চিরতরে থেমে গেল শাম্মী আক্তারের কণ্ঠ

‘ভালোবাসলে সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’ ,‘আমি যেমন আছি তেমন রব, বউ হবো না রে’- এ রকম অনেক জনপ্রিয় গানের শিল্পী শাম্মী আক্তার আর নেই।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2018, 11:07 AM
Updated : 16 Jan 2018, 03:01 PM

ক্যান্সারের সঙ্গে পাঁচ বছর লড়াই করে ৬২ বছর বয়সে এসে মঙ্গলবার হার মানেন এই কণ্ঠশিল্পী।

বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর চামেলীবাগের বাসা থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে শাম্মী আক্তারের মৃত্যু হয় বলে তার স্বামী লোকসঙ্গীত শিল্পী আকরামুল ইসলাম জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে গেলে  বিকাল ৪টার দিকে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নেওয়ার আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে।”

আকরামুল ইসলাম জানান, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে শাম্মী ব্রেস্ট ক্যান্সারে ভুগছিলেন।

“শাম্মী নিজের রোগটি লুকিয়ে রেখেছিল, সে প্রকাশ করেছিল অনেক পরে। যখন সে প্রকাশ করল, তখন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে। অনেকগুলো কেমো আর রেডিও থেরাপি দিতে হয়েছে। কিন্তু অসুখ তো নাগালের বাইরে চলে গেছে।গত ছয় মাস ধরে তার শারীরিক অবস্থা দ্রুত কলাপস করেছিল।”

বুধবার বাদ জোহর চামেলীবাগের আমিনবাগ জামে মসজিদে জানাজা শেষে শাহজাহানপুর কবরস্থানে শাম্মী আক্তারকে দাফন করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর ২০১৭ সালে অক্টোবরে সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ তার চিকিৎসায় অর্থ সাহায্য চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন।

‘ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’ গানটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন শাম্মী আক্তার।

তার গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘এই রাত ডাকে এই চাঁদ ডাকে হায় তুমি কোথায়’, ‘আমার মনের বেদনা বন্ধু ছাড়া বুঝে না’, ‘আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি’, ‘আমার নায়ে পার হইতে লাগে ষোল আনা’।

১৯৭৭ সালে তিনি ঘর বাঁধেন আরেক সঙ্গীতশিল্পী আকরামুল ইসলামের সঙ্গে। তাদের দুই সন্তান কমল ও সাজিয়া।

শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে তিনি সন্ধ্যায় শিল্পীর চামেলীবাগের বাসায় যান।

শাম্মী আখতারের মৃত্যুর খবর পেয়ে তার চামেলীবাগের বাসায় যান শিল্পী খুরশীদ আলম, রফিকুল আলম, রোমানা ইসলাম, সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি তপন মাহমুদ, গীতিকার কবির বকুল।

খুরশীদ আলম বলেন, “স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের যে কয়েকজন শিল্পী তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন শাম্মী আখতার তাদের একজন। তিনি যে মানের শিল্পী ছিলেন, তার মধ্যে তার কোনো গর্ববোধ ছিল না। তিনি সবাইকে যার যার প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন করতেন।”

রফিকুল আলম বলেন, “শিল্পী তো অনেকেই আছেন, কিন্তু শাম্মী আখতারের মতো গুণী শিল্পী সৃষ্টি হওয়া কঠিন।”

তপন মাহমুদ বলেন, “তিনি শিল্পী হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তার শিল্পীত্বের চেয়ে তিনি বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তার অকাল প্রয়াণে সঙ্গীতভুবনে অসামান্য শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।”

শিল্পী শাম্মী আখতার ১৯৫৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শামসুল করিম, মা রাবেয়া খাতুনের উৎসাহে শাম্মীর সংগীত শিক্ষা শুরু হয় মাত্র ছয় বছর বয়সে।

আখতারের গানের হাতেখড়ি বরিশালের ওস্তাদ গৌরবাবুর কাছে। পরে তিনি রাজবাড়ী ও খুলনায় সংগীত শিক্ষা নেন বাবু বামনদাস গুহ রায়, রণজিৎ দেবনাথ, সাধন সরকার, নাসির হায়দার ও প্রাণবন্ধু সাহার কাছে।

শাম্মী আখতার ১৯৭০ সালে খুলনা বেতারে তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে নির্বাচিত হন। সেখানে আধুনিক গানের পাশাপাশি নজরুল সংগীত পরিবেশন করতেন। পরে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের ট্রান্সকিপশন সার্ভিস আয়োজিত লোকসংগীত ও উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে খুলনার আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। এটাই ছিল ঢাকায় তার প্রথম সংগীত পরিবেশনা। এরপর তিনি বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন শুরু করেন।

আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘অশিক্ষিত’ চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। চলচ্চিত্রে গান গেয়েই জনপ্রিয়তা পান তিনি।

শাম্মী আখতার প্রায় ৪০০টি ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন। তার গাওয়া গানের দুটি ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে।