হিসেবে উপস্থিতি ছিল শ্রীদেবীর ।

এই বছরই সুভাষ ঘাই পরিচালিত ‘কর্মা’ ছবিতে জুটি বাঁধলেন অনিল-শ্রীদেবী । ‘কর্মা’ ছবিতে দিলীপ কুমার-নূতন জুটি কেন্দ্রে থাকলেও রাধা চরিত্রে শ্রীদেবীর অভিনয় দর্শক আলোচনায় আসে ।

পরের বছর ১৯৮৭তে শেখর কাপুর নির্দেশিত এবং বনি কাপুর প্রযোজিত ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই জুটি । এই সিনেমার গানগুলিও ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ।

এরপর আর থেমে থাকেনি, পরপর এই জুটি ‘লমহে’, ‘রূপ কি রানি, চোরো কা রাজা’, ‘লাডলা’,‘মি. বেচারা’, ‘জুদাই’সহ ১৫টিরও বেশি বাণিজ্য সফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছে ।

শ্রীদেবীর চলচ্চিত্রজীবনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা ‘লমহে’। অনিল কাপুরের বিপরীতে এই সিনেমাতে শ্রীদেবী মা ও মেয়ের দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেন। ব্লকবাস্টার এই সিনেমা ১৯৯১ সালে মুক্তি পায় ।

অনিল কাপুরের বিপরীতেই ‘জুদাই’(১৯৯৭) চলচ্চিত্রে অভিনয় করার পর সিনেমা থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেন শ্রীদেবী ।

‘মি. ইন্ডিয়া’ চলচ্চিত্রে শ্রীদেবী অভিনীত চার্লি চ্যাপলিনের দৃশ্য:

 

অমিতাভ বচ্চন:

বলিউডের ‘লেডি বচ্চন’ বলা হতো শ্রীদেবীকে । তার অভিনয়, মেধা,সৌন্দর্য, ছবি নির্বাচন সব ক্ষেত্রেই তার স্বতন্ত্রতা তাকে সুপারস্টারের খ্যাতি এনে দিয়েছিল ।

দর্শক যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল, দুই সুপারস্টারের যুগলবন্দি দেখার । টি রামা রাও পরিচালিত ‘ইনকিলাব’ ছবিতে প্রথম জুটি বাঁধলেন বলিউডের এই দুই সুপারস্টার ।

এই সিনেমার শ্যুটিং চলাকালীন অমিতাভ এক দুর্ঘটনায় খুব জোরালো আঘাত পান । সিনেমার শ্যুটিংয়ের কারণে অপারেশনও করাতে পারেননি ।

ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস, ২৬জানুয়ারি ১৯৮৪তে মুক্তি পেল ‘ইনকিলাব’।

১৯৮৪তেই অমিতাভ বচ্চন রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন ।

যদিও সিনেমাটি দর্শক টানতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয় ।

এরপর ১৯৮৬তে কে. ভাগ্যরাজ পরিচালিত ‘আখরি রাস্তা’য় আবার একসঙ্গে দেখা দেয় এই জুটি ।

পিতা-পুত্রের দ্বৈত ভূমিকায় অমিতাভের অভিনয় আবার আলোচনায় আসে । এই চলচ্চিত্রের ‘গোরি কা সাজন, সাজন কি গোরি’ জনপ্রিয়তা পায় ।

১৯৯২-এ মুক্তি পায় অমিতাভ-শ্রীদেবীর ‘খুদা গাওয়া’ । মুকুল এস. আনন্দ পরিচালিত অ্যাকশন ধর্মী প্রেমের এই ছবি তিনটি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় । যদিও এই দুই সুপারস্টার কোনো পুরস্কার পাননি ।

এরপর আর কেন্দ্রীয় চরিত্রে না হলেও কয়েকটি ছবিতে এরা একসঙ্গে অভিনয় করেছেন । ২০১২তে শ্রীদেবীর কামব্যাক সিনেমা ‘ইংলিশ ভিংলিশ’-এ একটি ক্যামিও চরিত্রে অমিতাভের অভিনয় মনে রাখার মতো ।