‘পুরুষদেরই প্রাধান্য, উপেক্ষিত নারী ভাষা সৈনিক’

একুশের দিনে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘ভাষা জয়িতা’ নির্মাতা শবনম ফেরদৌসীর মুখোমুখি গ্লিটজ..

রুদ্র হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2018, 01:03 PM
Updated : 21 Feb 2018, 03:23 PM

ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত গুটিকয়েক প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শবনম ফেরদৌসী নির্মিত ‘ভাষা জয়িতা’।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে নারীদের অংশগ্রহণকে উপজীব্য করে প্রামাণ্যচিত্রটি ধারণ করেছে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পুরো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।

গ্লিটজ:‘ভাষা জয়িতা’ সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই..

শবনম ফেরদৌসী: ছবিটা শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণকে তুলে ধরবার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পুরো নয়বছরের ভাষা আন্দোলনটাকেই ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

ক্রমান্বয়ে ইতিহাসটাকে তুলে ধরা হয়েছে, ফাঁকে ফাঁকে সেই ইতিহাসের মধ্যে নারী কী কী করেছে?

দেখা গেছে ১৯৪৮ সালে যারা ভাষা আন্দোলন করেছেন তারা জীবিত ছিলেন না। ২০০৭ এ আমি শ্যুটিং শুরু করি। আমি তাদের স্টিল ব্যবহার করেছি, তাদের পরিবারের কাছে গেছি। ১৯৫২ সালে আন্দোলন করা নারীদের মধ্যে ছয়জনকে জীবিত পাই আমি।

তারা ছিলেন টাঙ্গাইলের সোফিয়া খান, বরিশালের রানী ভট্টাচার্য, ঢাকার রওশন আরা বাচ্চু, হালিমা খাতুন, সুফিয়া আহমেদ। কয়েকজন ছিলেন দেশের বাইরে তাদের কাছে পৌঁছতে পারিনি।

এছাড়া পুরুষ ভাষা সৈনিক যারা ছিলেন ভাষা মতিনসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় জীবিত ভাষা সৈনিকদেরও সাক্ষাৎকার নিই। যারা বই লিখেছেন, গবেষণা করেছেন তাদের মন্তব্য আছে এতে। দুষ্প্রাপ্য ছবি ও ফুটেজ ব্যবহার করেছি।

গ্লিটজ: নির্মাণের পেছনের গল্পটা কেমন ছিল?

শবনম ফেরদৌসী: আমি তখন স্টেপস এ কর্মরত ছিলাম। তারা বাংলাদেশের ইতিহাসের উপর চারটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের প্রকল্প নেয়। সেখান থেকে আমি বেছে নেই ভাষা আন্দোলন।

তাদের প্রায়োরিটি ছিল নারীর অবদান। তখনও পর্যন্ত আমি শুধু দু’জনের নাম জানতাম। পরে দেখলাম খুঁজতে খুঁজতে অনেককেই পেলাম।

যেমন নারায়নগঞ্জের মমতাজ বেগম, তার জীবনের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় গেল আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য।

এ দিকগুলো আমি ধীরে ধীরে আবিষ্কার করি। নির্মাণ পদ্ধতিটাও খুব এক্সাইটিং ছিল। প্রচুর পড়াশোনা করেছি।

এ ছবি করতে গিয়ে জানলাম ভাষা আন্দোলন নয় বছরের সংগ্রাম। ১৯৪৮ এ যারা আন্দোলন করেছেন তারা ১৯৫২ সালে ছিলেন না। পড়াশোনা করে বেরিয়ে গেছেন।

আন্দোলন কিন্তু থামেনি। ১৯৫৫-৬৫ সালে ছাত্রী ছিলেন ভাষা সৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দি। ফলে এটি একটি দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল।

গ্লিটজ: তাহলে মুক্তিযুদ্ধ নয়মাস, ভাষা আন্দোলন নয় বছর...

শবনম ফেরদৌসী: হা হা, ঠিক তাই। এ জন্যই ভিত্তিটা অনেক স্ট্রং। এখনও ১৬ ডিসেম্বর হয়, ২৬ মার্চ হয় কিন্তু ভাষা দিবসে মানুষ অনেক বেশি আবেগপ্রবণ থাকে। ভাষা আন্দোলনটাকে আমার অনেক পোয়েটিক মনে হয়।

গ্লিটজ: প্রামাণ্যচিত্রটির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদান কতটুকু তুলে আনতে পেরেছেন?

শবনম ফেরদৌসী: ছবিটা করার সময় টাঙ্গাইলের প্রতিভা মুৎসুদ্দি মারা যান। ২০০৮ এর ফেব্রুয়ারিতে। ছবিটা করতে করতেই আমি দেখলাম একজন নারী ভাষা সৈনিক কতটা অবহেলায় মারা গেলেন। জানাজায় কতো কম সংখ্যক মানুষ এলো। তারা জানেই না।

কিন্তু ইনি যদি একজন পুরুষ ভাষা সৈনিক হতেন, তাহলে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হতো।

ওই ছবিটা করতে গিয়ে বলেন, নারীর অবদান রাজনীতিতে বলেন, আন্দোলনে বলেন, তার আসলে কোনো রকম স্বীকৃতি মেলে না। এটা এখানে পুরুষ ভাষা সৈনিকরাও বলেছেন।

ভাষা মতিন বলছেন, নারীদের কি এখনও মূল্য আছে? আবুল মাল আব্দুল মুহিত কারণ হিসেবে বলছেন, ‘পুরুষের কর্তৃত্ববাদ’।

পুরুষই স্বীকৃতি দেয়নি, যারা একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাষা আন্দোলন করেছেন তারাই তাদের নারী সহযোদ্ধাদের কথা বলেননি।

এ ছবিটির আগ পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় আমরা কিছু শহীদের নাম পাই, সকলই পুরুষ, নেতাদের নাম পাই সকলই পুরুষ। আপনি ভাবুন, ঘোমটা মাথায় গৃহিনী আন্দোলন করেছেন, ছাত্রী-শিক্ষিকা আন্দোলন করেছেন সে ইতিহাস এ জাতি এখনও জানে না।

গ্লিটজ: দেশে কতগুলো প্রদর্শনী হয়েছে?

শবনম ফেরদৌসী: দেশের কিছু উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে আর ভারতে। এমনিতে ঢাকায়, ঢাকার বাইরে মিলে দশটার বেশি শো হয়নি।

গ্লিটজ: সেক্ষেত্রে ‘ভাষা জয়িতা’ নির্মাণের লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে?

শবনম ফেরদৌসী: না, একেবারেই না। হয়নি। মানুষ এখনও পর্যন্ত জানে না। এটাতো শুধু ভাষা আন্দোলনে নারীর ইতিহাস নয়, এতে পুরো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটাই আছে।

এটা খুব ইম্পর্টেন্ট কাজ। আমার ইতিহাস ভিত্তিক ছবি দু’টো। এটা হচ্ছে প্রথম কাজ। খুব শ্রমসাধ্য কাজ। সারাদেশে দেখানো দরকার ছিল, তা হয়নি।

গ্লিটজ: এটি সারাদেশে প্রচারে সরকারি কোনো সহযোগিতা চেয়েছিলেন কি? সরকারের নজরে কি আদৌ এসেছে?

শবনম ফেরদৌসী: না, ছবিটি যেহেতু প্রযোজনা করেন স্টেপস টোয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট। তারা চেষ্টা করেছে কিনা আমি জানি না।

ছবিটা ইউনেস্কোতে পাঠানোর কথা উঠেছিল, সেটাও মনে হয় পরে আর কন্টিনিউ করেনি। আমার মনে হয়না সরকার এ ছবিটা সম্পর্কে জানে বা এটা আর্কাইভ করা হয়েছে।