চলচ্চিত্র বিনিময় জরুরি: অপর্ণা সেন

পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলচ্চিত্র বিনিময় কার্যক্রমে ভাটা পড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ভারতীয় অভিনেত্রী-নির্মাতা অপর্ণা সেন।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2018, 07:08 PM
Updated : 15 Jan 2018, 08:28 PM

তার মতে, দুই দেশের বাংলা চলচ্চিত্র বিনিময় হলে বাজার হবে বড় এবং তাতে উপকৃত হবে দুই পক্ষই।

ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিতে এসে অপর্ণা সেন সোমবার সন্ধ্যায় মুখোমুখি হন গণমাধ্যমকর্মীদের।

তিনি বলেন, “দুই দেশের মধ্যে পারফেক্ট কোলাবরেশনের অভাবে এপার বাংলা আর ওপার বাংলার ছবির বিনিময় হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের ছবির বিনিময় ঘটানো খুবই জরুরি।

“দুই দেশের ছবিগুলো যদি দুই দেশে মার্কেট পায়, তাহলে দুই দেশের চলচ্চিত্রই সফলতার দিকে এগিয়ে যাবে।”

চলচ্চিত্র বিনিময়ের ক্ষেত্রে  ভারত সরকারের শর্ত হল, বাংলাদেশের ১০টি চলচ্চিত্রের বিনিময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ১০টি চলচ্চিত্র বিনিময় করবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রদর্শকরা শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্র আমদানি করতে চাইছেন।

জটিলতার দিকটি স্বীকার করে নিয়ে অপর্ণা সেন বলেন, “ভাষা ও সংস্কৃতির মিলের কারণে দুই বাংলার ছবির বিনিময় অনেকটাই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে ভারতের একটি রাজ্য। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের ছবি বিনিময় হয়, রাজ্যের সাথে রাষ্ট্রের নয়। বিনিময়ের জটিলতা এখানেই।”

ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘গুণ্ডে’-তে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করায় উঠেছিল সমালোচনার ঝড়। এবিষয়েও প্রশ্ন উঠে অপর্ণা সেনের কাছে।

ছবি: নয়ন কুমার

সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে এই অভিনেত্রী বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর বিশাল ভূমিকা ছিল। তখন তো বাংলাদেশ ছিল না, ছিল ভারত ও পাকিস্তান।  সেই কারণেই হয়তো ‘গুণ্ডে’ সিনেমায় সেটা উল্লেখ করা হয়েছে।  তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব না আমি।”

চলচ্চিত্র উৎসবের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় অপর্ণা সেনের সঙ্গে এই মতবিনিময় অনুষ্ঠান।

২০০০ সালে তার নির্মিত ‘পারমিতার একদিন’ প্রদর্শিত হয়েছিল ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ১৮ বছর পর আবারও তিনি যোগ দিলেন এ উৎসবে। সোমবার সন্ধ্যায় প্রদর্শিত হয় তার চলচ্চিত্র ‘সোনাটা’।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে রুপালি জগতে প্রবেশ অপর্ণা সেনের।

সত্যজিতের ‘তিন কন্যা’র পর ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘জন অরণ্য’ এবং ‘পিকু’তেও ছিলেন অপর্ণা।

তারপর  একে একে তিনি অভিনয় করেন ‘মেমসাহেব’, আকাশকুসুম’, ‘একদিন আচানক’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘বসন্ত বিলাপ’ ‘জীবন সৈকতে’, ‘সোনার খাঁচা’, ‘মোহনার দিকে’, ‘একান্ত আপন’, পারমিতার একদিন’, ‘অন্তহীন’, ‘চতুস্কোণ’সহ আরও অনেক চলচ্চিত্রে।

১৯৮১ সালে ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তার।

প্রথমটিতেই তাক লাগিয়ে দেন, শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে পেয়ে যান জাতীয় পুরস্কার। এরপর ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার’র জন্যও পান একই পুরস্কার।  তার পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘জাপানিজ ওয়াইফ’, ‘ইতি মৃণালিনী’, ‘গয়নার বাক্স’।

চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিও দিয়েছে।

তার মেয়ে কঙ্কনা সেন শর্মাও অভিনয়ের গুণে খ্যাতি কুড়িয়েছেন ভারতে।

অভিনেত্রী হিসেবে ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে এসে বিরতি নেন অপর্ণা।  ‘মনের মতো ব্যতিক্রমী’ চরিত্র ওই সময়ে নাকি খুঁজেই পাচ্ছিলেন না  তিনি।

অভিনয়ের বিরতির ফুরসতে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে তিনি লিখে ফেললেন তার প্রথম সিনেমার গল্প ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’।

অপর্ণা জানান, তার পরিচালক হিসেবে উত্থানের পেছনেও অবদান রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের।

অপর্ণা সেন বলেন, “তখন মোটেই ভাবিনি ওই গল্পটি থেকে আমি ছবি নির্মাণ করব। সত্যদা (সত্যজিৎ রায়) যখন গল্প দেখে বললেন ‘ইট হ্যাজ লটস অফ হার্ট, তুমি এই গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণ কেন করছো না?’প্রযোজক হিসেবে পেয়ে গেলাম শশী কাপুরকে। তারপর আমি একদিন পরিচালক বনে গেলাম।”

সত্যজিৎ রায়ের প্রতি সম্মান জানাতে ১৯৮৪ সালে তার নির্মিত ‘ঘরে বাইরে’ রিমেক করার ইচ্ছার কথাও জানান অপর্ণা।

এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার’ এর পর সিক্যুয়াল নির্মাণ করতে গিয়ে বাজেট সংকুলান হচ্ছে না।

“ভারতে ইংলিশ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের জন্য বাজেট পাচ্ছি না,” হতাশা লুকাতে পারেন না বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারজয়ী  এই অভিনেত্রী।

 ‘সোনাটা’  চলচ্চিত্রে বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “নারীবাদ হচ্ছে মানবতার একটা অংশ। সমাজের অর্ধেক অংশ নারী। আর এই অর্ধেক অংশ অবদমিত হলে পুরো সমাজ এবং রাষ্ট্রই অবদমিত থাকবে। ”

নারী নির্মাতা হিসেবে বিষয়বস্তু নির্বাচনই ‘সবচেয়ে বড় বাধা’ হিসেবে দেখেন অপর্ণা।

“আমার ছবি যত মানুষের কাছে পৌঁছানো দরকার তত মানুষের কাছে পৌঁছেনি, এটাই হচ্ছে বড় কষ্টের,” নিজের আক্ষেপের কথাও অপকটে বলেন তিনি।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় এখন মোবাইল ফোনেও সিনেমা দেখা সম্ভব, তবে কী হারাচ্ছে চলচ্চিত্রের আবেদন?

এ প্রসঙ্গে অপর্ণা বলেন, “ইন্টারনেট থেকে অনেক নির্মাতা কিন্তু আয়ও করছেন। এটা দোষের কিছু না। তবে সিনেপ্লেক্স আর ব্লকবাস্টারের আবেদন চিরন্তন।”

ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘সানন্দা’ ছেড়ে পরে  ‘পরমা’ ও ‘প্রথমা’ পত্রিকাও সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন অপর্ণা সেন। এবার ঘোষণা দেন, তিনি আর সম্পাদনার সঙ্গে কখনো যুক্ত হবেন না। 

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “প্রথমায় একটা ছেলে ছিল। সে ওই পত্রিকাটিতে কাজ করেই তার জীবিকা নির্বাহ করত। প্রথমা বন্ধ হওয়ার পর সেই ছেলেটি আত্মহত্যা করলো। মন ভেঙে গেছে সেদিন, সম্পাদনা ছেড়ে দিয়েছি।  আর কখনও যুক্ত হব না।”

ঢাকার চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়ে উচ্ছ্বসিত ৭৩ বছর বয়সী অপর্ণা; বললেন, “কান চলচ্চিত্র উৎসবের পর বিশ্বের অনেক বড় বড় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়েছি। কিন্তু এই ঢাকা উৎসবের মতো এত আন্তরিকতা কোথাও পাইনি।”